Breaking News

নিউ ন্যাশনাল পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক অন এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং: পিছনের দরজা দিয়ে আবার  তিন কালা কৃষি আইন চালুর চেষ্টা

প্রবল ঠাণ্ডা ও গ্রীষ্মের দাবদাহকে অগ্রাহ্য করে দিল্লিতে লক্ষ লক্ষ কৃষক তেরো মাসব্যাপী ঐতিহাসিক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করেছিলেন। এই সংগ্রামে ৭৫০ জন কৃষক আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তাঁরা স্পষ্ট বুঝেছিলেন, বিজেপি সরকার প্রবর্তিত তিন কালা কৃষি আইন তাঁদের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনবে– তাই যে কোনও মূল্যে তা প্রতিরোধ করতেই হবে। তাঁদের অদম্য তেজ ও সংগ্রামে বিজেপি সরকার পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল। তিন কালা কৃষি আইন প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের চাপে আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেও বিজেপি সরকার তাদের পরিকল্পনা ত্যাগ করেনি। তারা নানা কায়দায় তাদের কর্পোরেট প্রভুদের সেবা কাজ চালিয়ে গিয়েছিল। এখন তারা আবার নতুন বোতলে পুরোনো মদিরা পরিবেশন করছে। ‘ন্যাশনাল পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক অন এগ্রিকালচার মার্কেটিং’– এই শিরোনামের আড়ালে কৃষকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত সেই তিন কালা কৃষি আইন ফিরিয়ে আনার হীন চেষ্টা চালাচ্ছে।

 জাতীয় কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রণালয় গত ২৫ নভেম্বর কৃষি বিপণন সম্পর্কে নতুন জাতীয় নীতির খসড়া প্রকাশ করেছে। এই নীতির উদ্দেশ্য কী? খসড়ায় বলা হয়েছে, দেশের মধ্যে এমন একটা সতেজ বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার যেখানে সমস্ত কৃষক তার কৃষিপণ্য সর্বোচ্চ দামে বিক্রি করার জন্য পছন্দমতো বাজার পাবে (অনুচ্ছেদ-২)। এই বিপণন ব্যবস্থা কী ভাবে পরিচালিত হবে? বলা হয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি– এই দুইয়ের অংশগ্রহণে যৌথভাবে এটি পরিচালিত হবে। তাই কৃষি বিপণন আইন ও নীতির সংস্কার এই উদ্দেশ্য পূরণের সহায়ক হবে। (অনুচ্ছেদ ৩.২)

কৃষিতে বহুজাতিক পুঁজির অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা

দেখা যাক, এই উদ্দেশ্যে তারা কৃষি বিপণন আইন ও নীতির কী ধরনের সংস্কার করতে চাইছে? এবং এর দ্বারা তারা কী ধরনের ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে?

খসড়ায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ব্যক্তি মালিককে পাইকারি বাজার খোলার অনুমতি দেওয়া হবে। (অনুচ্ছেদ-৭.১.,৩.১) খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা, রপ্তানিকারী সংস্থা, সংগঠিত খুচরো বিক্রেতা সংস্থা, যারা একসাথে অনেক কৃষিপণ্য ক্রয় করে, তাঁদের মাঠ বা জমি থেকে সরাসরি কৃষিপণ্য ক্রয় করার অনুমতি দেওয়া হবে (অনুচ্ছেদ-৭.১,৩.৪)। কৃষি বিপণনে ব্যক্তিগত ‘ই-ট্রেডিং’ (অনলাইন-ব্যবসা) সংস্থা স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হবে। অর্থাৎ, সর্বত্রই বহুজাতিক পুঁজিকে প্রবেশের অবাধ সুযোগ করে দেওয়া হবে। তা হলে আগের কৃষিনীতির সঙ্গে এর কোথায় পার্থক্য? আগের নীতির সঙ্গে আরও কিছু সংস্কার পরিকল্পনা যোগ করা হয়েছে যা এই বিপণন ব্যবস্থায় দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে সাহায্য করবে।

