Breaking News

আর জি করঃ অভিযুক্তদের বাঁচাতে কেন্দ্র-রাজ্য যোগসাজশ, বিচার না পেলে জনগণ কিন্তু ছাড়বে না

সিবিআইকে সাদা কাগজ দিল এসইউসিআই(সি) ১৪ ডিসেম্বর সিবিআই দফতর অভিযান এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর

স্তম্ভিত সারা দেশ। এ-ও কি সম্ভব! যে অন্যায়ের শাস্তি চেয়ে সারা রাজ্য, দেশ উত্তাল হয়েছে সেই অন্যায়কারীদের নামে চার্জশিটটুকু দিতে পারল না কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই! এ কি তাদের শুধুই অপদার্থতা! নাকি এর পিছনে অন্য কোনও গুরুতর ষড়যন্ত্র রয়েছে? এই প্রশ্নই এখন অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার মানুষকে তাড়িত করছে।

আর জি কর হাসপাতালের চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনে তথ্য-প্রমাণ লোপাট ও ষড়যন্ত্রের মতো গুরুতর অভিযোগে গ্রেফতার হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলের বিরুদ্ধে ৯০ দিনেও সিবিআই চার্জশিট দিতে না পারায় জামিন পেয়ে গেলেন তাঁরা। অথচ প্রথম থেকেই সিবিআই বলে আসছিল যে, তদন্ত ঠিক পথেই চলছে এবং তারা যথেষ্ট পরিমাণে তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে চলেছে। সুপ্রিম কোর্টও প্রতিটি শুনানিতে বলেছিল, তদন্ত সঠিক পথেই চলছে। ৯০তম দিনে তার এই প্রমাণই দিল সিবিআই! সিবিআইয়ের এই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ অভয়ার ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করা লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেগ এবং প্রত্যাশাকে গভীর ভাবে আঘাত করেছে।

চিকিৎসক-ছাত্রী ‘অভয়ার’ ধর্ষণ-খুনের পরই প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারা বাংলা। প্রতিবাদের ঢেউ বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে, এমনকি বিদেশেও। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। অভয়ার জন্য ন্যায়বিচারের দাবিতে রাতের পর রাত জেগেছেন তাঁরা, অসংখ্য সভা, বিক্ষোভ, মিছিল হয়েছে। ন্যায়বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট এবং নাগরিকরা সম্মিলিত ভাবে স্বাস্থ্য দফতর ঘেরাও করেছেন, লালবাজার ঘেরাও করেছেন, শহরের প্রাণকেন্দ্র এসপ্ল্যানেডে লাগাতার অবস্থান করেছেন। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর ডাকে ১৬ আগস্ট রাজ্য জুড়ে ধর্মঘট পালিত হয়েছে। আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততা অতীতের সমস্ত নজির ছাড়িয়ে গেছে। সেই জনমতকে উপেক্ষা করেই চার্জশিট না দিয়ে মূল দুই অভিযুক্তকে জামিন পেতে সুবিধা করে দিল সিবিআই। সিবিআইয়ের এই ভূমিকায় সমস্ত অংশের মানুষ বিস্মিত, ক্ষুব্ধ এবং ত্রুদ্ধ।সর্বত্রই ক্ষোভে ফেটে পড়ছে মানুষ।প্রতিবাদে নতুন করে রাস্তায় নামছে।

১৪ ডিসেম্বর সিবিআই দপ্তর অভিযান

জামিনের সংবাদ প্রচার হতেই আর জি করের আন্দোলনরত চিকিৎসক, ছাত্র এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁদের তীব্র ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। পরদিন সিবিআই দফতরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট, এমএসসি, সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম এবং নার্সেস ইউনিটির সদস্যরা। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে এই ঘটনাকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যোগসাজশ এবং তাদের নির্দেশেই সিবিআই চার্জশিট না দেওয়ার ঘটনা বলে জানিয়েছেন। তিনি এই ঘটনাকে ন্যায়বিচারের প্রতি জঘন্য উপহাস বলে তীব্র ধিক্কার জানিয়েছেন। ১৫ ডিসেম্বর এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর পক্ষ থেকে সিবিআই দফতর অভিযান করে স্মারকলিপি হিসাবে সাদা কাগজ জমা দেওয়া হয়। রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেন, সিবিআইকে নতুন করে রাজ্যের মানুষের আর বলার কিছু নেই। এর আগে অনেক বার আমরা সিবিআই দফতরে এসে স্মারকলিপি জমা দিয়ে আমাদের বক্তব্য জানিয়েছি। প্রতিবার সিবিআই জানিয়েছে তদন্ত ঠিক পথেই চলছে। এই কি ঠিক পথে তদন্তের নমুনা?

