Breaking News

ধনকুবেরদেরই বিশ্বস্ত প্রতিনিধি ট্রাম্প, আমেরিকার জনগণের আশা করার কিছু নেই

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার ঘটনায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। ফলাফলের পূর্বাভাসে ‘বিশেষজ্ঞ’রা খুব বেশি হলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছিলেন, এমন সাইক্লোনিক জয়ের কথা অনেকেই ভাবতে পারেননি। অথচ মার্কিন সমাজ জুড়ে তার লক্ষণ স্পষ্ট ছিল। মানুষের প্রতিক্রিয়াও ছিল দ্ব্যর্থহীন। অনেকেই তা পড়তে চাননি। মনকে চোখ ঠেরেছেন তাঁরা।

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বে জর্জরিত মার্কিন জনগণ। আর্থিক বৈষম্য বেড়েই চলেছে। কোভিড অতিমারির ভয়ঙ্কর আক্রমণে বিধ্বস্ত অর্থনীতির বিরাট বোঝা চেপে বসেছে জনগণের ঘাড়ে। মানুষ মুক্তি চাইছে এ সব কিছুর থেকে। কে দেবে মুক্তি! প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমলেই তো এই বোঝা চেপেছে তাদের ঘাড়ে। ত্রাতা সেজে আবির্ভূত হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বললেন, বাইডেন সরকারই তোমাদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী। আমাকে জেতাও, আমি তোমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেব। মানুষ ভুলে গেল আগের বারের ট্রাম্প-শাসনে তাদের দুর্দশার কথা।

প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি

ট্রাম্প বললেন, তোমাদের বেকারত্বের জন্য দায়ী অভিবাসীরা। অবৈধ অভিবাসীদের আমি ঘাড়ধাক্কা দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেব। খুশি হল দেশের বিরাট বেকার বাহিনী, কাজ হারানোর আতঙ্কে আড়ষ্ট শ্রমিকরা। তিনি বললেন, আমেরিকা আমেরিকানদের জন্য। খুশি হল গ্রামের শ্বেতাঙ্গ কৃষকরা, শহরের শ্রমিকরা– যারা তাদের আর্থিক দুরবস্থার জন্য অভিসম্পাত দেয় অশ্বেতাঙ্গদের, মনে করে আমেরিকা দেশটা আসলে তাদেরই। ট্রাম্প বললেন, আপনারা ট্যাক্স দেন, আর সেই ডলার দেশের উন্নয়নের কাজে না লাগিয়ে বাইডেন সরকার ঢালে ইউক্রেন, ইজরায়েলে যুদ্ধের পিছনে। আমি ক্ষমতায় এলে যুদ্ধ বন্ধ করব। আমার সরকার যুদ্ধের পিছনে টাকা ঢালা বন্ধ করবে। খুশি হল দেশের মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত সাধারণ মানুষ। খুশি হল প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের একতরফা আক্রমণে নিহত হাজার হাজার প্যালেস্টিনীয় মানুষের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মুসলিম এবং গণতান্ত্রিক মনোভাবের মানুষেরা। ট্রাম্প বললেন, তিনি ক্ষমতায় এলে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হবে। খুশি রক্ষণশীল খ্রিস্টান সমাজ। ট্রাম্প দেশের মানুষকে বোঝালেন, তাদের দুরবস্থার জন্য দায়ী বাইডেন সরকারের অর্থনীতি। বললেন, আমাকে ভোট দিলে চড়া আমদানি শুল্ক বসাব। তাতে বিদেশি পণ্য দেশের বাজারে ঢোকা বন্ধ হবে। দেশীয় শিল্প চাঙ্গা হবে। কাজ পাবে দেশের মানুষ। এমন সংখ্যাহীন প্রতিশ্রুতি নির্বাচনী সভাগুলিতে নির্বিচারে বিলিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর বত্তৃতা শুনে খুশি হয়ে ফিরে গেছে সব স্তরের সংকটজর্জরিত মানুষ। ঢেলে ভোট দিয়েছে ট্রাম্পকে।

