কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমে এখনও ভাবোচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, তিনি নাকি ছিলেন ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’, ‘ভারতীয় অর্থনীতির নতুন পথের দিশারি’, ‘তাঁরই প্রবর্তিত নয়া শিল্পনীতি, অর্থনীতির পথ অনুসরণ করে ভারত আজ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে’, ইত্যাদি।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, অর্থনীতিতে পাণ্ডিত্যের প্রশ্নে মনমোহন সিংহ ভারতের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম। কংগ্রেস, বিজেপি সহ নানা দলের বর্তমান সাংসদদের সাথে তাঁর তুলনা করলে ভদ্রতা, সৌজন্য ইত্যাদির প্রশ্নে তাঁকে এগিয়ে রাখতেই হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করতে গেলে ঠিক করতে হবে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁকে দেখব। দেশের শাসক শ্রেণির দৃষ্টিতে দেখলে তা এক রকম হবে। আবার শ্রমিক-কৃষক-নিম্নবিত্ত সহ সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের দৃষ্টিতে দেখলে সে মূল্যায়নের মাপকাঠি অন্য রকম হতে বাধ্য।
মনমোহন সিংহ সম্বন্ধে যে প্রশংসা শোনা যাচ্ছে, তার মূল কথা হচ্ছে তিনি ১৯৯০-এর দশকে ভারতের বাজারে দেশিবিদেশি পুঁজিপতিদের লগ্নির উপযোগী আর্থিক নীতি তৈরি করেছিলেন। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাঙ্কের কর্তাদের পরামর্শ অনুসারে ভারতের বাজারকে এমনভাবে সাজানোর কাজ হাতে নিয়েছিলেন, যাতে এ দেশের একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের সাথে অন্য দেশের সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বোঝাপড়াটা মসৃণ হয়। তার জন্য যতটা দরকার ততটা দেশের বাজার খুলে দেওয়ার কাজটা মনমোহন সিংহ দক্ষতার সাথেই করেছিলেন। ফলে ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিরাও তাদের জমে থাকা অলস পুঁজিকে বিশ্বের বাজারে খাটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন।
১৯৯১-এ কংগ্রেস সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংহ যে আর্থিক নীতির প্রস্তাব আনেন, তার মূল কথা ছিল বেসরকারিকরণ, উদারিকরণ, সরকারি ভরতুকি হ্রাস, শিল্প মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী শিল্প ও শ্রম আইনের ব্যাপক পরিবর্তন। জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় গড়ে ওঠা বিশাল বিশাল ভারি শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রগুলোকে অলাভজনক আখ্যা দিয়ে পুঁজিপতিদের কাছে জলের দামে বিক্রি করে দেওয়া শুরু হল। উদারিকরণের নামে ব্যাঙ্ক, বিমা, বিমান পরিবহণ থেকে শুরু করে শিক্ষা স্বাস্থ্য সহ সমস্ত রকম সরকারি বিভাগ ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে দেশি বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার তখনই শুরু। এই নীতিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক ও রেল পরিকাঠামো, পরিবহণে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ কমে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করল। পাশাপাশি গড়ে উঠতে শুরু হল প্রাইভেট স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যয়বহুল হাসপাতাল ব্যবসা। রেলের মালপরিবহণ, ক্যাটারিং সহ অন্যান্য নানা বিভাগ তুলে দেওয়া শুরু হল বেসরকারি হাতে। নিয়ে আসা হল তথাকথিত ‘শিল্পবান্ধব’ শ্রমনীতি। তাতে জলাঞ্জলি দেওয়া হল শ্রমিক স্বার্থ। চুক্তির ভিত্তিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে শ্রমিক কর্মচারী নিয়োগের অবাধ অধিকার দেওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হল মালিকদের। তারা যে কোনও সময় যে কোনও কর্মচারীকে বরখাস্ত করতে পারবে এবং ইচ্ছেমতো লক আউট, লে অফ, বেতন হ্রাস করতে পারবে। শ্রমিক কর্মচারীর সংখ্যা ইচ্ছেমতো কমিয়ে বাকিদের ওপর যত খুশি কাজের বোঝা বাড়াতে পারবে। বলা হল, নতুন যুগের শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকেও হতে হবে ‘দায়িত্বশীল’ অর্থাৎ মালিকের সমস্ত অন্যায় তাদের মেনে নিতে হবে, আন্দোলন করা চলবে না। এই মনমোহিনী নীতি শুধু বেসরকারি শিল্পক্ষেত্রে নয়, সরকার তার নিজস্ব সমস্ত কর্মক্ষেত্রেও চালু করতে শুরু করল।
ভুলে গেলে চলবে না যে, মনমোহন সিং-এর প্রধানমন্ত্রিত্বে চলা দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে টুজি স্পেকট্রাম, কমনওয়েলথ, কয়লা খনি কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। এই সরকারের অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েই বিজেপি ক্ষমতা দখল করেছে।
