চড়া মূল্যবৃদ্ধিতেও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার নিশ্চুপ

মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বাজারে এসইউসিআই(সি)-র প্রচার চলছিল। দাম অসহনীয় জেনেও এক প্রবীণ ব্যক্তি বলে উঠলেন, দাম কেউ কমাতে পারবে না। কথাটা কানে আসতেই ভাবছিলাম, এমন মন্তব্য কেন? যে মানুষটি বাজার করতে গিয়ে চড়া দাম শুনে বিরক্ত হন, এ দোকান থেকে সে দোকান ঘুরেন একটু কমের আশায়, তিনি এমন কথা বললেন কেন? তবে কি তিনি এর সমাধান চান না?

আসলে তিনি তো দেখেই চলেছেন যে, মূল্যবৃদ্ধি অবিরাম ঘটছে। দীর্ঘ জীবনে তিনি এও দেখেছেন যে, বহুবার সরকার পরিবর্তন হলেও মূল্যবৃদ্ধিতে কোনও বিরতি নেই। কেন্দ্রে কংগ্রেস থেকে বিজেপি, রাজ্যে কংগ্রেস থেকে সিপিএম হয়ে বর্তমানে তৃণমূল শাসন, কারওরই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কোনও ভ্র+ক্ষেপ নেই। ফলে বহু সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্য।

কিন্তু শুধু চোখে দেখা বর্তমান অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেখলে এর উত্তর মিলবে না। বিষয়টিকে দেখতে হবে দেশের মধ্যে বিদ্যমান অথনৈতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে।

মূল্যবৃদ্ধি কেন হয়? কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির একটি কারণ বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হওয়া, উৎপাদন কম হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এই কারণটি সাময়িক। এইসব প্রাকৃতিক কারণের জন্য চাহিদা ও যোগানে ভারসাম্যের অভাবে দাম বৃদ্ধি সাময়িক ঘটনা। ফসল ঠিকমত হলে আবার দাম সাময়িক ভাবে কমে যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলেও যে দাম বাড়ে, তার কারণ কী?

পশ্চিমবঙ্গে এ বছর হিমঘরে আলু যথেষ্ট পরিমাণে মজুত রয়েছে। সম্প্রতি সাংবাদে প্রকাশ, এ রাজ্যে এখনও হিমঘরগুলিতে দশ লক্ষ টনেরও বেশি আলু মজুত আছে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে হিমঘর থেকে সে আলু বের করার কথা। এত আলু মজুত থাকা সত্ত্বেও কেন দাম বৃদ্ধি? সরকারি সূত্রের দাবি, কম পরিমাণে আলু বের করে বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করে বেশি দাম রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। অর্থাৎ কারণটা স্রেফ মজুতদারি।

বর্তমানে জ্যোতি আলু ৩৫-৩৬ টাকা কেজি দরে মানুষ কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এই যে মজুতদারি, এটাই তো আলুর মূল্যবৃদ্ধির কারণ। এটা কি আটকানো যেত না? সরকার তা করল না কেন? কার স্বার্থে করল না? সকলেইবোঝেন, বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, তাদের বিপুল মুনাফার স্বার্থে সরকার এ কাজে গেল না। জনগণকে খানিকটা স্বস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার সম্পূর্ণরূপে উদাসীন। মূল্যবৃদ্ধি রদের জন্য রাজ্য সরকারের টাস্ক ফোর্স-এর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া দায়।

কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে শুধু তরিতরকারির দাম বেড়েছে ৪২.১৮ শতাংশ। এর মধ্যে টমেটোর মূল্যবৃদ্ধির হার ১৬১.৩ শতাংশ, পেঁয়াজ ৫১.৮ শতাংশ। একদিকে খাদ্যপণ্যের এই অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি, অন্য দিকে মধ্যবিত্তের রোজগার বাড়েনি। বরং বহু ক্ষেত্রে মজুরি কমেছে। আর নিম্নবিত্ত গরিবদের আর্থিক সঙ্গতি একেবারেই তলানিতে। এই অবস্থায় খাদ্যপণ্যের ৪২ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির ফলে রোজগারের সিংহভাগ এখানেই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে অন্য দ্রব্যের কেনাকাটা বা বিক্রি-বাটায়। এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকারের হাতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন-১৯৫৫ ছিল। তার বর্তমান অবস্থাটা কী? মোদি সরকার ২০২০ সালে মজুতদারদের স্বার্থে এই আইন সংশোধন করেছে। এই সংশোধনীতে দানাশস্য, আলু, ডাল, পেঁয়াজ, তৈলবীজ, ভোজ্যতেল সহ নানা পণ্য এই তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে, যার ফলে কালোবাজারিরা, মজুতদাররা যথেচ্ছ মজুত করে কৃত্রিম অভাব তৈরি করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফরোয়ার্ড ট্রেডিং বা শেয়ার মার্কেটে ফসল নিয়ে আগাম বাণিজ্যের নামে ফাটকার কারবার। কংগ্রেস এই নীতি চালু করে গিয়েছিল, বিজেপি তাকে আরও মদত দিয়েছে। ফলে মাঠে ফসল থাকতে থাকতেই ফাটকার কারবারিরা আগাম তার দাম বাড়িয়ে নির্ধারণ করে রাখতে পারছে। কৃষিপণ্যে বিশেষত খাদ্যপণ্যে যত বৃহৎ পুঁজির ব্যবসা বাড়ছে তত সাধারণ চাষির হাত থেকে ফসলের অধিকার চলে যাচ্ছে। ফলে এই বৃহৎ ব্যবসায়ীচক্র এখন অমোঘ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

বিভিন্ন সমীক্ষা দেখাচ্ছে, বাজারের খরচ কাটছাঁট করতে অনামি সংস্থার সাবানের গুঁড়ো, বিস্কুট, চাওমিনের প্যাকেট, কম দামি টুথপেস্ট ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। বিক্রি-বাটায় ভাঁটার টান টের পাচ্ছে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য সংস্থাগুলি যারা মোড়কজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে।

অর্থাৎ একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, অন্য দিকে তার সাথে সঙ্গতি রেখে বেতন বৃদ্ধি, আয় বৃদ্ধি না হওয়াতে মধ্যবিত্তের একটা বিরাট অংশ নিম্নবিত্তে নেমে যাচ্ছে। এর ফল হচ্ছে শিল্পের বাজার সংকুচিত হচ্ছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভূত ফল পুঁজিবাদী বাজারকেই বিপন্ন করে তুলছে। সংবাদপত্রগুলি ও লিখছে, এটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির অশনিসংকেত। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের মাসিক রিপোর্টেও বলা হয়েছে, শহরে চাহিদা কমছে।

বাস্তবে মূল্যবৃদ্ধি রোধ নিয়ে বিজেপি কংগ্রেস সিপিএম টিএমসি ইত্যাদি দলগুলির কোনও নির্দিষ্ট বক্তব্য বা চিন্তাধারা নেই। এসইউসিআই(সি) মূল্যবৃদ্ধি রোধে সুনির্দিষ্টভাবে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালুর দাবি তুলে ধরেছে এবং তা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলছে। এই পুঁজিবাদীব্যবস্থার মধ্যেও মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা রোধ করতে হলে এটাই একমাত্র রাস্তা।