বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন সংবিধান রচনার ঘোষণা দিয়ে পুরনো সংবিধানের নানা বিষয় সংস্কার করার প্রস্তাব করেছে এবং এ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সাথে মতবিনিময় করছে। এ প্রসঙ্গেই বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী)-র পক্ষ থেকে যে মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে, সেটি লিখিতভাবে আমাদের কাছে তাঁরা পাঠিয়েছেন। আমরা এ দেশের মানুষের জ্ঞাতার্থে সেটি প্রকাশ করছি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক সমাজের খসড়া ঘোষণাপত্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের দল বাসদ (মার্ক্সবাদী) বা জোটকে না দিলেও এটা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত। গত ১৬ জানুয়ারি সরকারের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সর্বদলীয় বৈঠকে আমাদের দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং আরেকটি ঘোষণাপত্র পাঠানো হয়।
এই দু’টি ঘোষণার বেশ কিছু অংশের সাথে আমরা একমত থাকলেও, এখানে বিভিন্ন বিষয়কে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেটা অনেক ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ, বেশ কিছু জায়গায় ভুল এবং খানিকটা বিভ্রান্তিকর বলে আমাদের মনে হয়েছে। এই দু’টি ঘোষণাপত্রের প্রধান কয়েকটি দিক নিয়ে আমরা কিছু আলোচনা রাখতে চাই, যাতে এ সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে সত্যে উপনীত হওয়ার পথটি প্রশস্ত হয়। আমরা নিশ্চিত যে তারা এই বক্তব্যটি ভেবে দেখবেন। সময়াভাবেও সকলের পড়ার সুবিধার্থে আমাদের বক্তব্য বিস্তারিত না করে সংক্ষিপ্ত আকারে রাখছি। (পরে আমরা এবিষয়ে বিস্তারিত মতামত রাখতে পারি)
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমগ্র জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের একটা পর্যায় শেষ হয় এবং ১৪ আগস্ট স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তান মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর কাঁচামাল ও পুঁজি সংগ্রহের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এ অঞ্চলের জনগণ চূড়ান্ত শোষণের শিকার হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী হলেও, এ অংশে ১৯৫০-’৫১ থেকে ১৯৫৪-’৫৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ ছিল মাত্র ২০ শতাংশ। এই নির্মম শোষণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নীরবে মেনে নেয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের উপর এই নির্মম শোষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিমপাকিস্তানেরবিরাটভৌগোলিকদূরত্বএবংপাকিস্তানেরদুইঅংশেরভাষাওসংস্কৃতিগত পার্থক্য। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এই শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তস্নাত বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়– এই আন্দোলনগুলি মানুষের চিন্তার মধ্যে প্রথম স্বাধিকারের ধারণা নিয়ে আসে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী কর্মসূচির মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের একটা ধারণা মূর্ত হয়। উল্লেখ্য যে, শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় জননেতা মওলানা ভাসানী এই পর্ব থেকে একটার পর একটা গণআন্দোলন সংগঠিত করেছেন, যা শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরিণতি লাভ করেছিল। কিন্তু ইতিহাসে ওঁর এই ভূমিকার কথা সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। ১৯৭০ সালের ২০ ও ২১ নভেম্বর খুবই অসুস্থ অবস্থায় মওলানা ভাসানী ঘূর্ণিঝড়ে ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত এলাকা ঘুরে আসেন। ২৩ নভেম্বর পল্টনে এক ঐতিহাসিক জনসভায় তিনি বক্তব্য রাখেন। সে বক্তব্যের শেষে স্লোগান তোলেন, ‘‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’’। আবার ৩০ নভেম্বর ‘জনগণের প্রতি মওলানা ভাসানীর ডাক’ শীর্ষক এক প্রচারপত্রে তিনি আবেদন রাখেন, ‘‘পূর্ব পাকিস্তানের আজাদি রক্ষা ও মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ুন।’’ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সম্ভবত এটাই প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি।