এমএসপি আইনসিদ্ধ করার সম্বন্ধে একটি শব্দও নেই

অত্যন্ত পরিহাসের বিষয়, নূতন কৃষি বিপণন নীতি সংক্রান্ত এই পরিকল্পনায় এমএসপি-কে আইনসিদ্ধ করা সম্পর্কে একটি কথাও বলা হয়নি। অথচ এটাই দেশে কৃষকদের সর্বপ্রধান দাবি। ফড়েদের, মধ্যসত্বভোগী বা মিডলম্যানদের, বহুজাতিক পুঁজির শোষণ থেকে রেহাই পেতে গেলে এই আইনটা অত্যন্ত জরুরি। পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস বিজেপি সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা পুরোপুরি অস্বীকার করছে।

এই নীতিতে চুক্তি চাষ চালুর লক্ষ্যে বলা হয়েছেঃ চুক্তি চাষ, বাজার ও বাজারে দামের ঝুঁকি সংক্রান্ত বিষয়ে তদারক করার একটা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে (অনুচ্ছেদ ১০.১.১)। আরও বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার আদলে বিমা প্রকল্প পরিচালিত হবে (অনুচ্ছেদ ১০.১.৩)।

গ্রামীণ হাটগুলি চলে যাবে বহুজাতিক পুঁজির দখলে

 বর্তমানে আমাদের দেশে এপিএমসি (এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি) আইনের অধীনে ৭০৫৭টি সংগঠিত পাইকারি বাজার আছে। এ ছাড়া ৫০০ অনিয়ন্ত্রিত এবং ২২৯৩১টি গ্রামীণ হাট আছে। গ্রামীণ হাটগুলি মূলত গ্রামীণ পুঁজিপতিরা নিয়ন্ত্রণ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই আমাদের দেশের কৃষকরা যে সব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা বাজারের অভাব। অর্থাৎ একটা প্রকৃত বিপণন ব্যবস্থা যেখানে কৃষকরা তাদের উৎপন্ন ফসল লাভজনক দামে বিক্রি করতে পারবে। সেই ব্যবস্থা না থাকার ফলে কৃষকরা উৎপাদন খরচের চেয়েও অনেক কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই ভাবেই তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার বেদনাদায়ক পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

কৃষিপণ্য বিক্রি করার এই প্রক্রিয়ায় প্রায়শই ঋণদাতারা কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। এই কৃষি বিপণন প্রক্রিয়ায় দালালদের নানা ধাপের ব্যবস্থা এত বিশাল যে, কৃষকরা তাদের কৃষিপণ্যের বিক্রয়মূল্যের খুব কম অংশই পায়। দেখা গেছে, চালের ক্ষেত্রে কৃষক বিক্রয়মূল্যের মাত্র ৫৩ শতাংশ পায়, এই প্রক্রিয়ায় দালালরা পায় ৩১ শতাংশ আর অবশিষ্ট ১৬ শতাংশ যায় বিপণন খরচ হিসাবে। সবজি ও ফলের ক্ষেত্রে কৃষকের অংশ আরও কম। সবজিতে কৃষক পায় বিক্রয় মূল্যের ৩৯ শতাংশ এবং ফলের ক্ষেত্রে ৩৪ শতাংশ। এখানে বিপণন প্রক্রিয়ার দালালরা পায় যথাক্রমে ২৯.৫ শতাংশ এবং ৪৬.৫ শতাংশ। এই বিপণন প্রক্রিয়ার মধ্যবর্তী ফড়িয়ারা হল গ্রাম্য ব্যবসায়ী, দালাল, পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরো ব্যবসায়ী ইত্যাদি।

 এপিএমসি আইন অনুযায়ী, কৃষকরা এপিএমসি ইয়ার্ডে তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করত লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের কাছে। এই এপিএমসি বা কৃষিপণ্য মার্কেটিং কমিটি কৃষকদের দ্বারা নির্বাচিত একটি সংস্থা। এর মানে এই সংস্থা যে কৃষকদের স্বার্থ যথেষ্ট পরিমাণে রক্ষা করত, তা নয়। তবুও লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের ওপর এই সংস্থার একটা নিয়ন্ত্রণ ছিল। তাই নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা খানিকটা ভারসাম্য রক্ষা করতে পারত।

