সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতিদের গ্রন্থাগারে ন্যায়বিচারের নতুন মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মূর্তিটির চোখ খোলা, এক হাতে ন্যায়বিচারের দণ্ড, অন্য হাতে সংবিধান। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় তাঁর অবসরের প্রাকমুহূর্তে মূর্তির উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, আদালত ও তার বিচারের নিরপেক্ষতার ধারণাটিকে নতুন করে মর্যাদা দেওয়ার জন্যই এই নতুন মূর্তির কল্পনা। বলেছেন, ‘আইন দৃষ্টিশক্তিহীন নয়, তা সবাইকে সমান ভাবে দেখে।’ উল্লেখ্য, আগে মূর্তির চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল, এক হাতে ছিল ন্যায়বিচারের দণ্ড, অন্য হাতে তরবারি। এই মূর্তিটির তাৎপর্য ছিল, বাদি-বিবাদি কাউকে না দেখে পক্ষপাতহীন রায় দেবেন বিচারক।
নতুন ন্যায়মূর্তি প্রতিষ্ঠাকে কেউ কেউ বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের অভিনব কীর্তি হিসাবে দেখছেন। ন্যায়মূর্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে ইতিহাস যাই থাকুক, চোখ বাঁধা ও চোখ খোলা মূর্তির মধ্যে তাৎপর্য যারই বেশি হোক, সেই আলোচনায় না গিয়ে স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে, আমাদের দেশে আইন কি সত্যিই সকলকে সমানভাবে দেখে?
প্রতীকী মূর্তি সামনে রেখে আদালতে বিচারপতিরা মামলার রায় ঘোষণা করেন, বিচারপ্রার্থীরাও নিরপেক্ষ বিচারের আশা করেন। কিন্তু নিরপেক্ষতার মানে এ ক্ষেত্রে কী? নিরপেক্ষতার মানে হল, আইনের ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থরক্ষার কথা না ভাবা। কিন্তু আইন তৈরি হয় যে আইনসভায় তা একটি বিশেষ শ্রেণির রাষ্ট্রের অঙ্গ। ফলে আইন সেই ক্ষমতাসীনের পক্ষেই তৈরি হয়। তাই দেখা যায় সকলের জন্য সমান যে আইনের কথা বিচারব্যবস্থায় শোনা যায় সেই আইন ‘রাজার হস্তে কাঙালের ধনচুরি’কে মান্যতা দেয়। উন্নয়নের নামে কৃষককে পিটিয়ে জমি থেকে উচ্ছেদ করলেও সেটা ‘আইন’ মেনেই হয়। ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে মালিকরা ১০-১২ ঘণ্টা খাটালেও তা-ও হয় ‘আইন’ মেনে।
কিছুদিন আগে অযোধ্যা মামলার রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ বলেছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগই এই রায় দিতে বাধ্য করেছে। তা হলে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথাই আদালত ভাবে, তা হলে যখন বিজেপি সরকার সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকের স্বার্থবিরোধী লেবার কোড চালু করল, তার বিরুদ্ধে এই আদালতকে তো একটা কথাও বলতে দেখা গেল না? মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বে জেরবার হয়ে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বর্তমানে যখন দিশেহারা, তখন বিচারপতিদের একটা বাক্যও উচ্চারণ করতে দেখা যায় কি!
ফলে বিচারপতিরা যাই বলুন, আইনকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থে ব্যবহারের কথা আসলে কথার কথাই। বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ বহুদিন আগেই বলেছিলেন, ভারতের মতো একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে কোনও কিছু আইনসঙ্গত হলেই তা ন্যায়সঙ্গত না-ও হতে পারে। আবার যা ন্যায়সঙ্গত, তা আইনসঙ্গত না-ও হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, মালিকদের স্বার্থকে লক্ষ রেখে কেন্দ্রীয় সরকার নয়া শ্রমকোডের মধ্য দিয়ে যখন শ্রমিকের অর্জিত অধিকারগুলি কেড়ে নিল, তা যদি আইনসঙ্গতও হয়, ন্যায়সঙ্গত কখনও নয়। আবার এর বিরুদ্ধে শ্রমিকদের প্রতিরোধ আন্দোলন আইনসঙ্গত না হলেও তা অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত।
আইনের বইয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ দেখার কথা বড় বড় করে লেখা থাকলেও বাস্তবে তা কি দেখা হয়? বর্তমান ব্যবস্থায় এই আইনি কাঠামোর সুবিধা ভোগ করে বিত্তশালীরা, বঞ্চনা-প্রতারণার শিকার হয় গরিব জনসাধারণ। এ ছাড়া বিচারব্যবস্থার ভেতর রয়েছে অসংখ্য ফাঁক। দুঁদে আইনজীবীদের হাতে পড়ে সেই সব আইনি ফাঁক গলে সাধারণ মানুষের বদলে প্রভাবশালীদের স্বার্থ রক্ষা হয়। এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনি ব্যবস্থাটাই এমন যে, যাদের আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে তারাই শুধুমাত্র বিচারপ্রার্থী হতে পারে। সাধারণ আয়ের বেশিরভাগ মানুষ বিশাল খরচের কথা ভেবে অনেক সময় আইন-আদালত এড়িয়ে চলতে বাধ্য হন। নিম্ন আদালতে সাধারণ মানুষ যদি বা পৌঁছতে পারে, উকিল-ব্যারিস্টারের লক্ষ লক্ষ টাকা ফি জুগিয়ে উচ্চ আদালতে পৌঁছনো আর তাদের হয় না। তাই ন্যায়বিচার তো অনেক দূরের কথা, বিচারব্যবস্থার রুদ্ধদ্বারে মাথা খোঁড়া ছাড়া সাধারণ মানুষের উপায় থাকে না। পাহাড়প্রমাণ টাকার কাছে বিকিয়ে যায় আইনি ব্যবস্থা-বিচার ব্যবস্থা। বাস্তবে আইনের শাসনের অর্থ দাঁড়ায় টাকার শাসন। এর নাগাল পান কতজন?
