Breaking News

২১ জানুয়ারি মহামিছিলঃ ‘ওই দেখো জনতা পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে’

সংগ্রামী জনতা শেষ কথা বলে’

 মহামিছিল শেষে বন্ধুরা মিলে একটা চায়ের দোকানে গেছি। পাশের বেঞ্চ থেকে দু’জনের কথোপকথন কানে এল।

প্রথম জন বলছেন, বাপ রে কী বিশাল মিছিল, এত লোক!

দ্বিতীয় জন বললেন, এত বড় মিছিল ইদানিং দেখিনি রে!

প্রথম জনঃ এসইউসির এত লোক! সত্যিই অবাক করার মতো। সরকারি দল নয়, এমএলএ-এমপি নেই, কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবুও এসইউসির ডাকে এত লোক! গ্রামের গরিব মানুষও ছিল প্রচুর সংখ্যায়।

দ্বিতীয় জনঃ হুম, আর মিছিলের স্লোগানের জোর দেখেছিস, একেবারে ভেতর থেকে এলে যেমন হয়!

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ওঁদের কথার মাঝে ঢুকে পড়লাম। বললাম, বড় মিছিল ঠিকই। তবে দাদা, এই রকম বড় মিছিল অন্যান্য সরকারি দলগুলো অনায়াসে করতে পারবে।

দ্বিতীয় ব্যক্তিটি তখন আমার দিকে মুখটা ফিরিয়ে একটু বিরক্ত হয়ে বললেন– দাদা সে তারা করবে ক্ষমতার জোরে, কিছু পাওয়ার লোভ দেখিয়ে, কিন্তু এরা তা নয়। আর একটা কথা বলি, আপনার থেকে বয়সে আমি বেশ কিছুটা বড়, নানা সরকারি দলের এমনকি অন্য বামপন্থী দলেরও অনেক বড় মিছিল দেখেছি কিন্তু এত বলিষ্ঠতা খুব একটা দেখিনি। ইদানিং তো নয়ই। ওইসব মিছিলে লোক গল্প করতে করতে, হাসতে হাসতে হেঁটে যায়। এখানে পুরো মিছিলে একবারের জন্যও তা দেখলাম না। কথা না বাড়িয়ে চায়ের দাম মিটিয়ে দোকান থেকে সবাই বেরিয়ে এলাম। কারও মুখেই কোনও কথা নেই, হয়তো আমার মতো ওদেরও মনে ওই কথাবার্তারই রেশ বয়ে চলেছে।

বাসে বসে ভাবছি, আমরা মিছিলে হেঁটে যা দেখতে পাইনি ওই দু’জন মিছিলের বাইরে থেকে সেটা দেখতে পেয়েছেন। ওঁরা দেখেছেন– মিছিলের প্রাণ। শুধুমাত্র জনপ্লাবনেই কোনও মিছিল জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে না। মিছিল জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রাণের স্পন্দনে, যা ফুটে বেরিয়েছে মিছিলের দাবিতে, তার স্লোগান তোলার ভঙ্গিতে। ওই দু’জনের মতোই রাস্তার দু’ধারে বাড়ির বারান্দা, ঘরের জানলা থেকে উঁকি দিয়ে, আটকে যাওয়া বাসে বসে-দাঁড়িয়ে যাঁরাই এই মিছিল দেখেছেন, একুশে জানুয়ারির মহামিছিলের বিশালতা, তার দৃপ্তভঙ্গি তাঁদের প্রত্যেকেরপ্রতিবাদী সত্তাকে, বিবেককে স্পর্শ করেছে। আর করেছে বলেই তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিছিল দেখেছেন কিন্তু একবারের জন্যও তা ভেঙে রাস্তা পার হওয়ার কথা ভাবেননি।

বাড়ি ফির়েছি, হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন। ধরলাম। অপর প্রান্ত থেকে একজন বললেন– আমি অমুক বলছি। নামটা শুনে চমকে উঠলাম। বিগত সরকারি দলের এলাকার এক নামকরা নেতা। বললেন, চিনতে পারছো? একটু অবাক হয়েই বললাম, হ্যাঁ পারছি, বলুন। বললেন, আজ দারুণ মিছিল হয়েছে তোমাদের। খুব ভাল লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় দেখলেন? উত্তর দিলেন, ফিল্ডেই দেখেছি। রাস্তাতেই ছিলাম। অনেকদিন বাদে একটা ভাল মিছিল দেখলাম। খুবই বলিষ্ঠ মিছিল হয়েছে ভাই। ইদানীং এ রকম মিছিল আমি অন্তত দেখিনি। আমি বামপন্থী, তোমরাও বামপন্থী পার্টি। তাই ভাবলাম তোমাদের কনগ্র্যাচুলেট করা উচিত। তাই লাইব্রেরি থেকে তোমার ফোন নম্বর জোগাড় করে কল করলাম। ভাল থেকো, এগিয়ে চলো।