কিন্তু ১৯৯১-এ বিশ্বায়ন-উদারিকরণের নীতি অনুযায়ী তৎকালীন কংগ্রেস সরকার মনমোহন সিংহের পরিকল্পনার হাত ধরে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন যুক্তি করা হয়েছিল, এই ব্যবস্থা কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং তারা মুক্ত ও সংগঠিত খুচরো বাজারে সরাসরি তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারবে। এর ফলে তারা কৃষি প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় স্বচ্ছন্দে কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারবে এবং বিপণন ব্যবস্থার তথ্য বিনিময় ও গ্রহণের সুযোগ নিয়ে তারা লাভবান হবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছিল ঠিক উল্টো। কংগ্রেস সরকার এপিএমসি আইন পাল্টে ব্যক্তি পুঁজির হাতে কৃষিপণ্য সংগ্রহের আইনি অধিকার দিয়ে দেয় এবং চুক্তি চাষকে আইনসিদ্ধ করে। এইভাবে কৃষিতে একচেটিয়া পুঁজির অনুপ্রবেশের পথ আরও প্রশস্ত হয়।

বিজেপি সরকার কেন্দে্র ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেসের দেখানো সেই পথই অনুসরণ করে আরও জোরকদমে তা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে কৃষকদের দুর্দশা আরও বাড়ছে। তারা এখন সমস্ত কৃষিপণ্য– চাল, গম, ডাল, সিr, তৈলবীজ, দুধ, মাংস এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা রচনা করে ‘ন্যাশনাল পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক অন এগ্রিকালচারাল মার্কেটিংক্স শিরোনামে নিয়ে এসেছে। এই লক্ষ্যেই আধুনিকীকরণের নাম করে তারা এপিএমসি-র মাধ্যমে যে কৃষিবিপণন ব্যবস্থা বর্তমানে আছে তার সমস্তটাই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাতে তুলে দিতে চাইছে। গ্রাম ভারতে যে ২৯ হাজারের বেশি হাট আছে তার পরিচালন-ব্যবস্থার উপর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এর ফলে গ্রামস্তর পর্যন্ত কৃষিপণ্য ও তার বিপণন ব্যবস্থার সামগ্রিক ও সর্বাত্মক বেসরকারিকরণ এবং বৃহৎ পুঁজির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম হবে।

কৃষকরা কি কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ চেয়েছিল? না। কারণ তারা জানে এই বেসরকারিকরণ তাদের জীবনকে ধ্বংস করে দেবে। কৃষি উপকরণের ক্ষেত্রে অর্থাৎ রাসায়নিক সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদির ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের অভিজ্ঞতা হল, এর ফলে ভয়ানক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, যার বোঝা চাষির পক্ষে বহন করা অসম্ভব।

 বিজেপি সরকারের কৃষি বিপণন নীতির মারাত্মক কিছু বৈশিষ্ট্য

কৃষকদের উৎপন্ন করা কাঁচামাল খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, ব্যবসায়ী সংস্থা এবং রপ্তানিকারক সংস্থা নিয়ন্ত্রিত বাজারে আসে। কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী এই শক্তিগুলোই বাস্তবে বাজারে কৃষিপণ্যের দাম কী হবে তা নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করে। কোনও সরকার কৃষককে তার উৎপন্ন ফসলের লাভজনক দাম দিতে চাইলে সেই সরকারকে অবশ্যই এই শক্তিগুলোর উপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং কৃষককে লাভজনক দাম দেওয়ার জন্য তাদের বাধ্য করতে হবে। কিন্তু এই কাজ করা তো অনেক দূরের কথা, সরকার কৃষি বিপণন নীতির পরিকল্পনায় এমন সব বিধান দিয়েছে যাতে কৃষককে ঠকানোর এই শক্তিগুলো আরও বলবান হবে।

দ্বিতীয়ত, এই দলিলে এমন সব প্রস্তাব রাখা হয়েছে যাতে কৃষিপণ্যের সমগ্র বিপণন ব্যবস্থাটি অর্থাৎ কৃষকের জমি থেকে একেবারে কোম্পানির গুদামঘর পর্যন্ত এমনকি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র পর্যন্ত সবটাই সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্বের (পিপিপি) আদলে পরিচালিত হবে। এতে সমগ্র খাদ্যসামগ্রী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে মুনাফা করবে। কৃষক সহ সাধারণ মানুষ অনেক বর্ধিত দামে তাদের থেকে তা কিনতে বাধ্য হবে এবং আর্থিক সংকটে পড়বে।

তৃতীয়ত, এই নীতিতে এমন প্রস্তাবও আছে যাতে বেসরকারি ক্ষেত্রে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের ব্যবসার ক্ষেত্রে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণমুক্ত ভাবে উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণনের উপর প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যাতে কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো (এফপিও) বিপণন ব্যবস্থায় ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের ছাড়াই বহুজাতিক কোম্পানিগুলির কারখানায়, ব্যবসায় এবং রপ্তানির জন্য প্রত্যোশিত এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল নির্বিঘ্নে সরাসরি যোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করতে পারে।

চতুর্থত, কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে কৃষিপণ্যের ভবিষ্যৎ বাণিজ্য (ফরোয়ার্ড ট্রেডিং) এবং শেয়ার বাজারের প্রবেশদ্বার যাতে সহজে খুলে যায় এই সংস্কার প্রস্তাবে সেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশীয় কৃষি ও খাদ্য প্রস্তুতকারক কারখানাগুলোর উপর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার রাস্তা আরও প্রশস্ত হবে। এর ফল মারাত্মক। কৃষকরা আরও বেশি করে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে, সব কিছু হারিয়ে তারা পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হবে, বেকারত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষকের আত্মহত্যা আরও বাড়বে। কৃষক ও খেতমজুরের সাথে সাধারণ জনগণের দুঃখ দুর্দশা বহুগুণ বেড়ে যাবে।

পঞ্চমত, এই সংস্কারে প্রস্তাব করা হয়েছে, ‘চুক্তিচাষ বাজার ও দামের ঝুঁকি নিরসনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। (অনুচ্ছেদ-১০.১.১)

এটি একটি ভয়ঙ্কর প্রস্তাব। মূল প্রশ্ন, কার সাথে কার চুক্তি? এই চুক্তির একদিকে আছে প্রচুর আর্থিক ক্ষমতায় বলীয়ান বিশাল বিশাল বহুজাতিক কোম্পানি, যাদের সরকারি প্রক্রিয়ার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। অন্য দিকে আছে আর্থিকভাবে দুর্বল গরিব ও প্রান্তিক কৃষক। দৈত্যাকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো হল ক্রেতা আর ক্ষুদ্র চাষি হল উৎপাদক ও বিক্রেতা। এ ক্ষেত্রে চুক্তি বাস্তবে বহুজাতিক কোম্পানির পক্ষেই যায়, এটাই কৃষকদের অভিজ্ঞতা। বাস্তবে কৃষকরা বহুজাতিক কোম্পানিগুলির চুক্তির ফাঁদে একবার আবদ্ধ হয়ে গেলে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন।

ষষ্ঠত, এই সংস্কার প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার আদলে একটি বিমা প্রকল্প চালু করা হবে। বিচার করে দেখতে হবে, এত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যে ফসল বিমা যোজনা চালু করা হয়েছে তাতে এ পর্যন্ত কার লাভ হয়েছে? কৃষকের নয়, এতে লাভ হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর। বিমায় বাস্তবে কৃষকের দুঃখ নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানি ব্যবসা করে। সমস্ত তথ্য ও প্রতিবেদন থেকে এটা নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো লাভবান হয়েছে, তাদের সমৃদ্ধি বেড়েছে। অভিযোগ যে, বিমা কোম্পানিগুলো বিমা বাবদ দেওয়া অর্থের ৯৭ শতাংশ আত্মসাৎ করেছে। বাস্তবে ফসল বিমায় ক্ষতিপূরণের জন্য কৃষকদের দাবির মাত্র ৬.৬১ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, মাত্র বারো টাকা দিয়ে ক্ষতিপূরণের দাবি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। সুতরাং খুব সহজেই এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, এই বিমা যোজনাও বিশ্বায়ন অর্থনীতির আরেকটা মুখোশ, যা জনসাধারণের করের টাকায় ‘কৃষক-বন্ধুরক্স আলখাল্লা পরে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলির পেট ভর্তি করবে।

