বাংলাদেশের রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাইদ দুই হাত ছড়িয়ে বুলেটকে আহ্বান করে এই উপমহাদেশের গণআন্দোলনে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। ঢাকার মির মুগ্ধ, মাদারিপুরের দীপ্ত, যাত্রাবাড়ির সৈকত সহ প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-যুবক জীবন দিয়ে রক্তের অক্ষরে সে ইতিহাসের একটা বড় অধ্যায় লিখে গেছেন। তাঁদের কারও নাম জানা কারও বা অজানা। তাঁদের কে মুসলমান কে হিন্দু তা জানবার দরকার ছিল না, কেউ জানতেও চায়নি। বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানে যোগ দেওয়া সেই মেয়েটি, সেই ছেলেটি, যারা শহিদ হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই চিঠি লিখেছিল বাবা-মাকে, তারা নিজেদের কথা রেখেছে। যে মেয়েরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের নাম প্রধানমন্ত্রীর নাম থেকে বদলে আপসহীন ধারার স্বাধীনতা যোদ্ধা শান্তি-সুনীতি কিংবা শহিদ প্রীতিলতার নামে রেখেছেন বা যে ছাত্র-ছাত্রীরা জাত-ধর্ম নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন– তাঁরা কেউ গদিলাভের জন্য তা করেননি, করেছেন ফ্যাসিবাদী শাসনের জগদ্দল পাথরটাকে নাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে।
বাংলাদেশের কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সে দেশের ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে একটা স্তরে বিজয় অর্জন করেছে। দুনিয়ার সমস্ত বর্বর ফ্যাসিস্ট সরকারকেও লজ্জা দিতে পারে এই আন্দোলনের ওপর হাসিনা সরকারের ভয়াবহ আক্রমণ। ঠাণ্ডা মাথায় অসংখ্য মানুষকে খুন করেছে হাসিনা সরকারের পুলিশ এবং ব়্যাব। আওয়ামি লিগের অনুগত ছাত্র লিগের গুণ্ডা বাহিনীও এই হত্যাকাণ্ডে হাত লাগিয়েছিল। ছয় বছরের শিশু থেকে যুবক, নারী কিংবা পুরুষ কেউ রেহাই পায়নি এই বর্বর আক্রমণের হাত থেকে। যার ফলে মানুষের রোষ ফেটে পড়েছে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রীকে শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। হাসিনা সরকারের ওপর ক্ষোভ থেকেই মুজিবের মূর্তি ভাঙা কিংবা নানা জায়গায় ভাঙচুর, আওয়ামি লিগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যেহেতু অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, তার সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী নিজেদের সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তা প্রতিরোধে ছাত্র জনতা সহ অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এবং বামপন্থী কর্মীরা সক্রিয় হয়েছেন।
মূলগতভাবে এই গণঅভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়েছেন গণতন্ত্রপ্রিয় সাধারণ মানুষ। ভারতের বেশিরভাগ বামপন্থী দলগুলির মধ্যে এ নিয়ে নানা দোদুল্যমানতা থাকলেও এস ইউ সি আই (সি) একেবারে প্রথম দিন থেকেই এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছে। একই সাথে আন্দোলনের সামনে সঠিক রাজনৈতিক দিশা স্থির না করলে তা যে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না, এই হুঁশিয়ারিও সেদিন এই দলই দিয়েছিল। একটা দেশে ছাত্র জনতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ যখন অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, অকাতরে প্রাণ দেয়, তখন তা আরও বহু মানুষের প্রতিবাদের স্পৃহাকে জাগিয়ে দিয়ে যায়। বাংলাদেশের গণবিদ্রোহের রেশ মেলাতে না মেলাতেই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। কেন্দে্র বা রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলগুলির নেতা-নেত্রীরাও বলেছেন– আর জি কর ঘটনার প্রতিবাদে মানুষের রাস্তায় নামার মধ্যে আছে বাংলাদেশ বিদ্রোহের প্রভাব। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জনগণের এ ভাবে রাস্তায় নামার ঘটনা যে কোনও শাসকের বুকে কাঁপন ধরায়। ভারতীয় শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি যেমন বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে ভয় পেয়েছে তেমনই শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি ও শ্রমিকদের মধ্যে আপস-মধ্যস্থতা করে চলা মেকি বামপন্থী অর্থাৎ সোসাল ডেমোক্রেটিক দলগুলিও এই অভ্যুত্থানকে সমর্থন করতে ভয় পেয়েছে।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বিরাট বিদ্রোহ
এই অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে সে দেশের বামপন্থী দল বাসদ (মার্ক্সবাদী) বলেছে, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এই অভ্যুত্থান এক বিরাট বিদ্রোহ– সামাজিক আন্দোলন। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিবর্তন হয়নি, কারণ এ সমাজ-বিপ্লব নয়। তাই গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার্থে, পুনরুদ্ধারে এই অভ্যুত্থান তার সংগ্রামকে তীব্রতর করতে পারলে বহু দূর পর্যন্ত সফল হবে, কিন্তু যে বৈষম্যের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আমাদের মাথার উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে সেই বৈষম্যের ব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত না রাষ্ট্রবিপ্লবের মধ্য দিয়ে উচ্ছেদ করা যায় ততদিন মৌলিকভাবে বৈষম্য নিপীড়নকে খতম করা যাবে না।’
এ কথা সত্য যে, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষের প্রবল সমর্থন নিয়ে মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে তা সামাজিক বৈষম্য দূর করা, মানুষের ওপর শোষণ-যন্ত্রণা নিবারণের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে না। স্বৈরাচারী আওয়ামি লিগ সরকারের দোসরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মধ্য থেকে উঠেছে। কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে কিছু অপশক্তি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিসে ভাঙচুর চালিয়েছে, আগুন লাগিয়েছে।
১ নভেম্বর সে দেশের বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতৃবৃন্দ এই সমস্ত ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, গণঅভ্যুত্থানে অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। আওয়ামি লিগ শাসনে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। সেই শ্রমজীবী মেহনতি মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা অভ্যুত্থানের প্রথম কর্তব্য হওয়া উচিত। কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে না। চুক্তির ১৮ দফা শর্ত ভঙ্গ করছে মালিকরা। অথচ মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে শ্রমিকদের বুকেই গুলি করা হচ্ছে। এটা কোনও ভাবেই কাম্য নয়। তাঁরা চেয়েছেন শ্রমিক হত্যার বিচার করে দোষীদের শাস্তি দিক সরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ জনগণের নিরাপত্তাহীনতা দ্রুত কাটিয়ে তোলা ও আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশের সক্রিয় ভূমিকার দাবি তুলেছেন।
ফ্যাসিবাদ কি খতম হয়েছে?
সেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারী শাসনের আপাতত অবসান ঘটেছে ঠিকই। কিন্তু ফ্যাসিবাদের সামগ্রিক পরাজয় ঘটেনি। এ যুগের বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, ‘ফ্যাসিবাদ আজ প্রত্যেকটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেরই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ (সংস্কৃতির সংকট ও ফ্যাসিবাদ, রচনাবলী চতুর্থ খণ্ড)। বাংলাদেশের যে মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল তার সুফল আত্মসাৎ করেছে সে দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি। আওয়ামি লিগের নেতা-নেত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর ব্যবস্থা করেছেন বহু বছর ধরে, যা মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন পরেই ১৯৭৩ সালে মহান নেতা শিবদাস ঘোষ এক আলোচনায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার পিছনে শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলদের অবদান, বিশেষত ‘‘শরৎচন্দ্রকে বাদ দিয়ে যে দেশাত্মবোধের চর্চা হবে, তাতে মুজিবর রহমানের মতো ‘ডেস্পট’ই (স্বৈরাচারী শাসক) তৈরি হবে। বাংলাদেশ অচিরেই সংস্কৃতির গভীর সংকটের মধ্যে পড়বে আর সংস্কৃতিগত আন্দোলনের এই দীনতার জন্য তার প্রগিতিশীল ভাবনাধারণাগুলোও মুখ থুবড়ে পড়বে।’’(শরৎচন্দ্রের জন্মজয়ন্তীতে ভাষণ, ১৯৭৩)
ক্ষমতালাভের পর থেকেই অন্যান্য বুর্জোয়া শাসকের মতোই আওয়ামি লিগের নেতাদের চরিত্র যে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে শুরু করেছিল তা সেদিনই দেখা গেছে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ দেখেছে জেনারেল এরশাদের পরিচালিত স্বৈরাচারী সামরিক শাসন। তার বিরুদ্ধেও সে দেশের মানুষ লড়েছেন। এর মধ্যে এসেছে বিএনপি-জামাত-এর শাসন। তারাও মানুষের গণতন্ত্রের দাবিকে পদদলিত করেছে। ২০০৯ থেকে একটানা আওয়ামি লিগের জমানা চরমস্বৈরাচারী এবং ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছে। এই সময় নির্বাচন পুরোপুরি প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সদ্য সমাপ্ত অভ্যুত্থান ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংস্কার করে মানুষের জন্য একটু নিঃশ্বাস ফেলার পরিসর তৈরির লড়াই। তা একটা স্তর অবধি সফল হলেও দেখা যাচ্ছে মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনিক আমলা, সেনাবাহিনীর দ্বারাই মূলত পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্র-জনতার নেতৃত্বকারী ভূমিকাকে পিছনে ঠেলে দিয়ে, নানা ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক শক্তি, যারা পুঁজিপতিদেরই সেবাদাস, তারাই এখন সরকারি গদিলাভের আশায় সক্রিয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্বলতা ও অপদার্থতার সুযোগে পুঁজিপতিরা সেনাবাহিনীর হাতে আপাতত ক্ষমতা তুলে দিয়ে তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছে। নানা জায়গায় শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ দেখা যাচ্ছে, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জিগির তোলা হচ্ছে। সুবিধাবাদী, স্বার্থান্বেষী মহলের এই প্রচেষ্টা দেখিয়ে দেয় পুঁজিবাদের ধারক হিসাবে বাংলাদেশের বর্তমান শাসকদের মধ্যেও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বর্তমান। আপেক্ষিক অর্থে দুর্বল পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সমস্ত সরকারই দেশের পুঁজিপতিদের বাজারের স্বার্থে ভারত, আমেরিকা, চিন ইত্যাদি শাক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে নানা সময় নানা রকম বোঝাপড়া করে চলেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিকে লগ্নির সুযোগ করে দিয়ে অন্যত্র সুবিধা নিতে চেয়েছে। নিজের রাজনৈতিক খুঁটি হিসাবে এই যোগাযোগকে ব্যবহার করেছেন সেখ হাসিনা। আবার কিছু ক্ষেত্রে চিনের সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির সাথেও তিনি বোঝাপড়ায় গেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং নির্বাচন পরবর্তী নতুন সরকারও এই নীতি থেকে খুব বেশি সরে যাবে এমন সম্ভাবনা কম। ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজি তার একচেটিয়া চরিত্রের কারণেই অন্যত্র যে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা পালন করে তার অন্যথা বাংলাদেশেও হয়নি। তাদের এই ভূমিকা এবং এই একচেটিয়া মালিকদের স্বার্থে ভারত সরকার যেভাবে সেখ হাসিনার সমস্ত স্বৈরাচারী কার্যকলাপের প্রতি চোখ বুজে থেকে তাকে ভোট কারচুপিতে পর্যন্ত মদত দিয়েছে তা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
ভারতবিরোধী স্লোগানের নেপথ্যে
বাংলাদেশের আন্দোলনে বহু ক্ষেত্রেই ভারত বিরোধী স্লোগান শোনা গেছে। এতে এই আন্দোলনের সমর্থক বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন বহু মানুষ এবং বিশেষ করে ভারতের সাধারণ মানুষ ব্যথিত ও চিন্তিত হয়েছেন। ভারতের জনগণের ভেবে দেখা প্রয়োজন, এই স্লোগান কি ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে? আদৌ তা নয়। এ কথা সত্য যে, ভারতের পুঁজিবাদী রাষ্ট্র আর ভারতের চাষি, মজুর, ছাত্র, সাধারণ মানুষের স্বার্থ এক নয়। ভারতীয় একচেটিয়াপুঁজি বাংলাদেশ সহ এশিয়া আফ্রিকার নানা দেশে যে ভূমিকা পালন করে চলেছে, তাসাম্রাজ্যবাদ ছাড়া কিছু নয়। তাই বাংলাদেশের আন্দোলন থেকে যে স্লোগান উঠেছে তা ভারতীয় পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের বিরুদ্ধে, ভারতের মেহনতি জনতার বিরুদ্ধে নয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ মনে করেন, ভারতের মেহনতি জনগণ তাঁদের বন্ধু, লড়াইয়ের সাথী। বাস্তবেও ভারতের গণতন্ত্রকামী প্রগতিশীল মানুষ সক্রিয়ভাবে সাহসের সাথে এই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বহু সভায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মানুষ ভারতীয় জনগণের এই সমর্থন এবং ঐতিহাসিক ভূমিকাকে স্মরণ করেন বারবার।