ফোনটা শেষ হওয়ার পর ভাবছি– সংগ্রামী জনতার একটা বলিষ্ঠ মিছিল কী ভাবে মানুষকে নাড়া দিয়ে যায়, হতাশা কাটিয়ে তাকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে! হঠাৎ মনের মধ্যে একটা গানের সুর ভেসে উঠল– ‘ওই দেখো জনতা পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে স্লোগান তুলে“শাসকের দম্ভ চূর্ণ করে সংগ্রামী জনতা শেষ কথা বলে।’

বিপু ভট্টাচার্য, বরানগর

এখনও মিছিলের শেষ দেখতে পাচ্ছি না

মিছিলটা তখন দৃপ্ত ভাবে এগিয়ে চলছে, ধর্মতলার দিকে। ওয়েলিংটন মোড়ে আমি তখন আটকে থাকা মানুষের মধ্যেই। কতক্ষণ চলছে জানতে চাইলে এক পুলিশ কর্মী বললেন, মিনিট চল্লিশ তো মিছিলটা চলছেই। এখনও এর শেষ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বললেন, ভীষণ ভাল লাগছে। এমন সুসজ্জিত মিছিল, বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যেভাবে গলা মেলাচ্ছে এবং বাবা মায়ের হাত ধরে হাঁটছে সত্যিই অবাক হচ্ছি। জিজ্ঞেস করলাম, মিছিলের লোক সংখ্যা প্রায় কি ৪০-৫০ হাজার হতে পারে। পুলিশ কর্মীটি বলে উঠলেন, অনেক বেশি— ৭০ থেকে ৮০ হাজার। বললেন, অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কাল কোনও কাগজে এর খবর পাবেন না। বললেন, আমার নিজের জেলা থেকে নানা রকমের ব্যানার প্ল্যাকার্ড নিয়ে লোকজন হাঁটছেন দেখে ভালো লাগছে।

দীনেশ মেইকাপ, পূর্ব মেদিনীপুর

ভরসা বেড়ে গেল

মিছিলের পরদিন ওয়েলিংটনে হেলমেট ও সিট কভারের দোকানের কর্মীরা ডেকে বললেন, দিদি আপনাদের মিছিল খুব ভাল হয়েছে। মিছিলে সাধারণ মানুষ এবং মহিলাদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। আর সব থেকে বেশি ভাল লেগেছে আপনাদের মিছিলের মধ্যে লাল পতাকার পতপত করে ওড়া দেখে। যুবক-ছাত্র-ছাত্রী, অনেক প্রবীণ মানুষ, অন্ধ মানুষ, লাঠি হাতে মানুষও হাঁটছেন আপনাদের মিছিলে। মিছিলের দাবিগুলি তো আমাদেরই।

আমার মনের মধ্যে এক সুন্দর অনুভূতি হল। ওঁদের সঙ্গে কথা বলে চলে আসছি, এক তরুণ দৌড়ে এসে বললেন, আপনাদের মিছিল এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে গেছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আরও একজন যুবক এগিয়ে এলেন। তিনিও বললেন, দিদি আপনাদের মিছিলে এত মানুষ দেখে মনে অনেক জোর পেলাম। আপনাদের দলই পারবে সমস্ত মানুষকে এক করে লড়াই করতে।

মন্দিরা দাস দাস, ভবানীপুর

জীবনের সঙ্গে মিলে যাওয়া দাবি

এবারের মহামিছিলের দাবিগুলি যেন মানুষের মনের ভেতরে গিয়ে তাদের জীবনের সঙ্গে মিলে গেছে। মিলে যাওয়ার আবেগ থেকেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেক কথা। বিচার পায়নি অভয়া, বিচার পায়নি সাধারণ মানুষও। মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষার ভয়াবহ অবস্থা, স্মার্ট মিটার চালু ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে জীবন জেরবার। তাই গরিব ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দলের কর্মীরা যখন প্রচার করছে, টাকা পয়সা সংগ্রহ করছে আন্দোলনের তহবিলে, তখন সাধারণ মানুষ তো বটেই, শাসক দলের পঞ্চায়েত মেম্বার ও তাঁর স্ত্রীও বলেছেন, জনগণের দাবি নিয়ে লড়ছো তোমরাই। মহামিছিলেরপ্রচার আন্দোলনের পরিবেশ তৈরি করেছে। আন্দোলনের প্রচার নানা সুবিধাবাদের বাঁধনকে আলগা করে দিয়েছে। সিপিএমের কেউ কেউ বলছেন, রাস্তায় তোমরাই আছো, আন্দোলন তোমরাই করছো। বোঝা যায়, মহামিছিল মানুষের মনের উপর একটা গভীর ছাপ ফেলেছে।

গোপাল সাহু, বারুইপুর