এ ছাড়া বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের দাবির ভিত্তিতে ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন ও শ্রমিক-কৃষকদের মুক্তির দাবি সহ ১১ দফার ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান– এই ঘটনাগুলো পাকিস্তানের পুঁজিপতিদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। এর পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের গণপরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় শুধুমাত্র একটা দলের নির্বাচনী বিজয় ছিল না। এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের আকাঙক্ষার প্রতিফলন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু এই সকল আন্দোলনে বামপন্থীদের একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল।
১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এই গণআন্দোলনগুলোর স্বাভাবিক পরিণতি। এতে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল ও লক্ষ কোটি জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু এই গৌরব আওয়ামী লীগ একা আত্মসাৎ করতে গিয়ে এই মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই মুক্তিযুদ্ধে জাতির একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ রাজাকার, আলবদর বাহিনী যেমন ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি লক্ষ কোটি জনগণ অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করে পাক বাহিনীকে প্রতিহত করেছে।
পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ঘটনাবলি মহান লেনিনের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘‘সাম্রাজ্যবাদের যুগে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালিত না হয়ে যদি বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়, তাহলে সে স্বাধীনতা হবে আধসেঁকা রুটির মতো।’’ লক্ষ লক্ষ মেহনতি মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা অর্জিত হল, আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাওয়ার ফলে ও সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উত্ত়ীর্ণ হওয়ার ফলে এ দেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গঠিত হল তা প্রথম দিন থেকেই শোষণ, জুলুম ও স্বেচ্ছাচারিতার দিকে পা বাড়াল। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ এই চার বছরে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একটার পর একটা জনবিরোধী নীতি রাষ্ট্র কার্যকরী করতে শুরু করে। সাংবাদিক ও বিরোধীদের ধরপাকড় ও হত্যা করতে শুরু করে। বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারকে। জাসদের ৩০ হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়। একটার পর একটা সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানকে কবরস্থ করে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয় এবং ফেব্রুয়ারিতে ‘বাকশাল’ গঠন করার মাধ্যমে সেই জাতীয় দল গঠন করা হয়। বাকশাল ছাড়া অন্য সকল দল নিষিদ্ধ করা হয় এবং ৫টি বাদে সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময় যদি একটি যথার্থ মার্কসবাদী দল উপস্থিত থাকত তাহলে এর বিরুদ্ধে সত্যিকারের প্রতিরোধ গড়ে তোলা যেত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত একের পর এক ক্যু, পাল্টা ক্যু চলতে থাকে এবং সর্বশেষে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়। সামরিক শাসনের অবসানের পরও দেশের স্থায়িত্ব আসেনি। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আরোহণের সময় শেখ হাসিনা জামায়াতের সাথে কৌশলগত ঐক্য করেন, ২০০১ সালে বিএনপি জামায়েতের সাথে জোট করে ক্ষমতায় আসে। পরবর্তীতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। এই প্রতিটি সরকারই ক্রমাগত গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে, একের পর এক জনবিরোধী নীতি কার্যকর করেছে এবং শেষ ১৫ বছর আওয়ামী লীগ এই শোষণ-জুলুম-অত্যাচার-বাকস্বাধীনতা হরণকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে। ইতিহাসের এই বর্ণনায় আমরা নতুন কিছু আনিনি। জুলাই ঘোষণার মধ্যে যে উল্লেখযোগ্য ফাঁকটি থেকে গিয়েছিল তা ভরাট করেছি মাত্র।
বাহাত্তরের সংবিধান প্রসঙ্গে
বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে তাদের আলোচনাটাও অনেকটা একপাক্ষিক। এই ঘোষণাপত্রে তারা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল নবগঠিত সরকারের যে ঘোষণা দেয়া হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের যথার্থ ভিত্তি হিসেবে সেটাকেই ধরছেন।
