১৫ অক্টোবর তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে স্যামসাং ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট কর্মীদের দীর্ঘ এক মাসের কর্মবিরতি বা ধর্মঘট প্রত্যাহৃত হয়েছে। তামিলনাড়ু সরকার বলেছে, কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট ও আন্দোলনকারী নেতাদের মধ্যে সফল আলোচনার মধ্য দিয়েই এই ধর্মঘট তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছেই। কারণ, শ্রমিকরা যে অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া তুলেছেন, বিশেষ করে বেতন বৃদ্ধি– তা কোম্পানির কাছে মান্যতা পাচ্ছে না। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হল স্যামসাং কর্তৃপক্ষ কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়নের স্বীকৃতি দিচ্ছে না। শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার স্বীকৃত। সেটাও কর্তৃপক্ষ মানছে না।
স্যামসাং দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বহুজাতিক কোম্পানি। উত্তরপ্রদেশের নয়ডায় তাদের একটি বড় প্ল্যান্ট রয়েছে। ২০০৭ সালে স্যামসাং তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে আরেকটি প্ল্যান্ট খোলে। সেখানে টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকন্ডিশনার ইত্যাদি তৈরি হয়। কর্মীসংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। আরও একটি কারখানা খোলার ব্যাপারে তামিলনাড়ু সরকারের সাথে চুক্তি হয়েছে তাদের। ভারতে পুঁজি বিনিয়োগ করে এখানকার সস্তা শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই স্যামসাং কোম্পানির এত মুনাফা এবং পুঁজির বৃদ্ধি ঘটেছে যে আরও এক কারখানা তারা তৈরি করতে যাচ্ছে। এই যে সম্পদ বৃদ্ধি, এর অবদান মূলত শ্রমিকদের। শ্রমিকদের বৌদ্ধিক শক্তি ও শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়েই তাদের এই সম্পদ বৃদ্ধি। অথচ সেই শ্রমিকরাই তীব্র বঞ্চনার শিকার।
স্যামসাং একটি বিদেশি কোম্পানি বলেই কি ভারতীয় শ্রমিকদের বেশি শোষণ করছে? নিজ দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমিকদেরকে কি সে বেশি সুবিধা দিচ্ছে? বিষয়টি আদৌ তা নয়। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির শোষণের জাতীয় চরিত্র আর থাকে না বললেই চলে। স্যামসাংয়ের মতো অতিকায় বাণিজ্যিক সংস্থারাই ১৯৬০ সাল থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। এরা শ্রমিকদের বেতন হ্রাস এবং কাজের তীব্রতা বৃদ্ধির সমন্বয় ঘটিয়ে নিজেদের মুনাফা আকাশছোঁয়া করে তুলছে। স্থায়ী চাকরি তুলে দিয়ে এরা চুক্তিপ্রথা চালু করেছে। চালাচ্ছে ব্যাপক আউটসোর্সিং। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত শোষণের শিকার দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমিকরা চাকরির নিশ্চয়তা হারিয়ে অত্যন্ত দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন।
একই পরিস্থিতি ভারতেও। কেন্দে্র বিজেপি পরিচালিত মোদি সরকার যে শ্রমনীতি এনেছে তার মূল কথাও এই। এটাই সব পুঁজিবাদী দেশের উৎপাদনের নীতি। অর্থাৎ সর্বোচ্চ মুনাফা করা এবং সেই লক্ষে্য উৎপাদন ব্যয় সর্বনিম্ন করা। উৎপাদন ব্যয় সর্বনিম্ন রাখতেই বেতন-বৃদ্ধির দাবি উপেক্ষা করে মালিকরা। ফলে শ্রমিক শোষণের ক্ষেত্রে বিশ্বের সব দেশের পুঁজিপতিদের মধ্যে রয়েছে অদ্ভুত মিল। স্বাভাবিকভাবেই একই শোষণের বিরুদ্ধে বিশ্বের সব দেশের শ্রমিকদের মধ্যে সংগ্রামের লক্ষ্য, উদ্দেশ্যেও মিল রয়েছে এবং এই কারণেই বিশ্বের সব দেশের শ্রমিকদের মধ্যে সমস্বার্থবোধ কাজ করে। এই সমস্বার্থবোধই তাদের মধ্যে পারস্পরিক মৈত্রী বন্ধন গড়ে তোলে।
স্যামসাং-এর মতো একচেটিয়া বহুজাতিক কোম্পানিগুলি শ্রমিকদের ঐক্যকে ভয় পায়। ভয় পায় মালিকদের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভের সম্মিলিত ভাবে ফুঁসে ওঠার সম্ভাবনাকে। তাই ইউনিয়নের কোনও স্বীকৃতি দেয় না। শ্রমিকদেরকে কাজের ভারে নুইয়ে রেখে ও অতি শৃঙ্খলার ফাঁদে আটকে তাদের চুপ করিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু ওদের বাঁধন যতই শক্ত হোক পুঁজি ও শ্রমের অনিরসনীয় দ্বন্দে্ব তা একদিন টুটবেই। তার গতিপথে শ্রমিক ধর্মঘটও অনিবার্য বাস্তবতা।