ট্রাম্পের পাশে মার্কিন ধনকুবেররা

মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও আর্থিক বৈষম্য এ বার মার্কিন ভোটারদের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে ছিল। সেগুলিকেই প্রচারে তুরুপের তাস করেছিলেন ট্রাম্প। বাস্তবে ডেমোক্র্যাট দল, নির্বাচনে যার প্রার্থী ছিলেন কমলা হ্যারিস আর রিপাবলিকান দল, যার প্রার্থী ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প– এই দুই দলই মার্কিন একচেটিয়া পুঁজির অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য স্বার্থরক্ষাকারী দল। তাই মার্কিন একচেটিয়া পুঁজিপতিরা এই দুই দলের নির্বাচনী তহবিলেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢেলেছে। কিন্তু সংকটজর্জরিত, ঋণগ্রস্ত, মন্দা-আক্রান্ত মার্কিন পুঁজিপতি শ্রেণির দরকার ছিল একজন ‘শক্তিশালী’ পুরুষ, যিনি গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করেন না, যিনি সংকট জর্জরিত জনতাকে নানা মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে মোহগ্রস্ত করতে পারবেন, ধনকুবেরদের দেদার করছাড় আর রাষ্ট্রীয় মদতের স্বর্গরাজ্য গড়ে দেবেন। তাই তাদের মনের মতো প্রার্থী রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্পই ধনকুবেরদের সমর্থন পেলেন সবচেয়ে বেশি। তেল, ওষুধ এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রের দানবীয় কর্পোরেটরা দেদার ডলার ঢালতে থাকল ট্রাম্পের প্রচারে। মার্কিন শীর্ষ ধনকুবের, সমাজমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম এক্স এবং টেসলার কর্ণধার ইলন মাস্ক ট্রাম্পের নির্বাচনী ফান্ডে যেমন বিপুল অর্থ ঢেলেছেন তেমনই প্রকাশ্যে ট্রাম্পের হয়ে প্রচারে নেমেছেন। নির্বাচনের ফল না বেরোতেই মাস্কের শেয়ারের দাম এক লাফে ১৪ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। শেয়ারের দাম বেড়েছে আর এক ধনকুবের জেফ বেজোসেরও। অর্থাৎ জনতার জন্য মূল্যবৃদ্ধি রোধ না হলেও, কর্মসংস্থানের কোনও দিশা না পেলেও মার্কিন ধনকুবেরদের সম্পদ এখনই লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। তাই ট্রাম্প যখন নির্বাচনী প্রচারে ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান তুলেছেন, বেকারি, গরিবি, বৈষম্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা না মেলার মতো সমাজের মৌলিক সমস্যাগুলির জন্য কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসী মানুষকে দায়ী করে বিজ্ঞানবিরোধী, যুক্তিহীন, দক্ষিণপন্থী, বর্ণবিদ্বেষী আধিপত্যবাদের উস্কানি দিয়ে দেশের শ্বেতাঙ্গ সমাজের বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ ব্যাপক অংশটিকে ক্রমাগত উত্তেজিত করে তুলেছেন সেই কাজে ট্রাম্পকে পুরো মদত দিয়েছে কর্পোরেট পরিচালিত মার্কিন মিডিয়া। সেই প্রচারে ভুলে মানুষ বিশ্বাস করেছে ট্রাম্প মানেই সব সমস্যার সমাধান।

শুধুই মিথ্যাচার

ট্রাম্প কী ভাবে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করবেন, কী ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবেন আর কী ভাবেই বা আমেরিকাকে ফের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ করে তুলবেন তার কোনও দিশা তাঁর নির্বাচনী বত্তৃতাগুলির কোথাওই ছিল না। বাস্তবে বীভৎস আর্থিক বৈষম্য, ব্যাপক বেকারি ও চরম গরিবির মতো যে সমস্যাগুলিতে মার্কিন সমাজ হাবুডুবু খাচ্ছে, তার সমাধান বর্তমান মুমূর্ষু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে কারও পক্ষেই করা সম্ভব নয়, তা সে দেশ যত ধনীই হোক না কেন। পুঁজিবাদের অনিবার্য নিয়মেই এই সব সংকটের জন্ম। পুঁজিবাদের একনিষ্ঠ সেবক হিসাবে পুঁজিবাদকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করে তোলার প্রচেষ্টার মধ্যে তার সমাধান নেই। পুঁজিবাদের নিয়মেই বাইডেনের শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, ছাঁটাই, দারিদ্র বৃদ্ধি, পুঁজিপতি শ্রেণির বিপুল সম্পদবৃদ্ধি, সমাজ জুড়ে অপরাধের বাড়বাড়ন্ত সব কিছুই সাধারণ মানুষকে বাইডেন শাসনের বিরোধী করে তুলেছে। কিন্তু মূল নীতিগত ক্ষেত্রে যেহেতু বাইডেন শাসনের সাথে ট্রাম্প শাসনের কোনও ফারাক নেই, তাই জনজীবনের সমস্যাগুলি সমাধানে একই ভাবে ব্যর্থ হবেন ট্রাম্পও। বরং চরম দক্ষিণপন্থী ট্রাম্প-শাসন সেগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং ট্রাম্প সম্পর্কে জনগণের মোহও অতি দ্রুতই ভেঙে পড়বে। কিন্তু জনগণ যদি তাদের দুদর্শার আসল কারণ যে পুঁজিবাদী শোষণ, তার চরিত্র সম্পর্কে সচেতন না হয়, মার্কিন পুঁজিপতি শ্রেণির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র ধরতে না পারে, তবে আবার ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ যখন বাড়তে থাকবে, এই পুঁজিপতিরাই ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে লাগাতার প্রচার দিয়ে দিয়ে মানুষের সামনে তাদের গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। সেই প্রচারে মানুষ আবার ভুলবে। পুঁজিবাদী দেশে দেশে এই জিনিসই চক্রের আকারে ঘটে চলেছে। পুঁজিবাদী সংসদীয় গণতন্ত্রের এটাই বৈশিষ্ট্য।

