২১ জানুয়ারি, রানি রাসমণি রোডে তখন সমুদ্র-গর্জনের মতো আছড়ে পড়ছে প্রতিবাদী মানুষের স্বর। স্রোতের মতো মানুষ। সামনে রক্তিম আকাশ। ধর্মতলার মোড়ে মহান নেতা লেনিনের মূর্তির গায়েও সেই রক্তিম আলোর ছোঁয়া। শপথে, সংগ্রামে উদ্দীপ্ত মানুষের চেতনায় রাঙা হয়ে উঠেছে কলকাতার রাজপথ। এরপর এই অগণিত মানুষ, মিছিল শেষে ফিরে যাবে যে যার জায়গায়। তারা জানে, এখানেই শেষ নয়। যে লড়াই শুরু হয়েছে, তার দীর্ঘ পথ বাকি এখনও। যে দাবি উত্থাপিত হয়েছে, কালই তা পূরণ হবার নয়। যে সংগঠিত চক্র খুন করল অভয়াকে, প্রমাণ লোপাট, সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার শত চেষ্টা তারা করলেও, যত বড় ধামাই হোক, সবটা তারা ঢাকা দিতে পারেনি। তারা আইন, আদালত, পুলিশ, প্রশাসন, সিবিআই-এর মতো গোয়েন্দা সংস্থা, সবকিছুকে কিনতে পারলেও, কিনতে পারেনি মানুষের বিবেককে। এ মিছিল জানে, প্রকৃত দোষীরা কালই ধরা পড়ে শাস্তি হয়তো পেয়ে যাবে না। মজুতদার-ফাটকাবাজ-কালোবাজারিদের কারসাজিতে বেড়ে চলা জিনিসের দাম কালই কমবে না। দুর্নীতির কারবারিরা দুর্নীতি বন্ধ করে রাতারাতি সাধু হয়ে যাবে না। এ জন্য পাড়ি দিতে হবে আরও অনেক পথ। কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য আদায় করতে ঝরাতে হবে অনেক ঘাম। খেটে খাওয়া মজুর, শ্রমিকের ঝরা সে ঘামে-রক্তে বারে বারে পিছল হয়ে উঠবে এ পথ। এ তারা বেশ জানে। তবুও আজ সুদূর পাহাড় থেকে সমুদ্র এসে মিশেছে মিছিলে। লক্ষ কণ্ঠে জোরালো হয়েছে তাদের দাবি। তাদের অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবি। এক কাঁধে ব্যাগ, আর এক কাঁখে সন্তান নিয়ে মায়েরা হাঁটছে। সবচেয়ে ছোটরাও শিখে গেছে কেমন করে হাতে লাল পতাকা নিয়ে দৃপ্ত পায়ে এগিয়েযেতে হয়। কীভাবে গলা তুলে স্লোগান দিতে হয়। দাদু নাতনিকে নিজের কাঁধে তুলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ চিনিয়ে দিতে বলছেন– দেখ ভালো করে, মনে রাখ সবকিছু। কেমন করে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। প্রস্তুত হ আগামী দিনের জন্য। শক্ত কর নিজের মনকে। আগামী লড়াই তো তোদের! এ লড়াই বাঁচার লড়াই। ছাত্র, যুব, মহিলাদের স্লোগান যখন কাঁপিয়ে তুলেছে দশ দিক, রাস্তার দু’পাশে মানুষ সে উত্তাপ অন্তরে গ্রহণ করেছে। উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ কেবল নীরব দর্শক হয়ে না থেকে, নিজ উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করেছেন। এইভাবে অগণিত সাধারণ নাগরিক একাত্ম হয়েছেন এই যাত্রাপথে। আশার অভিব্যক্তি সঞ্চারিত হয়েছে তাঁদের মনে। সত্যিকার নাগরিক সমাজের মিছিলে পরিণত হয়েছে এ মিছিল।
এস ইউ সি আই (সি) দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ হেঁটেছেন এই মিছিলের সামনে। সামনের সারিতে দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এ যুগের মহান দার্শনিক, পথপ্রদর্শক কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার আলোকে আলোকিত নিশান যাঁরা সংগ্রামী চেতনায়, জ্ঞানের প্রজ্ঞায় বহন করে চলেছেন। সমাজের এই অন্ধকারের মাঝে আলোর নিশান হাতে তাঁরা অগ্রপথিক। পেছনে অগণিত কর্মী, সমর্থক, সাধারণ মানুষ। এমনও আছেন কেউ, এই প্রথম হয়তো এরকম মিছিলে তাঁর পা মেলানো। এ মিছিলে আসার আগে, কেউ হয়তো বলেছিল, কিচ্ছু হবে না। ওসব আন্দোলন-টন সব বৃথা। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। কেউ বলেছিল, আমরা হতাশ। এত মানুষের রাত দখল, সব বৃথা। কেউ কিছু করতে পারবে না। ভয় ভীতি আর টাকার কাছে সব বশ। মনের এই বাধাগুলো পেরিয়ে, কী হবে আর কী হবে না, ভাবনার এই দোলাচলকে উপেক্ষা করে তাঁরা এসেছেন এ মিছিলে। সত্য প্রতিষ্ঠা করা কি সহজ কথা? এ কথা তাঁরা অনেক মূল্যের বিনিময়ে উপলব্ধি করছেন। ধীরে ধীরে চিনছেন এই সমাজকে, সামাজিক কাঠামোকে। পুলিশ, প্রশাসন, আইন, বিচার ব্যবস্থা, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের এই স্তম্ভগুলোকে তাঁরা চিনতে পারছেন। হাহাকার আর আর্ত মানুষের অসহায় করুণ চাহনির সামনে এ মিছিল তাই সমস্ত অন্যায়ের চোখে চোখ রেখে স্পর্ধার প্রতিবাদ। আগামী দিনের আশার স্বপ্ন বহনকারী।
অনিন্দিতা জানা, মেদিনীপুর