কেন্দ্র-রাজ্য বোঝাপড়া

সমস্ত স্তরের মানুষের মনে আজ এই প্রশ্ন ঘা দিচ্ছে যে, চার্জশিট দিতে না পারা কি শুধুই সিবিআয়ের অপদার্থতা, নাকি এর পিছনে রয়েছে কোনও গভীর ষড়যন্ত্র? তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পরে সিবিআই নিজেই তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ জানিয়েছিল এবং প্রথমে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হলেও পরে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে সন্দীপ ঘোষ এবং অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করে তারা। চিকিৎসক-ছাত্রীর মৃত্যুর দিন সকাল থেকে প্রথমে সেটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা এবং তারপর সারাদিন ধরে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার কাজে কী ভাবে গোটা হাসপাতাল-প্রশাসন যুক্ত হয়ে পড়েছিল, নিয়মবিরুদ্ধ ভাবে ময়নাতদন্তের নামে কেমন প্রহসন হয়েছে, কী ভাবে অতি দ্রুততায় মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে পুনরায় ময়নাতদন্তের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং ষড়যন্ত্রের তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে হাসপাতালের সব সিসি ক্যামেরার রেকর্ড এবং সন্দীপ ঘোষের সঙ্গে প্রভাবশালীদের ফোনের সব নথি মুছে ফেলা হয়েছিল। সেগুলি উদ্ধার করতে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির সাহায্য নিতে হয়েছিল সিবিআইকে। তথ্য-প্রমাণ লোপাটের এই গোটা কাজটি করা হয়েছিল রাজ্য প্রশাসনের সহযোগিতায় এবং এক নিখুঁত পরিকল্পনা মাফিক। এই গোটা কর্মকাণ্ডের পিছনে মূল ভূমিকায় ছিলেন আর জি করের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং ওই ওসি। এ ছাড়াও তদন্তে সিবিআই বহু জনকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং জানায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটে এবং খুন-ধর্ষণে জড়িত থাকার অনেক প্রমাণ তারা জোগাড় করতে পেরেছে। তা হলে তো তাদের চার্জশিট জমা দিতে না পারার কথা নয়। তবে তারা তা পারল না কেন? জনমনে এ অভিযোগ দৃঢ়মূল যে, অভিযুক্ত দু’জনকে জামিন করিয়ে দিতে সিবিআই ইচ্ছাকৃত ভাবে চার্জশিট জমা দিল না। ন্যায়বিচারের উপর এ এক নিষ্ঠুর আঘাত।

১৪ ডিসেম্বর জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের আহ্বানে ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের সিবিআই দফতর অভিযান

অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেওয়ার সময়েই সিবিআই জানিয়েছিল পরে তারা সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট জমা দেবে। তাতে অন্য সন্দেহভাজনদের তারা যুক্ত করবে। তা হলে সেই চার্জশিট তারা জমা দিল না কেন? একটি কলেজ-হাসপাতালে ঢুকে একজন সিভিক ভলান্টিয়ার একজন চিকিৎসক-ছাত্রীকে ধর্ষণ করল, তার সাথে প্রবল ধস্তাধস্তি হল এবং তাকে খুন করে আধ ঘণ্টার মধ্যে নিরাপদে বেরিয়ে গেল, এ ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য কি? এত ঘটনা একার পক্ষে সম্ভব কি? তা হলে আর কারা ছিল? তদন্ত করে বের করার দায়িত্ব ছিল সিবিআইয়ের। তারা তা করল না কেন?