শান্তির মিথ্যা আশ্বাস

ট্রাম্প মুখে যতই শান্তির কথা বলুন, বাস্তবে শান্তি আনা তাঁর কর্ম নয়। সংকটগ্রস্ত মার্কিন পুঁজিপতি শ্রেণির কাছে শান্তি বাস্তবে আত্মহত্যা। কারণ অস্ত্রের উৎপাদন এবং তার ব্যবসাই এখন মার্কিন অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। তাই ভোটের প্রচারে ট্রাম্প যতই শান্তির বুলি আওড়ান, তাতে যেমন অস্তে্রাৎপাদক মার্কিন ধনকুবেররা বিভ্রান্ত হননি, তেমনই তাঁর জয়ে ইজরায়েলের যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের থেকে যুদ্ধে যাবতীয় সাহায্য অব্যাহত রাখার আশ্বাস পেয়ে গিয়েছেন। আবার এই নির্বাচনে ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় মদতদাতা মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্কও ইউক্রেনে তাঁর সংস্থা স্টারলিঙ্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিষেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অর্থাৎ যুদ্ধ থামানোর কোনও ইচ্ছা বা উপায় ট্রাম্পের হাতে নেই। কারণ পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ আজ অত্যন্ত প্রয়োজন। যুদ্ধ থামানোর জন্য যে মানসিকতা, যে গণতান্ত্রিক, মানবিক, বিদ্বেষমুক্ত মন দরকার তা মার্কিন একচেটিযা পুঁজির একনিষ্ঠ সেবক ট্রাম্পের নেই। আর তা থাকলে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেই পারতেন না।

কর্মসংস্থানের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি

কৃষ্ণাঙ্গ আর অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে কিংবা মেক্সিকো বর্ডারে প্রাচীর তুলে আমেরিকায় বেকার সমস্যার সমাধান করা যাবে না। মেক্সিকান বা অন্য অবৈধ অভিবাসীরা মূলত কৃষি শ্রমিক, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণের মতো কাজগুলি করেন, যা সাধারণত স্থানীয় শ্বেতাঙ্গরা করেন না। অর্থাৎ নিজেদের প্রয়োজনেই মার্কিনীরা এই সব শ্রমিকদের কাজে লাগান। আর বৈধ অভিবাসীদেরও মার্কিন পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই আইনি অভিবাসন দেয়। বাস্তবে কর্মসংস্থানের মূল সমস্যাটা অনেক গভীরে– পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই শিকড় গেড়ে রয়েছে। বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদী আর্থিক বাজারে প্রবল সংকট চলছে। চিন, জাপান, রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে মার্কিন পুঁজি-বাজারের সামনে। মার্কিন ধনকুবেররা উৎপাদন খরচ কমাতে বিশ্ব জুড়ে আউটসোর্সিং করছে। মার্কিন শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছে। তাই ট্রাম্প যতই বলুন, তিনি উৎপাদন শিল্পের উপর জোর দেবেন, আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে বিদেশ থেকে দেশে পণ্য ঢোকা আটকাবেন, সেটা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। আমেরিকা শুল্ক প্রাচীর তুললে প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিও একই পথে হাঁটবে– মার্কিন পণ্যের রফতানিতে আঘাত করবে। তা ছাড়া সস্তা পণ্য আজ আর শুল্ক প্রাচীর দিয়ে আটকে রাখা যায় না। তা হলে বাইডেন প্রশাসনও সেই চেষ্টা করে দেখত। পুঁজিবাদী এই শাসকরা আজ এমন সঙ্কটে পড়েছে যে তাদের একদা বিশ্বায়ন তত্ত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে এখন শুল্ক-প্রাচীরের হুমকি দিতে হচ্ছে।