কর্পোরেটরা এলে কী ক্ষতি

এই যে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, এতে ব্যাপক সংখ্যায় কৃষক ধ্বংস হয়ে ভূমিহীন মানুষে পরিণত হবে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং দোকানদার বাজার থেকে বিতাড়িত হবে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলি সমস্ত খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। যার ফলে সমস্ত জিনিসের দাম ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে। এর বিপর্যয়কারী পরিণতির কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

ইতিমধ্যেই আদানি কোম্পানি হিমাচলপ্রদেশে কৃষকের কাছ থেকে ১৮ টাকা কেজি দরে আপেল কিনে সেই আপেল দিল্লিতে বিক্রি করেছে কেজি প্রতি ২৪০ টাকায়। এই বছর কা¬ীরে আপেল চাষিরা ২৫ কেজি আপেলের প্যাকেট বিক্রি করেছে ৪৫ টাকায়। ক্রেতা আদানি কোম্পানি। বাজারে এই কা¬ীরী আপেল কী দামে বিক্রি হয় তা মানুষ জানেন। কেন্দে্রর বিজেপি সরকার এইভাবে কৃষকের সর্বনাশের বিনিময়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির স্বার্থ রক্ষা করে যেতে চাইছে।

 খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য কেন জরুরি

খাদদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সর্বাত্মক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য– এর প্রকৃত অর্থ কী? এর দুটো অংশ আছে। প্রথমত, এমএসপি-কে আইনসঙ্গত করে সমস্ত কৃষিপণ্য সরকারকে কৃষকের কাছ থেকে উৎপীদন খরচের অন্তত দেড়গুণ অর্থাৎ C২+৫০% দামে কিনতে হবে।

দ্বিতীয়ত সাধারণ জনগণ যে দামে কিনতে পারে তেমন সস্তা দামে খাদ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরকারকে গণবণ্টন ব্যবস্থার (পিডিএস) মাধ্যমে জনগণের কাছে বিক্রি করতে হবে। এর জন্য কিছু ভর্তুকির প্রয়োজন হলে সরকারকে অবশ্যই তা দিতে হবে। কারণ, একটা সভ্য সরকারের প্রাথমিক কাজ হল তার নাগরিকদের খাবারের সংস্থান করা, মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করা নয়। কিন্তু কেন্দে্রর ক্ষমতাসীন সরকার জনগণের জন্য তা করতে রাজি নয়। পূর্বতন কংগ্রেস সরকারও তা করেনি এবং এখন কেন্দে্রর বিজেপি সরকারও করছে না। বরং মোদি সরকার বর্তমান বিপণন ব্যবস্থা ধ্বংস করে সামগ্রিকভাবে কৃষিক্ষেত্রটি বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছে।

এই সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করা কি অসম্ভব কাজ? জনগণের স্বার্থ ভাবলে এটা অসম্ভব নয়। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়ও তা করা সম্ভব। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য কেন্দে্রর বিজেপি সরকার অনেক মিথ্যা যুক্তির অবতারণা করেছে। তারা বলছে, এমএসপি চালু করতে প্রচুর টাকা লাগবে। সরকারের কোষাগারে অত টাকা নেই। এই রকম একটা অর্থনৈতিক সংকটের সময় এত টাকা ব্যয় করা কি সম্ভব? সরকারের এই সব কথায় একদল মানুষ বিভ্রান্তও হচ্ছেন। তারা আরও বলছে, সরকার যদি সমস্ত কৃষিদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী C২+৫০% হারে ক্রয় করে, তা হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অনেক বেড়ে যাবে, যার ফলে সাধারণ জনগণ প্রচণ্ড সমস্যার মধ্যে পড়বে। সুতরাং যারা এমএসপি চালু করার পক্ষে ওকালতি করছে তারা সাধারণ জনগণ এবং শ্রমিক বিরোধী কাজ করছে।

