২৭ নভেম্বর। ভোরের দিল্লি তখন ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে হাল্কা শীতের আমেজে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। আর ধীরে ধীরে সেজে উঠছে দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়াম। কয়েক ঘণ্টা পরেই শুরু হবে ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও-র দশম সর্বভারতীয় সম্মেলন। কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শিক্ষানীতি প্রতিরোধে, দেশের সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচাবার লক্ষ্যে আগামী দিনের রণকৌশল স্থির করতেই এই সম্মেলন। দেশের ২৯টি রাজ্য ও চারটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিশাল ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিত্ব করতে প্রতিনিধিরা এক এক করে উপস্থিত হচ্ছেন ‘শহিদ উধম সিং নগরে’। এই সম্মেলন কোনও আনুষ্ঠানিক বিষয় নয়। প্রকৃত অর্থেই দেশের সংগ্রামী ছাত্রসমাজকে আদর্শগতচেতনার ভিত্তিতে এক ছাতার তলায় সমবেত করার মঞ্চ এই সম্মেলন। ‘নানা ভাষা-নানা মত-নানা পরিধানের’ বৈচিত্র্যের মধ্য থেকে উঠে আসা এক একজন প্রতিনিধি এখানে বৈপ্লবিক আদর্শের ভিত্তিতে একটি বৃহত্তর পরিবারের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব বুঝে নিতে এসেছেন। এই আদর্শই দক্ষিণের এর্নাকুলাম থেকে আসা যতীনকে মিলিয়ে দেয় উত্তরের জলন্ধরের গুরদীপকে। আলিঙ্গনের উষ্ণতায় মিশে যায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামের পথে চলার অঙ্গীকার। পুদুচেরির দিব্যা মূল রাজনৈতিক প্রস্তাবের সমর্থনে মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখলে তার মূল কথাকে নাড়ির টানে বুঝে নিয়ে অভিবাদন জানায় পাশাপাশি বসা পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের প্রতিনিধিরা, তামিলনাড়ুর সেবাস্তিয়ান চোখের জল ফেলে মধ্যপ্রদেশের বিজেপি প্রশাসনের চাপানো মিথ্যা মামলায় জেল হেফাজতে থাকা অমৃকের অনুপস্থিতিতে। অরুণাচল বা উত্তরাখণ্ডের প্রতিনিধিদের পরিবেশিত আঞ্চলিক ভাষার লোকগীতির তালে দুলে ওঠে পুরো হল। এমন টুকরো টুকরো ছবি রচনা করে এক বৃহৎ ক্যানভাস।
যুগে যুগে যারা সত্যের পতাকাকে বহন করেছে তাদের রাস্তা কখনওই সুগম হয়নি, মসৃণ হয়নি। এই দশম সর্বভারতীয় ছাত্র সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদেরও অনেকেরই সম্মেলনে আসার পথটা মসৃণ ছিল না। প্রতিটি প্রতিনিধির লড়াইয়ের গল্প মালার মতো গাঁথলে তা এক অনবদ্য আখ্যানের জন্ম দেয়। শুনতে শুনতে চোখ ভিজে যায়, হৃদয় মুচড়ে ওঠে, আর জমা হতে থাকে আগামী লড়াইয়ের রসদ।
ছাত্র সম্মেলনে এই প্রথমবার উপস্থিত হয়েছিল ঝাড়খণ্ডের রাঁচি জেলার দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সুকৃতী। সে তার রাজ্যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা ও তার উন্নতির জন্য এআইডিএসও-র আন্দোলনের সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে তার গৃহশিক্ষকের কাছে। তাঁর কাছ থেকেই সংগঠনের প্রাথমিক পাঠ সুকৃতীর। সম্মেলনের প্রতিনিধি হওয়ার প্রস্তাব সে সাদরে গ্রহণ করে। কিন্তু তার পরিবার কোনও মতেই রাজি ছিল না দিল্লিতে সম্মেলনে পাঠানোর জন্য। বহু তর্কবিতর্ক ঝামেলা অশান্তির পর্ব পেরিয়ে শেষে তার পরিবারের অনুমতি পেয়েছে সে। সম্মেলনের বিরতিতে ‘কেমন লাগছে’ প্রশ্ন শুনেই তার মুখের উজ্জ্বল হাসিই উত্তরটা দিয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের সুনীতা খাটুয়াও ছাত্র সম্মেলনে প্রথম। কলকাতার একটা কলেজের সোসিওলজি অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুনীতার পরিবার খুবই রক্ষণশীল। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর কলকাতার কলেজে পা রাখাই তাঁর জীবনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। নানা বাধার ধাপ পেরিয়ে এ বারের সম্মেলনে উপস্থিত হতে পেরে সে খুবই উৎসাহিত। হাসি মুখে বলে গেল– ভাল কাজে এসেছি। আমার কোনও ভয় নেই। ত্রিপুরা থেকে এসেছিলেন নজেন্দ্র ত্রিপুরা। সে রাজ্যের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ত্রিপুরা থেকে দিল্লি যাতায়াতের খরচ অনেক। তার পরিবারের পক্ষে এত টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাই বলে সম্মেলনে যাওয়া তো বন্ধ করা যায় না! তাই সে টানা দু’মাস কনস্ট্রাকশন সাইটে দিনমজুরের কাজ করে সেই টাকা সংগ্রহ করেছে। ত্রিপুরার আরও কয়েকজন প্রতিনিধি চা-শ্রমিক পরিবারের সন্তান। তারা ধার করে খরচ জোগাড় করেছে। ঠিক করেছে, সম্মেলন থেকে ফিরে গিয়ে চা-বাগানে মজুরের কাজ করে ধার শোধ করবে। এ যেন জ্যাক লন্ডনের ‘দ্য মেক্সিকান’ গল্পের বক্সার চরিত্রটি, যে বক্সিং রিংয়ে মার খেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে সংগঠনের প্রয়োজনে। গল্পের চরিত্ররা এ ভাবেই বাস্তবের সংগ্রামে মূর্ত হয়ে ওঠে। দিল্লির খুশবু এআইডিএসও-র কথা শুনেছে তার স্কুলের গেটে সম্মেলনের প্রচার চলাকালীন। ধীরে ধীরে সে সংগঠনের একজন কর্মীতে রূপান্তরিত হয়েছে। মেয়ে হয়ে রাজনীতির আঙিনায় পা দেওয়া নিয়ে প্রবল আপত্তি অভিভাবকদের। স্বাভাবিকভাবেই সম্মেলনে আসার ক্ষেত্রেও আপত্তি ছিল প্রবল। কিন্তু খুশবু বোঝে, দিল্লির আরও অন্যান্য সরকারি স্কুলের মতো তার স্কুলটাও একদিন উঠে যাবে। তাই সব অশান্তির সম্ভাবনা মাথায় নিয়েই সে এসেছে সম্মেলনে।
কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্র এস বি রাজু কলেজে ছিলেন এসএফআইয়ের ইউনিট সম্পাদক। বামপন্থা, সমাজতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ থেকেই তিনি এসএফআইতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কার্যকলাপে তাঁর আশাভঙ্গ হয়। ঘটনাচক্রে যোগাযোগ হয় এআইডিএসও-র সঙ্গে। বর্তমানে তিনি সংগঠনের ত্রিবান্দ্রম জেলা সম্পাদকের ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর উপলব্ধি– আমি সঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছি।
মধ্যপ্রদেশের গুনা শহরে সম্মেলনের সমর্থনে প্রচার চালানোর সময় কর্মীদের ওপর নেমে আসে আরএসএস-বিজেপি আশ্রিত গুন্ডাবাহিনীর আক্রমণ। এআইডিএসও কর্মীরা রুখে দাঁড়ালে বিজেপি সরকারের পুলিশ আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। আট জন সংগঠক জেলে বন্দি হন। কিন্তু তাই বলে সম্মেলনের প্রচারের কাজ থেমে যায়নি। জেলে থাকা এক সংগঠকের মা বলেন, ‘আমি সকল সন্তানের হয়ে তোমাদের এই সম্মেলনের কাজে সাহায্য করব।’ ওই মধ্যপ্রদেশ থেকেই প্রায় ১০০০ ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত হয়েছিলেন সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে।