শোষণ আরও নির্মম হবে

ট্রাম্পের দ্বিতীয় বারের জয় মার্কিন জনগণের জন্য হবে আরও নির্মম। বর্ণবিদ্বেষ, নারী বিদ্বেষ আরও বাড়বে। গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরাচার আরও শক্তিশালী হবে। নব্য ফ্যাসিস্টদের উত্থান আরও বেশি করে ঘটবে। আপাদমস্তক পুরুষতান্ত্রিক ট্রাম্প শাসনে আমেরিকায় মহিলারা আরও বেশি বিদ্বেষের শিকার হবেন, আরও স্বাধীনতা হারাবেন। গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার পক্ষে ট্রাম্পের সওয়াল তার যেমন জ্বলন্ত উদাহরণ, তেমনই পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যনিয়েলসকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য ১ লক্ষ ৩০ হাজার ডলার ঘুষ দেওয়াও তার প্রমাণ। পুঁজিবাদী শোষণ, নিষ্পেষণ আরও বেশি চেপে বসবে মার্কিন শ্রমজীবী মানুষের ঘাড়ে। সামরিক যুদ্ধ ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইনের মতো আরও বেশি বেশি দেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে। আরও বেশি বেশি সংখ্যায় মানুষ যুদ্ধের শিকার হবে। মার্কিন আগ্রাসনে দুর্বল দেশগুলিতে যতটুকু গণতন্ত্র অবশিষ্ট আছে তা-ও হারাবে। আরও বেশি কর চাপবে মার্কিন সাধারণ জনগণের ঘাড়ে। বিপুল করছাড় পাবে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোসের মতো কয়েক শত ধনকুবের। শোনা যাচ্ছে, ধনকুবেরদের তাঁকে বিপুল সমর্থন দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে কর্পোরেট কর ৬ শতাংশ কমিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি ইতিমধ্যেই দিয়ে রেখেছেন।

পরিবেশের প্রশ্নে ট্রাম্পের মনোভাব বিশ্ব উষ্ণায়নকে কমাতে বাধা হিসাবে কাজ করবে। ট্রাম্প মনেই করেন, ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার তত্ত্ব একটা ভাঁওতা। গতবার প্রেসিডেন্ট পদে বসেই এই সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকাকে বের করে নিয়েছিলেন তিনি।

এই কি গণতন্ত্রের স্বর্গরাজ্য

বস্তুত ট্রাম্প প্রথম নন, মার্কিন সমাজে বিদ্বেষের বীজ বোনার কাজ বহু আগেই শুরু করেছেন তাঁর পূর্বতন শাসকরা। আগে যে আড়ালটুকু ছিল, পুঁজিপতি শ্রেণির ত্রাতা হিসাবে চ্যাম্পিয়ন সাজতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সে সব ছুঁড়ে ফেলে একেবারে নগ্ন ভাবে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী বর্ণবিদ্বেষ, অভিবাসী বিদ্বেষের় আগুন উস্কে দিয়েছেন। গণতন্ত্রের প্রতি বরাবরই প্রবল বিরাগ ট্রাম্পের। ২০২০-এর নির্বাচনকে ‘ভুয়ো’ বলে দাবি করেছিলেন ট্রাম্প। একের পর এক মামলাও ঠুকেছিলেন। তাঁর উস্কানিমূলক বত্তৃতার জেরে ২০২১-র ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে অবস্থিত আমেরিকার আইনসভায় হামলা চালান তাঁর সমর্থক বর্ণবিদ্বেষী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী কয়েকশো জনতা। তাতে নিহত হয়েছিলেন ছ’জন, জখম হয়েছিলেন ১৭৪ জন পুলিশ অফিসার। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চৌত্রিশটি ফৌজদারি অভিযোগ রয়েছে। তাঁর গণতন্ত্রের এমনই বহর যে তিনি এ বার নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, নির্বাচনে হারলেও সে বার তাঁর হাউস ছাড়া উচিত হয়নি। হায়, একদা গণতন্ত্রের জননীস্বরূপা আমেরিকা! একদিন তোমারই এক মহান সন্তান আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন– গণতন্ত্রে সরকার হল, অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য পিপল। সেই আমেরিকাতেই বুশ-ওবামা-বাইডেন-ট্রাম্পরা মিলে আজ সরকারের মানে দাঁড় করিয়েছে–অফ দ্য মনোপলিস্ট, বাই দ্য মনোপলিস্ট অ্যান্ড ফর দ্য মনোপলিস্ট। লিঙ্কনের আমেরিকাই আজ এক চরম অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, লম্পট ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করল। সভ্যতার কত বড় অধঃপতন!