বহু ক্ষেত্রে শাসক বা ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালীদের পক্ষেই যায় আদালতের রায়। তার জন্য সত্যকে গোপন করে এবং মিথ্যেকে সত্য হিসাবে উপস্থাপনা করে সুবিধামতো তথ্য ও যুক্তি সাজিয়ে বিচারের পথে বাধা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হয় অনবরত। বহু সময়েই রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং টাকার থলি নিয়ন্ত্রণ করে বিচারপ্রক্রিয়াকে। এর সাথে নানা ভাবে বিচারপ্রক্রিয়াকে দীর্ঘ করা হয়। ফলে সময়ের সাথে সাথে বহু তথ্যপ্রমাণ নষ্ট হয়, এমনকি কোনও বিচারপ্রার্থীর জীবদ্দশাতেও বিচার সম্পন্ন হয় না। ‘জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড’ কথাটার যন্ত্রণাময় উপলব্ধি ঘটে বিচারপ্রার্থীর।
অন্যদিকে বৃহৎ পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে বিচার ঝুলিয়ে রেখে তাদের কার্যত ছাড় দেওয়া হয়। মার্কিন সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট অনুযায়ী, আদানিদের শেয়ার দরে জালিয়াতি ও সৌর বিদ্যুতে ঘুষ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। অথচ শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি কিংবা কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার নানা অজুহাতে গড়িমসি করায় তদন্ত বিশ বাঁও জলে। শাসক-ঘনিষ্ঠ বহুজাতিক আদানি গোষ্ঠী ও শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ যখন ওঠে এবং সেই তদন্তের হাল যদি এই হয়, বিচারব্যবস্থা কি খোলা চোখে তা দেখতে পারল? দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বিচারের চোখটা কিন্তু বুজেই থাকছে!
গুজরাটে সন্তানসম্ভবা বিলকিস বানো ধর্ষণ ও হত্যা মামলার কথা ধরা যাক। তাঁর এক শিশুসন্তান সহ পরিবারের ৮ সদস্যকে হত্যা এবং তাঁকে দলবদ্ধ ভাবে পৈশাচিক ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীরা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২০২১-এ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও গুজরাট হাইকোর্ট ২০২২ সালে ১১ জন অভিযুক্তকে মুক্তি দেয়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তারা ছাড়া পেয়ে যায় কী করে? তাদের মুক্তির পর বিজেপি নেতাদের বিজয় মিছিল করতে দেখে বোঝা যায়, কাদের অঙ্গুলিহেলনে এই রায়। এখানে হাইকোর্টের ন্যায়মূর্তি কি বিশেষ দিকেই তাকিয়ে থাকেনি!
যে কোনও রাষ্ট্রের অন্যতম একটি স্তম্ভ হল বিচারব্যবস্থা। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন শাসক শ্রেণির সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা করাই রাষ্ট্রের কাজ। ফলে রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ বিচারবিভাগও তার বাইরে যেতে পারে না। আইন তৈরি হয় রাষ্ট্রের চরিত্র অনুযায়ী। রাষ্ট্রের মালিকানা যে শ্রেণির হাতে থাকে আইনের বিধিও তাকে রক্ষার উদ্দেশ্যেই মূলত রচিত হয়। তবে শাসক-শাসিতের যে অনিরসনীয় দ্বন্দ্ব ক্রমাগত সমাজে চলে, তার ফলে যাতে রাষ্ট্রটা ভেঙে না পড়ে তার জন্য শোষিত শ্রেণিকে কিছুটা স্বস্তি দিতেও কিছু আইন সংবিধানে স্থান পায়। এটাকেই ফলাও করে আইনের নিরপেক্ষতা বলে প্রচার করে শাসকরা।
কিন্তু বারেবারেই দেখা গেছে, শাসকের মুষ্টির ফাঁসে ন্যায়বিচার অবরুদ্ধ। সেজন্য ন্যায়মূর্তির চোখ বন্ধ রেখে নিরপেক্ষতার কথা বলা হোক বা চোখ খুলে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখার কথা বলা হোক, জীবনের দুঃসহ অভিজ্ঞতায় সাধারণ মানুষ দেখছেন, কার্যক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ন্যায়বিচার ভূলুণ্ঠিত, আদালত শোনে এবং দেখে মূলত ক্ষমতাশালীর কথাই। এ কথা আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন সচেতন মানুষ। ফলে প্রধান বিচারপতির নতুন পদক্ষেপে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে– শাসিতকে, সমাজের প্রান্তিক মানুষকে বিচারব্যবস্থা ন্যায়বিচার দিতে পারবে না জেনেই কি ন্যায়মূর্তির এই ভোল বদলানোর চমক?