পকসো আইন অনুযায়ী বারুইপুরের বিশেষ আদালত জয়নগরের নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ধৃতের সাজা ঘোষণা করেছে ৬৩ দিনের মাথায়। এই রায় যে একটি বিশেষ ঘটনা তা রাজ্য পুলিশ তাদের এক্স হ্যান্ডেল পোস্টে কার্যত স্বীকার করে নিয়ে লিখেছে– ‘এই রায় নজিরবিহীন। নাবালিকাকে ধর্ষর্ণ ও খুনের মামলায় ঘটনার মাত্র ৬৩ দিনের মধ্যে অভিযুক্তের ফাঁসির আদেশ এর আগে পশ্চিমবঙ্গে কখনও ঘটেনি। এই মামলার তদন্তে আমাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, যত দ্রুত সম্ভব নির্যাতিতা এবং তার পরিবারকে ন্যায়বিচার দেওয়া।’ প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্য পুলিশ ন্যায়বিচারের জন্য এত যদি আন্তরিক, তবে শুরুতেই তাদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ উঠল কেন? কেন মেয়েটির পরিবারকে এ থানা ও থানা দৌড়ে বেড়াতে হয়েছিল? আর জি করের বর্বরোচিত ঘটনায় বিচারের প্রশ্নে পুলিশের কী ভূমিকা?
শুধু জয়নগরের ঘটনায় নয়, রাজ্যের সর্বত্রই বহু ক্ষেত্রে পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। এটাই যে এখন স্বাভাবিক, পুলিশের তৎপরতাটাই ব্যতিক্রম– সাধারণ মানুষের সে অভিজ্ঞতা আছে। অভিযোগ উঠছে অপরাধী প্রভাবশালী না হলে সে ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসন বিচারব্যবস্থা যে কড়া অবস্থান নেয়, প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে তাদের সেই দৃঢ়তা যায় কোথায়? জয়নগরের ঘটনায় তদন্ত ও বিচারের ‘নজিরবিহীন’ বিষয়টিকে সামনে রেখে রাজ্য পুলিশ-প্রশাসন ও সরকার চ্যাম্পিয়ন সাজতে চাইলেও প্রশ্নগুলো এড়াতে পারছে না।
রাজ্যে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ (ক্রাই) এবং কলকাতা পুলিশের করা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে গত দু’বছরে এই রাজ্যে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণের অভিযোগ বেড়েছে (যা জমা পড়েছে) যথাক্রমে ১৮ ও ১২ শতাংশ। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো (এনসিআরবি) রিপোর্ট বলছে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং রাজস্থানের মতো পশ্চিমবঙ্গেও ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে শিশুদের উপর যৌন অত্যাচার বেড়েছে। ২০১৪ সাল থেকে হিসেব ধরলে ২০২২ সাল পর্যন্ত শিশুদের উপর যৌন অত্যাচার বেড়েছে প্রায় ৮১ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে অপরাধ ক্রমবর্ধমান।
কিন্তু পকসো আইন তো আছে। এই প্রতিটি ঘটনায় পকসো আইন কার্যকর করে এফআইআর দায়েরের দু’মাসের মধ্যে তদন্ত ও ছয় মাসের মধ্যে বিচার শেষ করে কঠোর শাস্তি দেওয়ার কাজটা বাস্তবে কি দাঁড়াচ্ছে? কেন এতদিন পশ্চিমবঙ্গে পকসো আইন বলবৎ করে শিশু নির্যাতনকারীদের দ্রুত ও কঠোর শাস্তি বিধান করা গেল না? শুধুমাত্র জয়নগরের ঘটনায় বিচারের বিষয়টিকে সামনে রেখে যদি রাজ্য পুলিশ-প্রশাসন ও সরকার নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে চায় তা হলে স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠবে–নারী ও শিশু নির্যাতনের আরও বহুদিনের বহু বিচারহীন ঘটনাকে কেন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে? একটি ঘটনাকে সামনে রেখে বাকিগুলিকে কি আড়াল করতে চাওয়া হচ্ছে? জয়নগরের বিচার যে ব্যতিক্রম তা পুলিশই বলেছে। আর এটাকেই দেখিয়ে আর জি করের ঘটনায় ব্যাপক গণবিক্ষোভকে কি কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে চাওয়া হচ্ছে?
২০০৯ সালে জাতিসংঘের কনভেনশনে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন দূর করা সংক্রান্ত এক প্রস্তাবে স্বাক্ষর করে ভারত। ২০১২ সালে দেশে পকসো (প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস) আইন পাস হয়। ২০১৯-এ এই আইনের সংশোধনীও নিয়ে আসা হয়। লিঙ্গ নির্বিশেষে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে অপরাধীদের দ্রুত ও কঠোরতম শাস্তির বিধান দিয়েছে পকসো আইন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বুরোর পরিসংখ্যান বলছে ২০২১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শিশুদের উপর যৌন অত্যাচারের মোট অভিযোগ দায়ের হয়েছে ১ লক্ষ ৬২ হাজার ৪৪৯টি। চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ (ক্রাই) এবং ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেড চিলড্রেন (এনসিএমসি) সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে অনলাইনে চাইল্ড পর্নোগ্রাফির প্রসারে এই মুহূর্তে ভারত বিশ্বে প্রথম স্থানে। গোটা দেশে শিশু নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান এই প্রবণতার প্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত কতজন অপরাধীকে পকসো আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে?
