অভয়ার ন্যায়বিচার চেয়ে মানুষ বার বার বলেছে ‘রাজপথ ছাড়ি নাই’। গত ৯ জানুয়ারি ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের সংগঠনগুলির আহ্বানে শ্যামবাজার মোড়ে তাঁদের প্রতিবাদী অবস্থান মঞ্চে রাত্রিযাপনেও ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখিয়েছে– মানুষ এখনও রাস্তাতেই রয়েছেন। ২১ জানুয়ারি হেদুয়া থেকে এসপ্ল্যানেড মহামিছিলের প্রথম দাবি যখন অভয়ার ন্যায়বিচার– তাতে পা মেলানোর কথা ঘোষণা করছেন আন্দোলনে অংশ নেওয়া মানুষ। এমনকি যাঁরা কোনওদিন রাজনৈতিক মিছিলে হাঁটেননি, তাঁরাও এবার হাঁটবেন, কেউ বা মিছিলে সংহতি জানাতে পাশে এসে দাঁড়াবেন। আর জি কর আন্দোলন তাঁদের শিখিয়েছে মিছিল রাস্তা আটকায় না, বরং অনেক রাস্তা খোলার ব্যবস্থা করে দেয়। তাই মিছিলের ডাকে তাঁরা সাড়া না দিয়ে পারছেন না।
কিন্তু ভোটের সময়ে রাজপথ কাঁপানো নেতা-নেত্রীরা আজ কোথায়? যতদিন এই ন্যায়বিচারের দাবিতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ঢল নামছিল রাজপথে, তাঁরা ছিলেন নিজেদের অস্তিত্ব ভাসিয়ে রাখার ফিকির খোঁজার ব্যস্ততায়। কেউ নবান্ন অভিযান করে পুলিশের সাথে একটু ধাক্কাধাক্কি বাধিয়েই পরের দিন বনধ ডেকে দিয়ে জনগণের ক্ষোভকে ভোটের দিকে নিয়ে যেতে চাইল। আবার আর এক দলের নেতারা সরাসরি ডাক্তারদের অনশন মঞ্চেই চলে গিয়েছিলেন, টিভিতে একটু প্রচারের আশায়! এঁদের সকলেরই চেষ্টা ছিল ভোটের লক্ষ্যে আন্দোলনটা ‘দখল করার’। তাতে ব্যর্থ হয়ে তাঁরা কৌশলে বাণী ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন– দলের ঝান্ডা ওড়াতে না দিয়েই জনগণ বড় ভুল করে ফেলল। না হলে বোধহয় তাঁরাই গিয়ে সব খুনিকে ধরে দিতেন! অন্য দিকে রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস তাদের দুর্নীতিচক্রের পাণ্ডাদের বাঁচাতে একদিকে চেষ্টা করে গেছে গ্রেফতার হওয়া সিভিক ভলান্টিয়ারের ঘাড়ে পুরো কোপটা মেরে বড় মাথাদের নামটা তদন্ত থেকে মুছে দিতে। এ ব্যাপারে তারা কেন্দে্রর শাসক দলের সাহায্যটাও পেয়ে গেছে। কারণ সিবিআই যদি এ রাজ্যে আর জি কর-এ খুন-ধর্ষণের মামলায় মূল চক্রীদের এবং দুর্নীতি চক্রের মাথাদের শাস্তি-বিধানের মতো করে তদন্ত করতে পারে তা হলে বিজেপি-শাসিত অন্য রাজ্যেও একের পর এক ধর্ষণ, খুন ও দুর্নীতির মামলায় সঠিক তদন্তের দাবিতে মানুষ একই রকম ভাবে রাস্তায় নামবে, যার চাপ সামাল দেওয়া বিজেপি সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বিজেপি সরকার তাদের খাঁচার তোতা সিবিআইকে রাজ্য পুলিশের তৈরি করা কাগজে হাত বুলানো ছাড়া অন্য কিছু করতে দেয়নি। অন্য দিকে স্বাস্থ্য দুর্নীতির গভীরতা এতদূর ছড়িয়ে যে, এতে টান পড়লে এর সাথে জড়িয়ে থাকা কর্পোরেট হাসপাতাল-ওষুধ-চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবসার জগতের বহু মাথাতেও টান পড়ার সম্ভাবনা। শাসকদলগুলো এদের প্রসাদভোগী হওয়ায় বিচার আরও অধরা হচ্ছে। শাসকের মনোভাব থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস,বিজেপি কিংবা নানা সময় গদিতে থাকা দলগুলো সিদ্ধান্ত করে থাকে– জনগণই শেষ কথা বলে, এটি একটি কথার কথা মাত্র! আসলে ওনারাই জনগণের অভিভাবক, তাঁরা যেমনটি বলে দেবেন, তেমন তেমন করে যাওয়াই জনগণের কাজ। ঠিক এই সিদ্ধান্তটাকেই আঘাত করেছে আর জি কর আন্দোলন। তাই এই নেতারা টিভি চ্যানেলের ঘেরাটোপে আর বিবৃতির মোড়কে ফিরে গেলেও জনগণ কিন্তু থেকেছেন রাস্তাতেই।