সুপ্রিম কোর্ট আর জি কর ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এই মামলা শোনার দায়িত্ব নিয়েছিল। প্রথম দিনের শুনানিতে সিবিআই আইনজীবীর রিপোর্ট দেখে প্রধান বিচারপতি চমকে উঠে বলেছিলেন, অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। বলেছিলেন, সিবিআই তদন্ত করছে। নিশ্চয় সমস্তটা সামনে আসবে। এই কি তা হলে সেই ভয়াবহ খুনের সিবিআই তদন্তের পরিণাম! সুপ্রিম কোর্ট তা হলে কী দায়িত্ব পালন করল? নাকি কেন্দ্রীয় সরকারের এক আইনজীবী যে বলেছিলেন, দেশ জুড়ে চিকিৎসকদের আন্দোলন যে ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, সুপ্রিম কোর্ট দায়িত্ব না নিলে তা তীব্র হয়ে উঠত– বাস্তবে সেই আন্দোলন আটকানোই ছিল সুপ্রিম কোর্টের উদ্দেশ্য, সত্য উদঘাটন নয়?

সিবিআই প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীন। তা হলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেন সিবিআইয়ের এই ভূমিকার পরও নীরব? ঘটনার পরপরই স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পরে তিনি আর জি করের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, ‘‘মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনার যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত দরকার। যারা এই দানবীয় কাজে জড়িত, তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া দরকার। এতে সমাজে আস্থা তৈরি হবে’’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ আগস্ট)।

প্রধানমন্ত্রী কি বলবেন, সিবিআইয়ের এই ভূমিকা সমাজে সত্যিই আস্থা তৈরি করল, নাকি ন্যায়বিচার সম্পর্কে, সিবিআই সম্পর্কে সমাজ জুড়ে প্রবল অনাস্থা তৈরি করল? আর সেই অনাস্থার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দফতর কি দায়িত্ব এড়াতে পারে?

খাঁচার তোতা সিবিআই

অতীতেও বারে বারে দেখা গেছে, সিবিআইকে তদন্তভার দেওয়ার পরও তারা যথাযথ তদন্ত করেনি। যা দেখে এমনকি বিচারপতিরা পর্যন্ত বিরক্তির সুরে তাদের বারে বারে ‘খাঁচার তোতা’ বলেছেন। অর্থাৎ স্বাধীন ভাবে তদন্ত নয়, ওপর মহল যেমন নির্দেশ দেয় সেই মতোই তারা কাজ করে। বিজেপি শাসনে আজ এ কথা সবারই জানা যে, কেন্দ্রীয় সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হিসাব কষেই এই নির্দেশ দিয়ে থাকে। এমন তদন্তের উপর দাঁড়িয়ে শাসকদের স্বার্থ চরিতার্থ হলেও মানুষ ন্যায়বিচার পেতে পারে কি?

২০১৪ সাল থেকে সারদা চিটফান্ড দুর্নীতি সহ প্রায় ডজনখানেক যে বড় দুর্নীতির মামলার দায়িত্ব সিবিআই নিয়েছে, তার কোনওটিরই তারা ফয়সালা করতে পারেনি। তা কি এই জন্য যে, এগুলির সবকটিতেই কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলগুলির নানা স্তরের নেতারা জড়িত? এ বারও সিবিআইয়ের সঞ্জয় রায়কেই দোষী সাব্যস্ত করে কার্যত পুলিশের রিপোর্টটিতেই স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া এবং চার্জশিট জমা না দেওয়ার ঘটনায় একই অভিযোগ উঠছে যে, সিবিআই রাজনৈতিক নির্দেশেই এ ভাবে হাত গুটিয়ে থাকল। কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তো আপাতদৃষ্টিতে তৃণমূলের বন্ধু সরকার নয়, তা হলে তৃণমূল সরকারকে বাঁচাতে কেন বিজেপি সরকার সিবিআইকে এ ভাবে হাত গুটিয়ে থাকতে নির্দেশ দেবে?