হিসেব মেলাতে গেলে কানাগলিতে পড়তে হবে। বরং চোখের সামনে উদাহরণ হিসেবে মনে পড়ে যাবে কাশ্মীরের কাঠুয়ার ঘটনা, উত্তরপ্রদেশের উন্নাও-এর মতো ঘটনা। কাঠুয়াতে আট বছরের আসিফা বানোকে মন্দিরে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষর্ণ করেছিল যারা তাদের সমর্থনে দেশের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল করেছে কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় আসীন বিজেপির নেতাকর্মীরা। উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার, তার ভাই ও অন্য সহযোগী মিলে এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করে। বিচার চাওয়াতে মেয়েটি ও তার পরিবারকে বারবার নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয় নাবালিকার বাবাকে। এতেই বোঝা যায় এই দেশে, এই রাজ্যে অপরাধীদের শাস্তি কেন ব্যতিক্রমী ঘটনা। যেখানে পুলিশ-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থা সবই রাজনীতির কারবারিদের দ্বারা পরিচালিত হয়, যেখানে দুর্বৃত্তদের আশ্রয়স্থল হয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলি, সেখানে আইনে ভালো ভালো কথা লেখা থাকলেও প্রকৃত অর্থে ন্যায়বিচার সম্ভব কি?
শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের প্রশ্নে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ অভিভাবকদের সতর্ক হতে পরামর্শ দিচ্ছেন। বলছেন, ‘পরিবারে এমন পরিবেশ তৈরি করুন যাতে শিশু নিজের সমস্যার কথা বলতে পারে। আর এমন কিছু ঘটলে তা চেপে না গিয়ে পুলিশের কাছে যান।’ যে কোনও শিশু বড় হয় শুধু পরিবারে নয়, সামাজিক পরিমণ্ডলে। সেই সমাজ পরিমণ্ডলই যদি কলুষিত হয়, অপরাধ প্রবণতা যদি উত্তরোত্তর বেড়েই চলে তাহলে শিশু খেলার মাঠেও যেমন, তেমনই পরিবারের সদস্যদের থেকেও নির্যাতিত হতে পারে। সমীক্ষা বলছে পরিবারের সদস্য ও শিশু দেখভালকারীদের দ্বারা বহুক্ষেত্রে শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলি ঘটছে। ফলে অভিভাবকরা সচেতন হলেও সব সময় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব নাও হতে পারে। গোটা সামাজিক ব্যবস্থাটার যে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন, তা করবে কে? মোবাইল-টেলিভিশন-পত্রপত্রিকায় অশ্লীল ছবি ও বিজ্ঞাপন, মদ ও মাদকদ্রব্যের ঢালাও লাইসেন্স, শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক ধ্বংস সাধন, মূল্যবোধের অবক্ষয়– যে দলই যখন শাসন ক্ষমতায় থেকেছে এগুলিকে তারা নিশ্চিত করেছে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে।
এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিক গতিতে অপরাধ মনন তৈরি করা হয়েছে সমাজের বুকে। বিকৃতি এতটাই যে ছয় মাসের শিশু কন্যা থেকে আশি বছরের বৃদ্ধা এ সমাজে নিরাপদ নয় কেউই। আর এইসব অপরাধীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসকদলের মদতপুষ্ট। শাসক দল ও অপরাধীদের এই ঘনিষ্ঠ বৃত্ত ভাঙতে চাই জনগণের সংগঠিত সচেতন সক্রিয় প্রতিরোধ।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি গণআন্দোলনের তরঙ্গ কেমন করে শাসকদলের বৃত্তে থাকা দুষ্টচক্রের কাউকে কাউকে অন্ততপক্ষে আইনের হেফাজতে নিয়ে আসাকে সম্ভবপর করেছে, জুনিয়র ডাক্তারদের বেশ কয়েক দফা দাবি মানতে রাজ্য সরকারকে বাধ্য করেছে। সহস্র ছিদ্রে ভরা এই সামাজিক ব্যবস্থাকে আন্দোলনের তরঙ্গে তরঙ্গে যদি উত্তাল করে দেওয়া যায় তার একটা অবশ্যম্ভাবী চাপ এসে পড়ে পুলিশ-প্রশাসন, সরকার ও বিচারব্যবস্থার উপর। আবার আন্দোলন তৈরি করে নতুন নৈতিকতা, উন্নততর সংস্কৃতি। ধসে পড়া সামাজিক মননের মানটাকে তা অনেকখানি তুলে আনতে সাহায্য করে। সচেতন জাগ্রত জনচেতনা চাপ তৈরি করে অপরাধ মননের উপরেও। তাই নির্বাচনসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলির কোনও বাগাড়ম্বর বা মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে না ভুলে, শত ফুল বিকশিত করার জন্য সামাজিক এই ব্যবস্থাটাকে পরিবর্তনের দায়িত্ব জনসাধারণকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে।