Breaking News

৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ মকুব জনগণের পকেটের টাকা পুঁজিপতিদের ভাণ্ডারে

চলতি আর্থিক বছরের প্রথমার্ধে অর্থাৎ ২০২৪-এর এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৪২ হাজার কোটি টাকারও বেশি অনাদায়ী ঋণ, হিসাবের খাতা থেকে মুছে দিয়েছে(রাইট অফ) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি। ৯ ডিসেম্বর লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে এ কথা জানান কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধরী। গত অর্থবর্ষেও (২০২৩-২৪) তারা মুছে দিয়েছিল ১.১৪ লক্ষ কোটি টাকার বকেয়া। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে এই অঙ্ক ছিল ১.১৮ লক্ষ কোটি টাকা। গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে সব ব্যাঙ্ক বকেয়া মুছেছে সেই তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। ৮,৩১২ কোটি টাকার ঋণ মুছেছে তারা। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (পিএনবি) ৮,০৬১ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া ৬,৩৪৪ কোটি টাকা এবং ব্যাঙ্ক অব বরোদা ৫,৯২৫ কোটি টাকার বকেয়া ঋণ মুছে দিয়েছে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির হিসাবের খাতা থেকে ১৫ লক্ষ ৩১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা মুছে ফেলা হয়েছে। (আর বি আই, সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা-১৫.০৪.২০২৪)

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির এই লাগাতার বকেয়া ঋণ মুছে দেওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। মুছে দেওয়া ঋণের সিংহভাগ যে এ দেশের ধনকুবের গোষ্ঠীদের নেওয়া ঋণ তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই টাকা আসলে সাধারণ মানুষের, যাঁদের কষ্টার্জিত অর্থে তিল তিল করে গড়ে ওঠে ব্যাঙ্কের আমানত। সেই আমানত থেকে যাবতীয় ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা জন্মায় ব্যাঙ্কগুলির। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে জমা টাকার পরিমাণ প্রায় ১১৮ লক্ষ কোটি, যার ৮০ শতাংশেরও বেশি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের। সেই টাকা এভাবে বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধনকুবেরদের মধ্যে! এই ঘটনা ঋণখেলাপির প্রবণতাও বাড়িয়ে তুলছে বৃহৎ ব্যবসায়ীদের মধ্যে।

ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক সব সময়ই কি এত উদার? একেবারেই তা নয়। সাধারণ গ্রাহকরা এক-দু লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে একটু দেরি করলে ব্যাঙ্ক তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। আদায়ের জন্য পিছনে পুলিশ লাগায়। কিন্তু বৃহৎ পুঁজিপতিদের বেলায় তাদের অন্য রূপ। হিসাবের খাতা থেকে ১৫ লক্ষ ৩১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা মুছে ফেলা হয়েছে। বকেয়ার যাবতীয় তথ্য উধাও করে দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাঙ্কের স্বার্থের বিনিময়ে কাদের স্বার্থ দেখছে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তথা কেন্দ্রীয় সরকার তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অন্য দিকে ব্যাঙ্কগুলি এর ফলে যে আমানত হারাচ্ছে, তা পূরণ করতে প্রতিটি বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্কগুলির জন্য বরাদ্দ করছে। অথচ এই টাকা জনগণের উন্নয়নে কাজে লাগতে পারত। শিক্ষা-স্বাস্থ‌্যে বরাদ্দ করা যেত। অপর দিকে দেখা যাচ্ছে, প্রয়োজনমতো কর্মী নিয়োগ করে ব্যাঙ্কের গ্রাহক পরিষেবার মান উন্নত করার কোনও প্রয়াস নেই। স্থায়ী কাজে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’-এর খাঁড়া ঝুলিয়ে অল্প পারিশ্রমিক দিয়ে তাদের থেকে যত বেশি সম্ভব কাজ আদায় করার প্রক্রিয়া পুরোদস্তুর বলবৎ রয়েছে। গ্রাহক পরিষেবার মান ক্রমশ নিম্নগামী হলেও সাধারণ গ্রাহকদের পরিষেবা শুল্কের ক্ষেত্র এবং পরিমাণ বাড়িয়ে তাদের উপর বাড়তি আর্থিক বোঝা চাপানো হচ্ছে।

এ ভাবে ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ বা অনাদায়ী ঋণ খাতা থেকে মুছে দিয়ে হিসাবের খাতাকে আপাত পরিষ্কার দেখানোর পিছনে কোন হিসাব কাজ করছে? অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলছেন যে মুছে দেওয়া অর্থও আদায়ের চেষ্টা চলে। চলে, কিন্তু তাতে তো বড় অংশের টাকা অনাদায়ীই থেকে যায়! আসলে মুছে দিয়ে ব্যাঙ্কের খাতা কিছুটা পরিষ্কার রাখলে সেই ব্যাঙ্ক কিনতে আগ্রহী হবে ক্রেতারা। কোন ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করতে এ হেন পদক্ষেপ? ধনকুবের যে পুঁজিমালিকরা যারা ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে পরিশোধ করছে না, তারাই এ সব ব্যাঙ্কের সরকারি শেয়ার কিনে ব্যাঙ্কের মালিক হবে। সাধারণ মানুষের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত বিপুল অর্থ-লগ্নির নিয়ন্ত্রক হবে তারাই। সে কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির এ জাতীয় পদক্ষেপে ধনকুবেরদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকারের পূর্ণ সম্মতি দেখা যাচ্ছে।

এই পথেই নতুন করে দেশের সাধারণ মানুষের সম্পদ ধনকুবেরদের সিন্দুকে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। এই ঘটনা আবারও নগ্নভাবে দেখাচ্ছে সরকার এবং ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ উভয়েরই লক্ষ্য সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ, যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ব্যাঙ্ক কর্মচারী সহ সমস্ত সাধারণ মানুষকে।