ট্রাম্প-মোদিদের বন্ধুত্ব শ্রেণিগত

এ হেন ট্রাম্পের জয়ে উল্লসিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ট্রাম্পের সঙ্গে পুরনো ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘চলুন একসঙ্গে কাজ করি।’ ভারতেও বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে দক্ষিণপন্থার। আমেরিকার মতোই ভারতের মাটিতেও একচেটিয়া ধনকুবের গোষ্ঠীগুলি মদত দিচ্ছে দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলিকে। প্রচার দিচ্ছে, অর্থ জোগাচ্ছে। মোদি ও তাঁর দলবল ট্রাম্পের মতোই জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে আড়াল করতে মুসলিম অনুপ্রবেশকেই দায়ী করেন, কুসংস্কার, উগ্র জাতীয়তা ও ধর্মবিদ্বেষে উস্কানি দেন, সংকটে জর্জরিত সাধারণ মানুষের ঐক্য নষ্ট করার অপচেষ্টা চালান। বর্ণবিদ্বেষী, স্বৈরাচারী ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির আদর্শগত এই মিল, আসলে তাঁদের শ্রেণিগত মিল, যা তাঁদের মিলিয়ে দিয়েছে। চিন সম্পর্কে ট্রাম্পের কট্টর মনোভাব বিজেপি নেতাদের খুশি করেছে। যদিও অভিবাসীদের নিয়ে ট্রাম্পের কড়াকড়িতে ভারতীয় সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি কর্মীদের এইচ-১বি ভিসা পেতে সমস্যা হলে তা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে শিক্ষিত ভারতীয়দের আমেরিকায় কাজ পেতে খুবই অসুবিধায় ফেলবে। গত এক বছরে ১১০০ জন ভারতীয় অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে ভারতে ফেরত পাঠিয়েছে আমেরিকা। কড়াকড়ি হলে সংখ্যাটা আরও বাড়তে থাকবে।

তা ছাড়া বর্তমানে ভারতের আমেরিকা থেকে আমদানির পরিমাণ ৭৫ বিলিয়ন ডলার। রফতানি ১২৫ বিলিয়ন ডলার। আমদানি শুল্কের পরিমাণ বাড়লে ভারতীয় পণ্যের রফতানি মার খাবে। ট্রাম্পের জয়ে বিজেপি নেতাদের এই উল্লাস তাই কতখানি স্থায়ী হবে ভবিষ্যতই বলবে। তবে বাইডেন সরকারের আমলে মোদি সরকারকে মানবাধিকার, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে যে লাগাতার সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছিল তাতে হয়তো কিছুটা রাশ পড়তে পারে। কারণ ট্রাম্পের নিজেরই ও-সবের বালাই নেই।

সংগ্রাম ছাড়া শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি নেই

তাই যত বিপুল সমর্থন নিয়েই আসুন ট্রাম্প, তাঁর কাছ থেকে মার্কিন সাধারণ ও শ্রমজীবী জনগণের পাওয়ার কিছুই নেই, বরং যা ছিল তা-ও তাদের হারাতে হবে। মূল্যবৃদ্ধি তীব্র হবে, ছাঁটাই বাড়বে, দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্ত ঘটবে, বিদ্বেষের বিষ আরও বেশি করে ছড়াবে সমাজ জুড়ে, আর্থিক বৈষম্য আরও তীব্র হবে। অন্য দিকে গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলন বিশ্ব জুড়ে প্রবল বাধার সম্মুখীন হবে। সাম্রাজ্যবাদী হামলার শিকার হবেন আরও বেশি বেশি করে নিরীহ মানুষ। আমেরিকার শোষিত জনগণের পক্ষ থেকে জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া শাসকরা শোষিত মানুষের কথা এতটুকুও কানে তুলবে না।