রাতের শেষ মেট্রোর ভাড়ার উপরে ১০ টাকা সারচার্জ বসানোর প্রস্তাব করেছিল কলকাতা মেট্রো রেল। তাতে যাত্রীদের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা একান্তই ন্যায্য। রাত গড়ালেই মেট্রোয় দু’টি ট্রেনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান বাড়ে, মাঝেমধ্যে বাতিলও হয়ে যায় ট্রেন। সবচেয়ে সমস্যার বিষয় রাত দশটা নাগাদ পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায় বলে অনেককেই হুড়মুড় করে ছুটতে হয় শেষ ট্রেনটি ধরার জন্য। এ ছাড়াও, সব স্টেশনে পানীয় জল নেই, এসকেলেটর নেই। ফলে, বয়স্কদের এবং অসুস্থদের অশেষ কষ্টভোগ করতে হয়। এই সব দিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত কর্তৃপক্ষের। পরিষেবা যথাযথ করা দরকার এবং ট্রেন অন্তত এগারোটা অবধি চালু থাকা দরকার।উপচে পড়া ভিড় সব ট্রেনে হতেই হবে, না হলে ট্রেন চালানোই বন্ধ করে দেওয়া হবে– এটা কোনও সুস্থ সমাজের রীতি হতে পারে না। কোনও সময় যাত্রীসংখ্যা কম হতেই পারে। কিন্তু, তার জন্য সারচার্জ আরোপ করা বা ভাড়া বাড়ানোর কথা উঠবে কেন? গণপরিবহণ ব্যবস্থা কি বড়বাজারের গদি না কি যে, পাই পয়সার জন্য যাত্রীদের পকেট খামচে ধরবে?
মেট্রো রেলের প্রয়োজনটা দেখা দিয়েছিল কেন? উনিশ শতকের লন্ডনের ইতিহাসেও দেখা যায় যে, এর দরকার হয়েছিল গণপরিবহণকে আরও দ্রুত এবং সময়ানুবর্তী করে শহরের কর্মব্যস্ততাকে সজীব করে তোলা। শহরের নানা প্রান্তের লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ যাতে ঝট করে গন্তব্যে বা কর্মস্থলে পৌঁছে যেতে পারে, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতিতে যাতে ছেদ না পড়ে, দ্রুততর এবং সময়ানুবর্তী গণপরিবহণ হিসেবে সেটাই হল মেট্রো রেলের কার্যকারিতা। কলকাতাতেও তাই। এই প্রধান লক্ষ্য ছেঁটে ফেলে সরকারি অর্থ ব্যয় করে কিছু সাদা কলারকে বয়ে বেড়ানো মেট্রোর উদ্দেশ্য হতে পারে কি?
এমনিতেই আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির দাপটে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন। এই পরিস্থিতিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দেওয়ার মানসিকতা অত্যন্ত নিন্দনীয়।কেউ কেউ উপদেশ দিচ্ছেন, বেশি ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে বিদেশের কৌশল নিতে। বলা হচ্ছে, বিশ্বের প্রায় সব আধুনিক শহরেই ব্যস্ততার সময়ে গণপরিবহণে এক রকম ভাড়া, ফাঁকা সময়ে অন্য রকম। অথচ, তারা এ কথাটা বলছেন না যে, সেসব শহরে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত প্রায় ভাড়াই দিতে হয় না। কিছু ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ও দেওয়া হয়। অন্যান্যদেরও নানা সুবিধা দেওয়া হয়। সে সব এখানে চালু করা যায় কি না ভাবা দরকার। আমার মতে, কলকাতা মেট্রোর ভাড়া যদি বাড়াতেই হয় তা হলে ইনকাম সার্টিফিকেট দেখে বাড়ানোর পদ্ধতি চালু হোক। যারা বেশি ভাড়া দিতে পারে তারা স্বেচ্ছায় দিক। যাদের রোজগার তেমন নয় তারা যাতে পাঁচ টাকারও কমে মেট্রোয় উঠতে পারে তার ব্যবস্থা সরকার করুক। কারণ, পরিসংখ্যান মন্ত্রক সম্প্রতি ২০২২-২৩ সালের ‘পারিবারিক কেনাকাটার খরচ সমীক্ষা’র প্রাথমিক কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে। সেই হিসাব অনুযায়ী, দেশের গ্রামাঞ্চলে গড়ে মাথা পিছু মাসিক খরচের পরিমাণ মাত্র ৩৭৭৩ টাকা। শহরাঞ্চলে ৬৪৫৯ টাকা। আর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা গ্রামাঞ্চলে মাসে ৩২৩৯ টাকা, শহরে ৫২৬৭ টাকা। অর্থাৎ গ্রাম হোক বা শহর, এ রাজ্যের বাসিন্দাদের মাথা পিছু খরচ জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম। এই পরিস্থিতি অস্বীকার করতে না পেরে কেউ কেউ বলছেন, অতি-ব্যস্ত সময়ে ভাড়া যথেষ্ট পরিমাণ বাড়লে ট্রেনে ভিড়ও খানিক কমতে পারে। এ এক আশ্চর্য মানসিকতা। ভিড় কমাতে বিদেশের মতো দু’মিনিট অন্তর ট্রেন চালানোর কথা তাঁদের মাথায় আসে না। অদ্ভুত পাণ্ডিত্য এক এসেছে এ শহরে আজ। এ সব পণ্ডিতদের আক্ষেপ, কলকাতার মেট্রো রেল অসম্ভব রকম সস্তা। এখানে এখনও পাঁচ টাকায় টিকিট কাটা সম্ভব। তারা কখনও এমন বলেন না যে, শ্রমজীবী মানুষের মূল্য টিকিটের চেয়েও সস্তা। জীবিকার কারণে সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত যে মানুষটাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হয় দিনে তার ৩০০-৪০০ টাকাও উপার্জন হয় না। সে রকম অগণিত মানুষের সংসার কীভাবে চলে তার খোঁজ ওইসব পণ্ডিতেরা রাখেন কি? অথচ, মূলত এদের দেওয়া টাকাতেই কলকাতা মেট্রো প্রতিদিন এক কোটির বেশি আয় করে। ফলে, লোকসানের গল্প শুনিয়ে কলকাতার জীবনরেখা স্বরূপ মেট্রোকে কিছু সাদা কলারের বাহন না করাই শ্রেয়।
সুব্রত দাস, দমদম