এই শিল্পনীতি ও অর্থনীতি চালু করার সময় মনমোহন সিংহ এবং তাঁর গুণমুগ্ধরা যুক্তি দিয়েছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলো সব লোকসানে চলে। চাকরির নিরাপত্তা থাকার জন্য এই সব ক্ষেত্রের কর্মচারীরা কাজ করতে চান না, ফাঁকি দেন। প্রাইভেট হয়ে গেলে মালিকের চাপে সবাই কাজ করতে বাধ্য হবে। তাঁরা আরও বললেন, একই শিল্পে অনেক দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করলে প্রতিযোগিতার ফলে পণ্য ও পরিষেবার দাম কমবে এবং মানও বাড়বে। কিন্তু উদারিকরণ বা বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বেই ঘটেছে এর ঠিক বিপরীত ঘটনা। এ দেশে টেলিকম ক্ষেত্রে তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ মানুষ নিজের চোখেদেখেছে। টেলিকম ক্ষেত্র বেসরকারিকরণের সময় বেশ কিছু বেসরকারি টেলিকম কোম্পানি গজিয়ে উঠেছিল। এই সময় আম্বানি গোষ্ঠীর জিও সস্তার টোপ দিয়ে প্রায় সব প্রতিযোগীকে বাজার থেকে হটিয়ে দিয়ে প্রায় একচেটিয়া হয়ে ওঠে। সব কোম্পানি পিছিয়ে যাওয়ার পর এখন তারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে কার্যত বাধ্য করছে সাধ্যের বাইরে গিয়েও তাদের় মুনাফা জোগাতে।
এটাই আসলে হওয়ার কথা ছিল। আজকের একচেটিয়া পুঁজিবাদের যুগে অবাধ প্রতিযোগিতার কোনও স্থান নেই। একচেটিয়া পুঁজির দাপটে ছোট পুঁজি আজ কোণঠাসা। প্রতিযোগিতা যতটুকু হয়, তাও হয় একচেটিয়াদের মধ্যেই। তাতে মানুষের কোনও সুরাহা হয় না। একচেটিয়া মালিকরা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে দাম বাড়ায়। মানুষের সামনে পছন্দের কোনও সুযোগ থাকে না। উদারিকরণ, বিশ্বায়নের ধাঁচে শ্রমনীতির কল্যাণে বর্তমানে কারখানায়, পরিষেবা ক্ষেত্রে এমনকি স্কুল-কলেজে যতটুকু কর্মসংস্থান হচ্ছে তার সিংহভাগই অস্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক এবং নিতান্তই স্বল্প বেতনে। কাজের বিপুল বোঝায় শ্রমিক কর্মচারীরা অনেকেই কমবয়সেই শারীরিক এমনকি মানসিক ভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কিন্তু কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে, সমস্ত অন্যায় মানতে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন। কৃষিক্ষেত্রে সার, বীজ প্রভৃতির ওপর সরকারি ভর্তুকি ছাঁটাই করার ফলে এবং কৃষকের ফসলের নূ্যনতম সহায়ক মূল্য না থাকায় চাষ এখন আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের কাছে লাভজনক নয়। ঋণ শোধ করতে না পেরে কৃষকদের আত্মহত্যা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পর্যবসিত। পেটের দায়ে গ্রামীণ মানুষ স্বল্পবেতনে চুক্তিভিত্তিক মজুর খাটার জন্য সমাজ-পরিবার ছেড়ে দূরদূরান্তে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ মানুষ। সৃষ্টি হয়েছে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’, ‘গিগ শ্রমিক’ প্রভৃতি। এ দিকে খাদ্যদ্রব্য সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম প্রতিনিয়ত এমন লাফিয়ে বাড়ছে যে, কেনাকাটা কমাতে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সকলেই বাধ্য হচ্ছেন। এ দেশের মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ পরিণত হচ্ছে নিম্নবিত্তে এবং নিম্নবিত্তরা দ্রুত পরিণত হচ্ছে দিনমজুরে, অন্নহীন, বস্ত্রহীন, বাসস্থানহীন পথের ভিখারিতে। এইরকম ভয়ঙ্কর শোষণের ফলেই এ দেশের পুঁজিপতিরা আজ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এটাকেই পুঁজিপতিদের বেতনভুক তাত্ত্বিক ও সাংবাদিকরা গোটা দেশের অর্থনীতির বিকাশ বলে তারস্বরে প্রচার করে যাচ্ছে।
বর্তমানে কেন্দে্রর শাসক বিজেপি এবং বিরোধী কংগ্রেস ভোটের রাজনীতিতে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও, মোদি সরকার প্রবল গতিতে মনমোহন সিং-এর এই নয়া শিল্প নীতিকেই আরও তীব্র গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এ বিষয়ে তাদের কোনও বিরোধ নেই। দুঃখের বিষয় বামপন্থী নামধারী যে দলগুলি নানা সময় সরকারি গদির স্বাদ পেয়েছে তারা মুখে এই নয়া শিল্প অর্থনীতির বিরোধী হলেও দেশব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে তাদের কোনও আগ্রহ নেই। যেখানে তারা সরকারে গেছে সেখানেই উদারিকরণ, বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার দায়িত্ব নিয়েছে। একই পথে চলেছে তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকারও। একচেটিয়া মালিকদের সোবদাসরা সকলেই এই রাস্তার পথিক। তাদের পথপ্রদর্শক মনমোহন সিংয়ের সম্বন্ধে বিভিন্ন পুঁজিবাদী দল, সরকার, বুর্জোয়া চিন্তাবিদ, সাংবাদিক সে জন্যই এত প্রশংসায় পঞ্চমুখ।