বিচার আটকাতে উভয় সরকারের সমস্বার্থ

আর জি করের চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ-খুনের ঘটনাটি কোনও সাধারণ ঘটনা নয়। এর নৃশংসতা যেমন মানুষকে স্তম্ভিত করেছে, তেমনই এর পিছনে যে একটা বিরাট ষড়যন্ত্র রয়েছে, একটা বিরাট দুর্নীতি-চক্র এবং থ্রেট কালচার কাজ করেছে এবং এর সঙ্গে রাজ্য সরকারের অনেক রাঘব বোয়াল জড়িত রয়েছে, গত চার মাসের তদন্তে প্রকাশিত খবরগুলি থেকে সকলের কাছেই আজ তা স্পষ্ট। তাই তদন্ত সঠিক পথে এগোলে এই বিরাট চক্রটি প্রকাশ্যে এসে যাওয়ার আশঙ্কা যেমন রাজ্য সরকারের, তেমনই এই ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবিতে যে নজিরবিহীন গণআন্দোলন দেশ জুড়ে গড়ে উঠেছে তা যদি সফল পরিণতিতে পৌঁছায়, দাবি আদায় করতে পারে, কেন্দ্র-রাজ্য উভয় শাসকদের আশঙ্কা, তার দেশজোড়া বিরাট প্রভাব পড়বে। সর্বত্র তা শোষিত নিপীড়িত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে। যেখানেই অন্যায় ঘটবে সেখানেই আর জি কর আন্দোলনের মতো মানুষ ন্যায়বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামবে, আন্দোলন গড়ে তুলবে। শাসকদের বাধ্য করবে দাবি মানতে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কোনও শাসকই তা চাইতে পারে না। এইখানেই রাজ্যের তৃণমূল শাসকদের সঙ্গে কেন্দ্রের বিজেপি শাসকদের স্বার্থ এক বিন্দুতে মিলেছে।

তৃণমূল সরকারের নিকৃষ্ট ভূমিকা

তৃণমূল সরকার তার নিজ স্বার্থেই তদন্তকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে। প্রথম থেকেই তৃণমূল সরকার এক সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কেই একমাত্র দোষী হিসাবে জনসমক্ষে তুলে ধরেছে। এবং তাকে গ্রেফতার করাকেই তাদের বিরাট কীর্তি হিসাবে দেখাতে চেয়েছে। সরকার জানে তদন্ত যদি সঠিক পথে হয় তবে শুধু তাদের নানা স্তরের নেতাদের দুর্নীতিই প্রকাশ্যে এসে পড়বে তাই নয়, এই ধর্ষণ-খুনের ঘটনায়ও সেই সব রাঘব বোয়ালদের যোজসাজশও প্রকাশ্যে এসে যাবে। তাই সন্দীপ ঘোষকে আড়াল করতে সরকার সব রকমের চেষ্টা চালিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ডাক্তার এবং ছাত্ররা প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়লে রাজ্য সরকার তাঁকে আর একটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ করে পাঠানোর মতো ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। আজও পর্যন্ত সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কোনও রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। সিবিআইয়ের সঙ্গেও সরকার প্রথম থেকেই অসহযোগিতা করে এসেছে। তৃণমূল সরকার যদি সত্যিই ন্যায়বিচার চাইত, তবে এতবড় একটি গণআন্দোলনের দাবি এমন করে উপেক্ষা করতে পারত না। আন্দোলনে পদে পদে বাধা দিত না, তদন্তে অসহযোগিতা করত না। তৃণমূল সরকার যদি দায়িত্বশীল হত, জনগণের প্রতি যদি তাদের দায়বদ্ধতা থাকত তবে তারাও জনগণের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সিবিআইয়ের কাছে দ্রুত তদন্তের দাবি জানাত। সরকারের কথা ছেড়ে দিলেও দল হিসাবে তৃণমূলও তা করেনি। শুধু তাই নয়, সন্দীপ ঘোষ এবং অভিজিৎ মণ্ডল সরকারি কর্মচারী হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে গেলে রাজ্য সরকারের যে অনুমতি লাগে, সিবিআই জানিয়েছে তা-ও সরকার দেয়নি।