সরকারের কুযুক্তি

সরকারের যুক্তিগুলো এক এক করে বিচার করে দেখা যাক। খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর দাম হু-হু করে বাড়ছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে এর বিষময় প্রভাব দেশের মানুষ জীবনে অনুভব করছে। কিন্তু এই মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে কেন? কেন শিল্পজাত দ্রব্যসামগ্রীর দাম লাফিয়ে বাড়ছে? কেন পেট্রল ডিজেলের দাম প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে? কৃষকরা আলু বিক্রি করছেন ৪-৫ টাকা কিলো দরে আর পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ৩-৪ টাকা কিলো দরে। সেই আলু ও পেঁয়াজ এখন বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে যথাক্রমে ৩৫-৪০ এবং ৬০-৭০ টাকা কিলো দরে। কেন এ রকম হচ্ছে? এ সব কি এমএসপি-র জন্য হচ্ছে? আদৌ তা নয়। তা হলে দাম বাড়ছে কেন? বাড়ছে, কারণ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে পুঁজিপতি ব্যবসায়ীরা। বাস্তবে এদের ওপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকারের কোনও জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গিই নেই। পুঁজিপতিরা ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে, আর ইচ্ছামতো মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলছে। এই হল মূল্যবৃদ্ধির আসল কারণ। ফলে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে হলে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীকে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে হবে, সরকারকেই এই ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং জনগণকে তা সরবরাহ করতে হবে। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটছে না বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থে।

এখন আসা যাক টাকার অভাবের প্রশ্নে। এমএসপি চালু না করার পেছনে সরকার অর্থ-সংকটের যুক্তি তুলছে। প্রশ্ন হল, কৃষিপণ্যে এমএসপি চালু করতে হলে কত টাকা প্রয়োজন? হিসাবটা দেখা যাক। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার ২৩টি কৃষিপণ্যে এমএসপি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এই ২৩টি কৃষিপণ্যের মধ্যে আছে ৭ ধরনের দানা শস্য (চাল, গম, ভুট্টা ইত্যাদি), ৫ ধরনের ডাল (মুগ, মুসুর ইত্যাদি), ৭ ধরনের তৈলবীজ (সরষে, বাদাম ইত্যাদি), আর আছে ৪ ধরনের বাণিজ্যিক ফসল (আখ, পাট, তুলো ইত্যাদি)। সরকার যদি ২৩টি কৃষিপণ্য পুরোটাই এমএসপি দরে কিনে নেয় তা হলে তার বছরে খরচ হবে ১০.৭৮ লক্ষ কোটি টাকা। যদিও ২৩টি কৃষিপণ্য যতটা উৎপাদন হয় তার সবটা বাজারে আসে না। কারণ, কৃষকরা উৎপাদিত দ্রব্যের একটা অংশ নিজেরা ভোগ করে। একটা অংশ পরের বছরের বীজের জন্য রেখে দেয় এবং একটা অংশ পশুখাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে। কোন কোন কৃষিপণ্যের কী পরিমাণ বাজারে আসে তার হিসাবটা মোটামুটি এই রকম– ১) গমের ৭৫ শতাংশ, ২) চালের ৮০ শতাংশ, ৩) আখের ৮৫ শতাংশ, ৪) অধিকাংশ ডালের ৯০ শতাংশ, ৫) তুলা ও পাটের ৯৫ শতাংশ। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের গড়ে ৭৫ শতাংশ বাজারে এলে সব কিনে নিতে সরকারের খরচ হবে ৮ লক্ষ কোটি টাকার সামান্য বেশি। আখকে এই হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে। কারণ, আখ কেনে চিনিকল মালিকরা এবং দাম তাদেরই দেওয়ার কথা। সরকারকে শুধু লক্ষ রাখতে হবে যাতে চিনিকল মালিকরা সময়মতো কৃষকদের পাওনা মিটিয়ে দেয়।