কলকাতা পুলিশের কাগজে হাত বুলিয়ে তাতেই সিলমোহর দিয়ে সিবিআই যে প্রকৃত তদন্তকে এড়িয়ে যেতে চাইছে, তা মানুষের কাছে আজ পরিষ্কার। তদন্ত আদায় করতেই হবে, এই দাবিকেই তুলে ধরবে ২১ জানুয়ারির মহামিছিল। এই মিছিলের ডাক দিয়েছে এসইউসিআই(সি)। যে দলগুলো মানুষকে দেখে নিছক ভোটার হিসাবে, যে দলগুলো আন্দোলনকে ভাবে নিছক গদি দখলের সিঁড়ি, তাদের সাথে এস ইউ সি আই (সি)-র আন্দোলন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আকাশ আর পাতালের। এই দলের দৃষ্টিতে গণআন্দোলন জনগণের নিজস্ব শক্তি তৈরির একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। গণআন্দোলনের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠতে পারে জনগণের নিজস্ব মতপ্রকাশ ও তাকে প্রয়োগ করার যথার্থ হাতিয়ার গণকমিটি। এস ইউ সি আই (সি) ৯ আগস্ট থেকেই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থেকেছে। ঘটনার কথা জানামাত্র ছুটে গেছেন যেমন ওই কলেজের ডিএসও কর্মীরা, তেমনই কলেজের প্রাক্তনী ও ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনের সদস্যরা সেদিনই দলের পক্ষ থেকে টালা থানায় ডেপুটেশন দিয়েছেন, দলের গণসংগঠনগুলিও ওই দিন থেকেই রাস্তায় নেমেছে। ১৪ আগস্ট আর জি কর হাসপাতালে প্রমাণ লোপাটের জন্য যে পরিকল্পিত আক্রমণ চলেছিল তার বিরদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ ধ্বনিত করতে ১৬ আগস্ট বাংলা জুড়ে সাধারণ ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়েছে। এই আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে জড়িয়ে থেকেছেন দলের নেতা থেকে কর্মীরা, কিন্তু কখনওই আন্দোলন দখল করে নিজেদের মুখ দেখানোর প্রতিযোগিতায়, কিংবা গদির স্বার্থে আন্দোলনকে কানাগলিতে টেনে নিয়ে যাওয়ার অসুস্থ কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে ঘৃণা বোধ করেছে। আর জি কর আন্দোলন যে এভাবে ফেটে পড়তে পেরেছে তার অন্যতম কারণ হল, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় জেরবার সাধারণ মানুষের সম্মিলিত ক্ষোভের অভিঘাত।
কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের শিক্ষানীতির ফলে শিক্ষার অঙ্গন থেকে সাধারণ ঘরের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্রমাগত দূরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধি এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে মানুষের জীবনকে। কৃষকের হাহাকার, বেকার যুবক-যুবতীদের হাহাকার দেখে যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষ। অথচ স্কুলশিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বত্র