সত্য উদঘাটনে বিজেপি নেতাদের অনীহা

রাজ্যের বিজেপি নেতারা আর জি কর আন্দোলনের বিরাট ব্যাপ্তি দেখে প্রথম দিকে কিছু কর্মসূচি নিলেও যখন বুঝলেন, এই আন্দোলনকে দাবি আদায়ের রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সরকার ফেলে দেওয়ার আন্দোলনে পরিণত করে ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করা যাচ্ছে না, তখনই তারা গোটা আন্দোলন থেকে হাত গুটিয়ে নিলেন। এমন কি বিজেপি নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এ রাজ্যে এলে নিহত চিকিৎসকের বাবা-মা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও তিনি দেখা করেননি। এমনকি তাঁর বক্তৃতায়একবারেরজন্যওএইঘটনারউল্লেখকরেননি। জনগণের প্রতি ন‌্যূনতম দায়িত্বশীল হলে কোনও দল কি জনস্বার্থবাহী কোনও আন্দোলন থেকে এ ভাবে হাত গুটিয়ে নিতে পারে! আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দাবি আদায় হোক, অপরাধীরা সাজা পাক, তা আসলে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা চান না। তা না হলে তাঁরা সিবিআইকে স্বাধীন ভাবেই কাজ করতে দিতেন। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে আজ মহিলাদের ধর্ষণ-খুন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ রাজ্যে আর জি কর আন্দোলন যদি অভয়ার ন্যায়বিচার ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় তবে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতেও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠবে এবং শাসক হিসাবে বিজেপি বিপদে পড়বে। ফলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, সিবিআইয়ের এই হাত গুটিয়ে নেওয়া আসলে কেন্দ্রীয় নির্দেশেই।

এই নির্দেশের দ্বারা কারা লাভবান হল? কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এই ন্যক্কারজনক ভূমিকা কাদের স্বার্থ রক্ষা করল? বাস্তবে এর দ্বারা রাজ্য জুড়ে ধর্ষকরা, খুনিরা, দুর্নীতিগ্রস্তরা আরও বেপরোয়া হবে, তারা আরও বেশি করে সরকারি দলের ছাতার তলায় আশ্রয় নেবে। অন্য দিকে ধর্ষণ-খুনের মতো অপরাধ আরও বাড়তে থাকবে। সমাজ জুড়ে নৈরাজ্য বাড়বে। অপরাধীরা বুঝবে সরকারি দলের ছত্রছায়ায় থাকলে যত অপরাধই তারা করুক না কেন, পুলিশ তাদের টিকিও ছোঁবে না।

মানুষ লড়বে বাঁচার স্বার্থেই

কিন্তু এর দ্বারা জনগণ, যারা রাস্তায় নেমে ন্যায় বিচারের দাবিতে লড়াই করেছেন, তাঁরা কি মনোবল হারাবে? মোটেও নয়। তাঁরা আজও আন্দোলনেই রয়েছেন। আজ এ কথা সবাইকে বুঝতে হবে যে, এ এক অসম লড়াই। একদিকে রাজ্য সরকার, কেন্দ্র সরকার, সমস্ত শাসক দলগুলি, আর অন্য দিকে ন্যায়বিচার প্রার্থী জনগণ এবং চিকিৎসক-ছাত্রছাত্রীরা। আন্দোলনের চাপে ইতিমধ্যেই সরকার হাসপাতালগুলিতে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। আজ যদি আমাদের মেয়েদের একই রকম ধর্ষণ-খুনের হাত থেকে রক্ষা করতে হয়, ছেলেদের ধর্ষক হওয়ার পরিণতি থেকে রক্ষা করতে হয়, সমাজকে দুর্নীতির হাত থেকে, থ্রেট সিন্ডিকেটের হাত থেকে রক্ষা পেতে হয় তবে আন্দোলনকে আরও সংগঠিত, আরও তীব্র করা ছাড়া জনগণের সামনে অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই। দুই দুষ্কৃতীর জামিন পাওয়ার ঘটনায় প্রবল ক্ষুব্ধ মানুষ সেই রাস্তাতেই হাঁটা মনস্থ করেছে। বিচার না পেলে তারা কাউকে ছাড়বে না।