অথচ ১০ এপ্রিলের এই ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিবকে সকল প্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী সহ সকল মন্ত্রীদের নিয়োগ, গণপরিষদ আহ্বান ও মুলতুবি করা, জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র শেখ মুজিবকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, বাহাত্তরের সংবিধান এর চেয়ে বেশি কিছু করেনি। বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে শেখ মুজিব গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে না গিয়ে ১৯৭০ সালের গণপরিষদ ও প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজয়ী প্রতিনিধিদের নিয়েই গণপরিষদ গঠন করলেন ও সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু করলেন। ফলে একটা অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংবিধান রচনা শুরু হল। জুলাই ঘোষণার ঘোষণাকারীরা হয়তো লক্ষ করেননি, তাঁরা স্বাধীনতার ঘোষণপত্রে উল্লেখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এই তিনটি শব্দের উপর যে জোর দিয়েছেন, তাও বাহাত্তরের সংবিধানে উল্লেখ করা আছে। এগুলোকে অন্যতম মূল লক্ষ্য হিসেবে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে। কথাটা এইভাবে আছে যে, ‘‘…আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিতহইবে।’’
বলাই বাহুল্য যে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতা ঘোষণার মতোই বাহাত্তরের সংবিধানেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবের হাতে প্রভূত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়। ফলে আমাদের দলের সুবিবেচিত মতামত হল যে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের মধ্যে মৌলিক কোনও পার্থক্য নেই। আমরা আরও মনে করি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক সাম্য, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও সুবিচার– এই শব্দগুলো লক্ষ কোটি জনগণের আকাঙক্ষার প্রতিফলন হওয়ার ফলে আওয়ামী লীগ বাহাত্তরের সংবিধানে এগুলি অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। মানব সভ্যতার এই প্রগতিশীল ধারণাগুলো প্রকৃত কার্যকর করার কোনও ইচ্ছাই তাদের ছিল না, যা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যখন আমরা দেখি ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের তিন বছরের মধ্যেই শেখ মুজিব চারটি সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে একদলীয় শাসন বাকশাল চালু করেন।
এই সংবিধান প্রণয়নের আগে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে মুজিববাদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে সংবিধানে এটাকেই মূলনীতি করা হয়। এটাকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্ন এখন এসেছে যে, এই সংবিধানের ভাবাদর্শগত ভিত্তি হলো মুজিববাদ। এ ক্ষেত্রে জেনে রাখা উচিত যে, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা একটা আধুনিক, গণতান্ত্রিক সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়ারা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীস্বাধীনতা, এক মানুষ-এক ভোট এ সকল প্রগতিশীল ধারণাগুলো নিয়ে এসেছিল। এরপর থেকে সকল বুর্জোয়া রাষ্ট্রই তাদের সংবিধানকে এই ধারণাগুলোর উপর দাঁড় করায়। যদিও আজকের এই সাম্রাজ্যবাদের যুগে আন্তর্জাতিকভাবে বুর্জোয়ারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাওয়ার কারণে সকল দেশেই এই ধারণাগুলো সংবিধানে লেখা আছে, বাস্তবে রাষ্টে্রর কোথাও এর কার্যকারিতা নেই। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হয়। পূব দিগন্তে এই সভ্যতার উদয় দেখে একে সালাম জানিয়েছিলেন আইনস্টাইন, রমাঁ রল্যাঁ, বার্ট্রান্ড রাসেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন মনীষী। এরপর থেকে স্বাভাবিকভাবেই রুশ দেশের এই শোষণবিহীন সমাজব্যবস্থা সমাজতন্ত্র জনগণের একটা গুরুত্বপূর্ণ আকাঙক্ষা ও চাহিদা হিসাবে উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা আন্দোলনে বারবার ধ্বনিত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামেও বহু বুদ্ধিজীবীর মুখ থেকে সমাজতন্ত্রের আকাঙক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। সংবিধান প্রণয়নের সময়ও এই দাবি উঠেছে। ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল পল্টনে ভাসানী বলেন, ‘‘একটি ন্যাশনাল কনভেনশন ডেকে সকলের মতামত নিয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা উচিত ছিল। কিন্তু সরকার তা করেনি।’’ …‘‘পরিষদের যে একদলীয় শাসনতন্ত্র প্রণীত হচ্ছে তাতে কৃষক শ্রমিক সর্বহারা মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং খাঁটি সমাজতন্ত্রের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।’’ ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল সন্তোষে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় এক প্রস্তাব গৃহীত হয় ‘‘সংবিধান হবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক। সকল ধর্ম মতের অনুসারী বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার পায়, সেজন্য শাসনতন্ত্রের নিশ্চয়তাথাকতে হবে।’’ ফলে আওয়ামী লীগ মুজিববাদ বলে যা দাবি করেছে, তা অন্তঃসারশূন্য।