নিয়োগ নিয়ে চলছে সীমাহীন দুর্নীতি। স্থায়ী চাকরির বিষয়টা কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই প্রায় তুলে দিচ্ছে। নারীর ওপর নির্যাতন-ধর্ষণ-খুন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনায় পর্যবসিত। এ ব্যাপারে একেবারে দুধের শিশু থেকে বৃদ্ধা কারও যেন রেহাই নেই! এই পরিস্থিতিতে এখন প্রয়োজন সর্বাত্মক গণআন্দোলনের জোয়ার। যে কারণে আর জি কর আন্দোলন চলতে চলতেই ২১ জানুয়ারি এই মহামিছিলের ডাক দিয়েছে এস ইউ সি আই (সি)। দিনটা মহান লেনিনের ১০২তম প্রয়াণ দিবস। যে লেনিন সারা দুনিয়ার খেটে খাওয়া মানুষকে, শাসকদের পায়ের তলায় থাকা মানুষকে, নিজ অধিকার বুঝে নেওয়ার পথ দেখিয়েছেন, সেই মহান নেতার মৃত্যুর দিনটি খেটে খাওয়া মানুষের কাছে শোষণ মুক্তির লড়াইতে শামিল হওয়ার শপথ নেওয়ার দিন। এই দিনটিতেই মহা মিছিলের ডাক স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সেই শপথের কথা।
মানুষ দেখেছে প্রাথমিকে ইংরেজি ও পাশ ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলনে, পরবর্তীকালে বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, বিদ্যুৎ গ্রাহকদের আন্দোলন সহ নানা ক্ষেত্রে মূল শক্তি হিসাবে কাজ করেছে এবং এখনও করে চলেছে এস ইউ সি আই (সি) দল। কিন্তু কোনও দিন আন্দোলন দখলের চেষ্টা এ দল করেনি। তাই দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসে এক-একটা আন্দোলনের গণকমিটিতে স্বকীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন এবং আজও করে চলেছেন। এটাই আন্দোলনের শক্তিকে গড়ে তোলে। তাই ২১ জানুয়ারির মহামিছিলের ডাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিচ্ছেন কোনও দল না করা, এমনকি অন্য দলের সাধারণ সমর্থকরাও। মিছিলে কোনও দিন হাঁটেননি, আপাত অর্থে রাজনীতির গণ্ডি থেকে দূরে, এমন মানুষও এই মিছিল একটি রাজনৈতিক দলের ডাকে হবে জেনেও আসবার জন্য কথা দিচ্ছেন। কারণ একটা বিষয় তাঁদের ছুঁয়ে যায়– এই দলের গণআন্দোলনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজবদলের রাস্তায় চলা রাজনীতির সাথে অন্যদের আখের গোছানোর রাজনীতির সুস্পষ্ট পার্থক্য। এই রাজনীতির সংস্পর্শে আসা মানুষগুলো যে সংস্কৃতিতে, দেহ-মনে একটা নতুন মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার সংগ্রামে লিপ্ত, তার ছাপ পড়ে তাদের আচার-আচরণ-চলনে, যা মানুষকে ভাবায়। কেউ এমনও বলছেন, হাঁটতে না পারি পাশে গিয়ে দাঁড়াবো, নিজের থেকে জানতে চাইছেন, টাকা লাগবে তো তোমাদের– সাধ্যমতো সাহায্য দিচ্ছেন তাঁরা।২১ জানুয়ারি তাই যে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় হাঁটবেন, স্লোগানে গলা মোলাবেন উচ্চকণ্ঠে, তাঁরা নিছক মিছিলের ভিড় নন, তাঁরা প্রত্যেকেই বিচার ছিনিয়ে আনার দাবির অটল সৈনিক। তাঁদের স্লোগানের উচ্চারণ এতটাই বলিষ্ঠ, এতটাই নিশ্চিত যে তা সব শাসককেরই ঘুম কাড়ে। ‘বিচার না দিয়ে নিস্তার পাবে না শাসক’–জনগণ জানিয়ে দিয়ে যাবে ২১-এর মহামিছিলে।