দেশের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির প্রতি দেশের সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণ সেই রাজ্যের মানুষের আবেগকে আহত করেছে বারবার। কিন্তু এআইডিএসও শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের ভিত্তিতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। আসামের পাশাপাশি মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর ইত্যাদি রাজ্যগুলি থেকে ছাত্র প্রতিনিধিরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। গোটা সম্মেলনের পরিবেশ তাঁদের অভিভূত করেছে। সমস্ত প্রতিনিধির একত্রে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করার দৃশ্য তাঁদের ভাবিয়েছে। জাতি-উপজাতিগত ভেদাভেদ ভুলে এই একতার চিত্রই তাঁরা দেখতে চান। কিন্তু শাসকরা নানা চক্রান্তে তাঁদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রেখেছে। তাঁদের একজনের কথায়, আমাদের রাজ্যে কতই না বিভেদ তৈরি করে রেখেছে শাসকরা, কিন্তু এখানে আমরা এক হয়েছি শিক্ষার দাবিতে, এ যে কী আনন্দের তা বলে বোঝাতে পারব না। সম্মেলন থেকে নতুন আশার আলো বুকে নিয়ে তাঁরা ফিরে গেছেন। সংগঠনের বিস্তারের সংকল্প গ্রহণ করেছেন তাঁরা।
সম্মেলনের সাংস্কৃতিক অধিবেশনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিরা গাইছিলেন ‘সারফারোশি কি তমান্না … অব হামারে দিলমেঁ হ্যায়…’ গোটা হল স্তব্ধ হয়েশুনেছে সে গান। শুধু শুনেছে না, গানের প্রতিটি শব্দকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করার ভাবনায় মগ্ন হয়ে গলা মিলিয়েছে সকলে। দিল্লি রাজ্যের প্রতিনিধিরা মঞ্চে গেয়েছে বিখ্যাত কবি পাস রচিত কবিতায় সুরারোপ করে– ‘হাম লড়েঙ্গে সাথী উদাস মৌসম কে লিয়ে’। সেই সুরের ছন্দে উদ্বেলিত হয়েছে গোটা সম্মেলন স্থল। সকলেরই মনে গুঞ্জন তুলছে ‘হাম লড়েঙ্গে সাথী…’
প্রতিনিধি অধিবেশনে সংগঠনের প্রাক্তন সর্বভারতীয় নেতা কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন–‘ফিউচার ইজ আওয়ার্স।’ এরপর সংগঠনের নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্যরা অভিবাদন গ্রহণ করল আগামীর লড়াইয়ের শপথ নিয়ে। সমাপ্তি অধিবেশনে সংগঠনের প্রথম সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে এস ইউ সি আই (সি)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ভিডিও বার্তায় সকল প্রতিনিধিদের সামনে বর্তমান পরিস্থিতির পুঙ্খানুপুঙ্খ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করে এই সময়ে করণীয় কর্তব্য তুলে ধরছেন যখন, সকলে গভীর মনোযোগে তাকে ধারণ করছেন। বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিকে পাল্টে ফেলার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন– ‘‘পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার জন্য আজ প্রয়োজন আজকের দিনের অসংখ্য শহিদ ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, আজাদ, আশফাকুল্লাহ, প্রীতিলতা। যারা মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের বিপ্লবী চিন্তা গ্রহণ করে নতুন মানুষ হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলার সংগ্রামে শামিল হবে।’’ তাঁর এই উদাত্ত আহ্বানে সকল প্রতিনিধির বুকে অনুরণিত হয়েছে– ‘হাম লড়েঙ্গে… হাম জিতেঙ্গে।’