সঠিক নেতৃত্বে আপসহীন লড়াই-আন্দোলনই যে দাবি আদায়ের একমাত্র রাস্তা– আবারও প্রমাণ করলেন কর্ণাটকের আশাকর্মীরা। এআইইউটিইউসি অনুমোদিত কর্ণাটক রাজ্য সংযুক্ত আশাকর্মী সংঘের আহ্বানে আশাকর্মীরা রাজ্য জুড়ে ধর্মঘট ও চারদিন ধরে বিক্ষোভ অবস্থান চালিয়ে উদাসীন সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নিলেন তাঁদের দীর্ঘদিনের অপূরিত দাবি। আন্দোলনের হার না মানা মেজাজ দেখে ১০ জানুয়ারি বাঙ্গালোরের ফ্রিডম পার্কে আশাকর্মীদের অবস্থানস্থলে এসে রাজ্যের স্বাস্থ্য কমিশনার ঘোষণা করলেন, আগামী এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা সাম্মানিক দেওয়া হবে তাঁদের। বাড়তি দায়িত্বের জন্য দেওয়া হবে অতিরিক্ত উৎসাহভাতা এবং গুরুতর অসুস্থতা ঘটলে তিন মাসের সবেতন ছুটি। তিনি জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী আগামী দিনে আশাকর্মীদের অবসরকালীন প্রাপ্য নিয়ে বিবেচনারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ফ্রিডম পার্কে তখন উচ্ছ্বাসের ঝড়। বহু আকাঙিক্ষত জয়ে আন্দোলনকারীদের আনন্দধ্বনিতে ভেসে যাচ্ছে সমাবেশস্থল। মুহূর্মুহূ স্লোগান উঠছে– ইনকিলাব জিন্দাবাদ, এআইইউটিইউসি জিন্দাবাদ।
সারা দেশের মতোই কর্ণাটকে আশাকর্মীরা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের মতোই সেখানেও তাঁদের উপর শোষণ-নিপীড়নের কমতি নেই। মাসিক মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনে বছরের পর বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে গেছেন তাঁরা। মেলেনি সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতি। কোভিড অতিমারির সময়ে আশাকর্মীদের অসমসাহসী ভূমিকার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। অথচ মর্যাদা মেলেনি। আকাশছোঁয়া বাজারদরের এই দুঃসময়ে কোনও সরকারি দল ও মন্ত্রীই আশাকর্মীদের ভাতা একটু বাড়ানোর কথা মনেও আনেননি। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে এআইইউটিইউসি অনুমোদিত কর্ণাটক রাজ্য সংযুক্ত আশাকর্মী সংঘের নেতৃত্বে বছরের পর বছর ধরে লড়াই হয়েছে। অবশেষে দাবি আদায়ের শেষ অস্ত্র হিসাবে তাঁরা লাগাতার ধর্মঘটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৭ জানুয়ারি থেকে গোটা কর্ণাটক জুড়ে ধর্মঘট শুরু করেন ২৫ হাজারেরও বেশি আশাকর্মী। বাঙ্গালোরের ফ্রিডম পার্কে ওই দিন থেকেই তাঁরা শুরু করেন লাগাতার বিক্ষোভ অবস্থান। প্রবল শীত উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে টানা অবস্থান চলতে থাকে। রাতেও ফ্রিডম পার্কের খোলা মাঠেই থাকেন তাঁরা। অনেকেরই সঙ্গে ছিল শিশুসন্তান। দাবি আদায়ের কঠিন প্রতিজ্ঞায় প্রবল ঠাণ্ডায় বাচ্চাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কাকে হেলায় দূরে ঠেলেছেন আশাকর্মী মায়েরা।
প্রথম থেকেই রাজ্যের সাধারণ মানুষ এসে দাঁড়িয়েছিলেন এই আন্দোলনের পাশে। অবস্থানে দিনে দিনে সংখ্যা বেড়েছে আশাকর্মীদের। সামিল হয়েছেন কৃষক-শ্রমিক-অটোচালক, মহিলা-ছাত্র-যুব সহ সবস্তরের মানুষ। আন্দোলনকারীদের জন্য রান্না করা খাবার জুগিয়েছেন তাঁরা, বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। পার্কের পাশেই ছিল মেডিকেল ক্যাম্প, যাতে অসুস্থতা সমস্যা হয়ে না দাঁড়াতে পারে।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিক্ষোভ সমাবেশে সামিল হয়েছিলেন রাজ্যের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ত্ব। এসেছিলেন প্রখ্যাত কন্নড় লেখক ও অধিকার-রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আল্লামাপ্রভু বেট্টাদুরু। ছিলেন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ভি পি নিরঞ্জনারাধ্যা, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এবং কর্ণাটকের প্রাক্তন লোকায়ুক্ত সন্তোষ হেগড়ে, সমাজকর্মী এস আর হিরেমাথ, সমাজমুখী পত্রিকা সম্পাদক চন্দ্রকান্ত ভাড্ডু প্রমুখ। এঁরা সকলেই আশাকর্মীদের ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। সমাবেশস্থলে বিক্ষোভকারী আশাকর্মীদের পাশে উপস্থিত হয়েছিলেন এআইইউটিইউসি-র সর্বভারতীয় সভাপতি কে রাধাকৃষiর, আশাকর্মী সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক ডি নাগলক্ষ্মী ও রাজ্য সভাপতি সোমশেখর ইয়াদগিরি, রাজ্য সহ-সভানেত্রী রমা টিসি প্রমুখ। দাবি আদায়ে অটল আশাকর্মীদের আহ্বান জানিয়ে কে রাধাকৃষ্ণ বলেন, ইতিহাস সাক্ষী, আত্মত্যাগ ছাড়া কোনও সংগ্রামই সফল হতে পারেনি। তাই, যত বাধাবিপত্তিই আসুক, যতদিন না জয় অর্জিত হয় লড়াই আপনাদের চালিয়ে যেতে হবে। এসইউসিআই(সি)-র কর্ণাটক রাজ্য সম্পাদক কে উমা আশাকর্মীদের সামনে বক্তব্য রাখেন।
অবশেষে ১০ জানুয়ারি কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য দফতরের অফিসারদের পাশে নিয়ে তাঁর নিজের বাড়িতে আশাকর্মী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। বৈঠকে আশাকর্মী সংগঠনের প্রতিনিধিদলে ছিলেন সভাপতি সোমশেখর ইয়াদগিরি, রাজ্য সম্পাদক ডি নাগলক্ষ্মী এবং শিক্ষাবিদ ভি পি নিরঞ্জনারাধ্যা। বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী দাবিগুলির যৌক্তিকতা স্বীকার করে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন সহ অন্যান্য দাবিগুলি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। কর্ণাটকের আশাকর্মীদের এই ঐতিহাসিক জয়ের পিছনে রয়েছে সঠিক নেতৃত্বে তাঁদের ঐক্যবদ্ধ ও লাগাতার দীর্ঘ লড়াই এবং প্রভূত বাধাবিঘ্ন ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করে দাবি আদায়ের সংগ্রামী জেদ। শুধু দাবি আদায়ই নয়, এই লড়াইয়ে আন্দোলনকারী আশাকর্মীদের অদম্য মনোবল গোটা দেশের মেহনতি মানুষের কাছে প্রেরণা হিসেবে থেকে গেল।
শোষণমুক্তির সংগ্রামে ন্যায়বিচার ছিনিয়ে আনার একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হিসাবে রয়ে গেল ফ্রিডম পার্কে ধর্মঘটী আশাকর্মীদের বিক্ষোভ অবস্থানের দিনগুলি। আশাকর্মীদের মতোই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষ একই রকম শোষণ-অবিচারের শিকার। এই আন্দোলন তাঁদেরও আপসহীন লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা জোগাবে।