এর পরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ১৯৭২ সালের প্রণীত সংবিধানের উপর মোট ১৭টি সংশোধনী বিভিন্ন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এনেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংশোধনী ছাড়া এর প্রত্যেকটি সংশোধনী জনগণের অধিকার কোনও না কোনওভাবে খর্ব করেছে। আমাদের দলের অভিমত হল, বাহাত্তরের সংবিধানের প্রগতিশীল ইতিবাচক দিকগুলোকে অক্ষত রেখে মূলত কাঠামোগত দিকটা সংস্কার করা উচিত। একইসাথে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজ এই ছয়টি মৌলিক অধিকারকে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে সংযুক্ত করা উচিত এবং মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে রচিত অধিকারগুলোকে আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য করা উচিত।
একটা কথা আমরা বলতে চাই, একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান অবশ্যই জনগণের আকাঙক্ষা। কিন্তু এই ধনী ও দরিদ্র, বৃহৎ ব্যবসায়ী ও মেহনতি মানুষ, শোষক ও শোষিতে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সংবিধান সংস্কার করা সহজ, কিন্তু কার্যকর করা সহজ নয়।
দেশের সার্বভৌমত্ব প্রসঙ্গে
জুলাই ঘোষণাপত্রে এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে নিয়ে আসা জরুরি ছিল। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দুনিয়ার বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, যেমন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশগুলো ও পরবর্তীকালে চিন, রাশিয়া, জাপান তাদের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এদেশের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের উপর বারবার হস্তক্ষেপ করেছে। বর্তমান সময় এই হস্তক্ষেপ অনেকগুণ বেড়েছে। আমরা দ্বিধাহীনভাবে বলতে চাই যে, সবরকম সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। দেশকে কোনওভাবেই জিম্মি রাখা যাবে না। দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখা সরকারের অবশ্যকর্তব্য।
ঘোষণাপত্র দু’টির মধ্যে পার্থক্য
প্রথম ঘোষণাপত্রে ৩০ নম্বর ঘোষণার ৩ নম্বর পয়েন্টে যে সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহণে সরকার গঠন, ‘ডিকলোনাইজড ট্রুথ অ্যান্ড হিলিং কমিশন’-এর প্রস্তাবনা, সেনাশাসন-রাষ্ট্রীয় পুঁজি-বৃহৎ ব্যবসায়ী-আমলাতন্ত্র এদের বিরুদ্ধে প্রস্তাবনা– এই প্রস্তাবনাগুলি অজ্ঞাত কারণে দ্বিতীয় ঘোষণায় নেই।
নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রসঙ্গে
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সূচনা হয়। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার বীরত্বপূর্ণ, বিপুল আত্মত্যাগের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে ইতোমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু এই গণঅভ্যুত্থান পুরনো ব্যবস্থার পরিবর্তন করে নতুন কোনও ব্যবস্থা প্রবর্তন করেনি। কোনও নতুন রাষ্টে্ররও জন্ম দেয়নি। একটি চূড়ান্ত অত্যাচারী, স্বেচ্ছাচারী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাসমর্থনে, বর্তমান সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে। ফলে দ্বিতীয় রিপাবলিকের ধারণাটি সঠিক নয়।
গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে
আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব জাগরণ এই গণঅভ্যুত্থান। প্রায় দেড় হাজারেরও অধিক প্রাণ দিয়েছেন এই আন্দোলনে। আহত হয়েছেন ২৫ হাজারেরও অধিক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভ্যুত্থানে আমরাও সর্বশক্তি নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এদেশে কোনও গণঅভ্যুত্থানকেই এত রক্তের স্রোত পাড়ি দিতে হয়নি। এত মানুষকে চোখের দৃষ্টি হারাতে হয়নি, পঙ্গু হতে হয়নি। এই বিরাট আত্মত্যাগ এই সময়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
এই গণঅভ্যুত্থান থেকে ফ্যাসিবাদ ধ্বংসের স্লোগান উঠেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতন মানেই ফ্যাসিবাদের পতন নয়। ফ্যাসিবাদ কোনও দল আনে না, ফ্যাসিবাদ আনে একটি ব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে উন্নত কিংবা অনুন্নত সকল দেশেই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দেখা যায়। ফ্যাসিবাদ কায়েম একদলীয় শাসনের মাধ্যমে হতে পারে, দলীয় শাসনের মাধ্যমে হতে পারে, সামরিক শাসনের মাধ্যমে হতে পারে। দুনিয়ার দেশে দেশে ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের মুখোশ পরেই এসেছে। আজকের যুগে কোনও পুঁজিবাদী দেশই জনজীবনের কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারে না। ফলে সে জনগণের বিক্ষোভ দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা এ যুগে প্রত্যেকটি পুঁজিবাদী দেশে বিদ্যমান। অর্থাৎ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রমাত্রেই আজ কমবেশি ফ্যাসিবাদী।
বর্তমান সময়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা মানবতাবাদী মূল্যবোধ কোনওটাই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বেপরোয়া লুণ্ঠন, শোষণ ও অত্যাচার রুখতে পারবে না। পুঁজিবাদী সমাজের মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়, অসহনীয় বেকারত্ব, একটার পর একটা দেশে ভয়াবহ যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ নর-নারী ও শিশুর হত্যাকাণ্ড, অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এই অধঃপতিত সমাজের একমাত্র বিকল্প সমাধান মার্ক্সবাদ। তাই একটা দেশে একটা যথার্থ মার্ক্সবাদী দলের নেতৃত্বে সমাজ পরিবর্তনের লড়াই ছাড়া সমাজমুক্তি অসম্ভব।
এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিলোপ ঘটেনি, ফ্যাসিবাদ পিছু হটেছে মাত্র। বিরাজমান ব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনও অ্যাজেন্ডা এই গণঅভ্যুত্থানের ছিল না। রাষ্টে্রর নানা গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি এই অভ্যুত্থান পরবর্তীতে উঠেছে। কারণ আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। এই গণতান্ত্রিক সংস্কার অপরিহার্য, তাতে দেশের গণতান্ত্রিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠান কিছুটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু তাতে ফ্যাসিবাদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ সম্ভব নয়। এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার উচ্ছেদ না ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ সম্ভব নয়। তা না হলে অনেক আত্মত্যাগের মাধ্যমে বারবার ভোটের অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার অর্জিত হবে আর গণআন্দোলনের শক্তি দুর্বল হলে, আন্দোলনের নেতৃত্ব পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের দলগুলোর হাতে থাকলে, বারবারই তা হাতছাড়া হবে। আবারও নেমে আসবে নির্মম গণতন্ত্রহীন পরিবেশ। তাই কোন পথে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন প্রকৃত অর্থেই সফল হতে পারে সেটা নির্ধারণ করা ও সে পথে সংগ্রাম পরিচালনা করা গুরুত্বপূর্ণ। এটাই আমাদের দলের কাছে ধারাবাহিকভাবে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, এরপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে আবার ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনা।
ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে আমাদের আলোচনা আমরা রাখলাম। আমরা মনে করি, সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন শ্রেণি পেশার সংগঠন ও সর্বোপরি নাগরিক সমাজের সুচিন্তিত মতামত নিয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমেই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা উচিত।
৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়। গত ৮ আগস্ট অর্থাৎ ৫ মাস আগে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। কারণ আমাদের দলও এই গণঅভ্যুত্থানের অংশীদার। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনজীবনের বিভিন্ন জ্বলন্ত সমস্যা সমাধানে যথার্থ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি। এমতাবস্থায় উল্লেখিত দাবিগুলো সরকার অবিলম্বে কার্যকর করবে বলে প্রত্যাশা করছি।
দাবিসমূহ
১. অতি সত্বর গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের প্রকৃত তালিকা প্রকাশ করতে হবে। তাদের পরিবারকে পুনর্বাসন করতে হবে। জুলাই গণহত্যার দ্রুত বিচার দিতে হবে।
২. আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে হবে। যে সকল আহতদের বিদেশে পাঠানোর জন্য রেফার করা হয়েছে, এদের ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।
৩. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সিন্ডিকেট ও বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৫. ন্যূনতম জাতীয় মজুরি ২০ হাজার টাকা ও গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা ঘোষণা করতে হবে।
৬. কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরতেহবে।বর্তমানইরিমৌসুমথেকেইফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরতেহবে।সার, বীজসহ কৃষি উপকরণের দাম কমাতে হবে।
৭. সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।