Breaking News

শুরু আগামী আন্দোলনের প্রস্তুতি

‘মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ,

মুষ্টিবদ্ধ একটি শাণিত হাত

আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত;

বিস্রস্ত কয়েকটি কেশাগ্র

আগুনের শিখার মতো হাওয়ায় কম্পমান।’

এক সময় কলকাতা ছিল মিছিল নগরী, পিচমবঙ্গে ছিল বামপন্থী আন্দোলনের জোয়ার। জনতার দাবি নিয়ে মিছিলে শামিল হতে পারার গৌরব ধরা ছিল এমন অনেক কবিতায়। ২১ জানুয়ারি এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দলের আহ্বানে কলকাতার রাজপথ মুখরিত করল এমন হাজার হাজার মিছিলের মুখ, মুষ্টিবদ্ধ হাত, সংগ্রামী স্বপ্ন।

সকাল থেকেই হেদুয়া মোড়ের ছবিটা ছিল অন্য রকম। জমায়েতের ঘোষিত সময় বেলা বারোটার অনেক আগেই মঞ্চের চারপাশে জড়ো হয়েছেন বহু মানুষ। হেদুয়া পার্কের ধারের ফুটপাতে খবরের কাগজ পেতে অথবা মাটিতেই বসে আছেন নানা বয়সের মহিলা, পুরুষ, শিশু। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, কোচবিহার আরও অন্যান্য জেলা থেকে এসেছেন ওঁরা। রওনা দিয়েছেন কাকভোরে, অথবা আগের দিন বেরিয়ে সারারাত ট্রেনে কাটিয়েছেন, ভোরবেলা পৌঁছেছেন কলকাতায়। ক্লান্ত শরীরে ওখানেই একটু বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছেন অনেকে, কেউ কেউ টিফিন করছেন। শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মন উদ্বেল হয়ে আছে মিছিলে পা মেলানোর জন্য। কিছু খেয়েছেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে বাঁকুড়া থেকে আসা এক ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সাথে চিড়েমুড়ি এনেছি তো আমরা, কোনও অসুবিধা নেই।’ আশি ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধা এসেছেন লাঠি হাতে, যতদূর পারা যায় মিছিলে থাকবেন। অন্য একজনের হাত ধরে আসছিলেন এক দৃষ্টিহীন মহিলা। মঞ্চে তখন গান হচ্ছে, ‘শিরদাঁড়াটা ভাঙলো যে তোর, দেখ না মেয়ে নয়ন মেলে“ লক্ষ মানুষ মিছিল করে শিরদাঁড়াটা শক্ত করে’। গান কানে যেতেই নিজের মনে পরের দুটো লাইন গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন তিনি, দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে। নিজেদের ছোট বড় কষ্ট, অসুবিধা, ব্যস্ততা সরিয়ে রেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লাখো মানুষের প্রতিবাদী মিছিলে পা মেলানোর এই আবেগই এদিন মিলিয়ে দিল দার্জিলিং থেকে দত্তপুকুর, কুলতলি থেকে কোচবিহার। ৯ আগস্ট আর জি করের ভয়াবহ ঘটনার পর ১৪ আগস্ট-এর রাত রাজ্য জুড়ে যে অভূতপূর্ব গণজাগরণ দেখেছিল, তারই রেশ যেন ছড়িয়েছিল এ মিছিলের সর্বাঙ্গে। কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা নেই, বিরক্তি নেই, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নেই, আছে অনমনীয় দৃঢ়তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে পারার তেজ, সঠিক আদর্শ চিনে নেওয়ার প্রত্যয়। রাজনৈতিক দলের বত্তৃতা বা কর্মসূচি মানেই শুধু ভোটের কথা, লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতি আর অন্য দলের নামে গালিগালাজ এমনটাই দেখে অভ্যস্ত মানুষ। কিন্তু এই দলের মঞ্চ, এ দিনের মিছিল সেখানেও উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। একের পর এক বক্তা মঞ্চ থেকে বললেন, কোর্টের রায়ে হতাশ হলে চলবে না। অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন বহু দিনের স্থবিরতা ভেঙে মানুষকে গৃহকোণ থেকে রাজপথে টেনে এনেছে। কলেজে কলেজে থ্রেট কালচার নিয়ে যেটুকু সাড়া পড়েছে, যে সব মাথাদের নাম সামনে এসেছে তাও হত না আন্দোলনের জোয়ার না থাকলে। তাই আন্দোলন থামতে দিলে চলবে না, বরং তাকে আরও তীব্র আরও শক্তিশালী করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি কীভাবে শিক্ষার সর্বনাশ করবে, সাধারণ মানুষের ওপর, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার উপর কী ভয়ানক আক্রমণ নেমে আসছে, তথ্য দিয়ে দেখাচ্ছিলেন বক্তারা। বলছিলেন, জিনিসপত্রের আগুনছোঁয়া দাম, স্মার্ট মিটার চালু করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো বা মেদিনীপুরে স্যালাইন কেলেঙ্কারিতে জুনিয়র ডাক্তারদের উপর অন্যায় শাস্তি–আক্রমণ যে পথেই আসুক, সাধারণ মানুষের সামনে একটি পথই খোলা। লড়াইয়ের পথ, গণআন্দোলনের পথ। এই প্রত্যয় বুকে নিয়েই বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো মানুষ আসছিলেন মিছিলে। হেদুয়া মোড় থেকে যতদূর চোখ যায় মানুষের স্রোত, আকাশ ছেয়ে আছে লাল পতাকা, ব্যানার ফেস্টুনে। আকাশ কাঁপিয়ে স্লোগান উঠছে– ‘অভয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘বিদ্যুতের স্মার্ট মিটার চালু করা চলবে না’, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি মানছি না’। কে নেই মিছিলে? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষক অধ্যাপক গবেষক যেমন আছেন, তেমনি দলে দলে এসেছেন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। আছেন গ্রামের চাষি, কারখানার শ্রমিক, রিকশাচালক ট্যাক্সিচালক আর প্রবল ভাবে আছেন সমাজের সর্বস্তরের মহিলারা। পরিচারিকা, আশাকর্মী, গৃহবধূ, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা হিজাব পরা মুসলিম মহিলা সকলেই নিজেদের জীবনের বঞ্চনার সাথে মিলিয়ে অনুভব করেছেন অভয়ার যন্ত্রণাকে। সকলেই বুঝতে পারছেন, এই অসুস্থ সমাজ কাউকে বাঁচতে দেবে না, দাবি আদায় করতে হবে লড়াই করেই। তাঁদের আটপৌরে শাড়ির ভাঁজে, শিরা ওঠা শক্ত হাতে, জীবনযুদ্ধের ভাঁজ পড়া কপালে ছিল সেই লড়াইয়ের অদম্য তেজ। তাই বছর দুইয়ের ঘুমিয়ে পড়া শিশুকে কোলে নিয়েও অক্লান্ত হাঁটছেন মা, আবার মা-বাবার পায়ে পায়ে হাঁটছে তিন-চার বছরের বাচ্চা। পথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে গভীর আগ্রহে আর সম্ভ্রমে এই বিশাল মিছিলের উত্তাপ নিচ্ছিলেন পথচলতি সাধারণ মানুষ, গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে সাধারণ মানুষ ফুল মালা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন এই সংগ্রামী মিছিলকে। রাস্তা পার হওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলেন এক মহিলা, তাকে আরেকজন বললেন, ‘দেখছেন না কী বিরাট মিছিল? ওই মিছিলের সাথেই চলে যান।’ একজন বাইক আরোহী মিছিল নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করায় অন্য আরেকজন তাকে তিরস্কার করলেন। মিছিলের শেষ প্রান্তে দু হাতে ক্রাচ নিয়ে হাঁটছিলেন এক প্রতিবন্ধী যুবক, স্লোগান দিচ্ছিলেন সোচ্চারে। এক পথচারী অস্ফুটে বললেন, ‘সাবাস এই তো চাই’। ২১ জানুয়ারি, মহান লেনিনের প্রয়াণ দিবসে এ ভাবেই সংগ্রামী জনতার মুখরিত সখ্যে উত্তাল হল কলকাতা, শুরু হল আগামী আন্দোলনের প্রস্তুতি।