আবার যতটা তুলো ও পাট উৎপাদন হয় তার সবটা কিনে নেওয়ার দরকার নেই। সরকার যদি মোটামুটি অর্ধেক পাট বা তুলো কেনে তা হলে বাজারে তার বিরাট প্রভাব পড়বে এবং খোলাবাজারে কৃষক লাভজনক দাম পাবে। ২০২৩-২৪ সালে দেশে তুলো উৎপাদিত হয়েছিল ৩৩২.৫০ লক্ষ বেল। তার মধ্যে সরকার কিনে নিয়েছে মাত্র ৩২.৮১ লক্ষ বেল। এর ফলে খোলাবাজারে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি তাই কৃষকরা খুব বেশি লাভজনক দামও পায়নি। কিন্তু তুলো বা পাট বাজারে আসার অনেক আগেই যদি সরকার ঘোষণা করে যে সে উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামে শতকরা ৫০ ভাগ কিনবে, তা হলে তা খোলাবাজারে কৃষককে লাভজনক দাম পেতে সাহায্য করবে।

এখন এই প্রক্রিয়ায় সরকার যেসব খাদ্যসামগ্রী ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য কৃষকদের কাছ থেকে কিনে নেবে, তা দিয়ে সে কী করবে? সরকার তা সাধারণ মানুষকে সরকারি ব্যবস্থায় কম দামে বিক্রি করবে। এই বিক্রির ফলে সরকারি ভাণ্ডারে একটা বিরাট পরিমাণ টাকা জমা পড়বে, সরকারের আর্থিক দায়িত্ব অনেকটাই কমবে এবং জনসাধারণ কম দামে খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী পাবে। এইটুকু যদি সরকার করতে না পারে তাহলে সরকারটা আছে কী করতে? এমএসপি চালু করতে সরকারি কোষাগার থেকে কত টাকা বাড়তি খরচ হবে? এমএসপি যতটুকু চালু আছে তার জন্য বর্তমানে সরকারের খরচ হয় ৩.২ লক্ষ কোটি টাকা। হিসাব করে দেখা গেছে এর উপর সরকারের বাড়তি খরচ হতে পারে মাত্র দেড় লক্ষ থেকে দুই লক্ষ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এটা সামান্য টাকা। এই সামান্য পরিমাণ টাকা সরকার কৃষক তথা সামগ্রিক জনস্বার্থে খরচ করতে পারবে না কেন? সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু হলে দেশের ১৩০ কোটি মানুষ উপকৃত হবে, অথচ বাড়তি খরচ হবে বড়জোর বছরে দুই লক্ষ কোটি টাকা। সরকার এই সামান্য টাকা খরচ করতে চাইছে না।

অথচ, এই সরকারই মুষ্টিমেয় একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠীকে গত কয়েক বছরে ১৫ লক্ষ কোটি টাকা ছাড় দিয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তো আছেই। এ থেকেই বোঝা যায় এই সরকার কাদের সরকার। তারা সমস্ত কৃষিপণ্য একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়ে কৃষক ও সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করে দিতে চাইছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যেই কৃষক-খেতমজুর সহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি দেশের কৃষক-খেতমজুররা তাঁদের উপর ন্যস্ত এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব অবশ্যই পালন করবে।

তাঁরা আওয়াজ তুলছেন–‘আমরা লড়ব, আমরা জিতব।’ এসইউসিআই (সি) আগামী ২১ জানুয়ারি মূল্যবৃদ্ধি রোধ, ফসলের ন্যয্য দাম সহ নানা দাবিতে কলকাতায় মহামিছিলের ডাক দিয়েছে। একের পর এক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারকে বাধ্য করতে হবে জনস্বার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।