বাংলাদেশের মানুষের চোখে ভারত রাষ্টে্রর ভূমিকা ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ হিসাবেই প্রতিভাত হয়। আপত্তি ওঠে সেখানে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ভারতীয় পুঁজিপতিদের লুঠের আয়োজন, সে দেশের আভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বিষয়ে ভারত রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক ও মেহনতি জনতা কখনওই মেনে নিতে পারেনি। যেমন একইভাবে ভারতে অন্য দেশের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা, নানা ভাবে আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা এ দেশের দেশপ্রেমিক মানুষ কখনওই মুখ বুজে মেনে নেননি, মেনে নেন না। বাংলাদেশের মানুষও ভারত রাষ্ট্রের ভূমিকাকে এই দৃষ্টিতে দেখেন।
সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ গণঅভ্যুত্থানের চেতনা বিরোধী
ভুললে চলবে না যে, বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে যাঁরা শহিদ হয়েছেন তাঁরা কেউ ‘মুসলমান ঐক্যে’র বা ‘হিন্দু ঐক্যের’ জন্য প্রাণ দিতে যাননি। মাদারিপুরের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক দীপ্ত দে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রুদ্র সেন, যাত্রাবাড়িকে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করার অন্যতম কারিগর সৈকত চন্দ্র দে সহ অসংখ্য শহিদ যখন প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের রক্তের সাথে মিশেছে যাঁদের রক্ত তাঁরা কে কোন ধর্মের কেউ প্রশ্ন করেনি। ওই আন্দোলনের সময় দেখা গেছে মন্দির পাহারা দিচ্ছে মাদ্রাসার ছাত্ররা।
এমন বহু গৌরবোজ্জ্বল বিষয় সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা, অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রশাসনিক শূন্যতার সুযোগে নানা জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ হয়েছে। যদিও একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, বিগত তিন মাসে এমন বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামি লিগের যে সব নেতা ও তাদের লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে জনরোষ ফেটে পড়েছে, তাঁদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষই ছিলেন। কিন্তু সে ঘটনা সাম্প্রদায়িক কারণে ঘটেনি। বাংলাদেশের সব শাসক দল নানাভাবে সে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদকে উৎসাহ দিয়েছে। আওয়ামি লিগের শাসনকালে যুক্তিবাদী-মুক্তমনা মানুষদের ওপর বারবার আক্রমণ হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপরেও আক্রমণ হয়েছে। এখন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এই শক্তিগুলি আরও মাথা তুলতে চাইছে। সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, স্থাপত্য ভাঙচুর, লাইব্রেরি লুঠ, ধর্মস্থানে আক্রমণ ইত্যাদি ঘটনা এই গণঅভ্যুত্থানের সমর্থক মানুষজনকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। মূলত তিন ধরনের শক্তি এই আক্রমণ করছে– প্রথমত, কিছু সুযোগসন্ধানী যারা কোনও কিছু ঘটলেই তার থেকে সুযোগ নেয়। দ্বিতীয়ত, এই গণঅভ্যুত্থানকে কালিমালিপ্ত করবার মরিয়া প্রচেষ্টা চালানো ফ্যাসিসট শক্তির প্রতিভূরা। তৃতীয়ত, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি। মনে রাখা দরকার, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ভারতের মতোই বাংলাদেশেও নতুন কিছু নয়, ভারতবর্ষ সহ সারা দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আজ সংকটগ্রস্ত পুঁজিপতি শ্রেণির এক সাধারণ কৌশল। গণঅভ্যুত্থানকে কালিমালিপ্ত করবার জন্য স্বার্থন্বেষীরা যেমন ভাস্কর্য ভেঙেছে, অন্যদিকে গণতন্ত্রকামী মানুষজন ও শিল্পীরা, সেই ভাস্কর্য সারানোর জন্য সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসেছেন। এ জাতীয় বহু আশাব্যঞ্জক ঘটনার সাক্ষী এই সময়টা। যদিও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই বহু ক্ষেত্রে এই আশাব্যঞ্জক দিক ও সাধারণ মানুষের সদর্থক ভূমিকার কথা ভারতে অন্তত বিশেষ উচ্চারিত হচ্ছে না। বাংলাদেশে এখন কেউ কেউ হিন্দু ঐক্যের যে স্লোগান তুলছেন তার সাথে ভারতে বিজেপির স্লোগান অনেকটা মিলে যায়। এই প্রচেষ্টা মুসলিম মৌলবাদকেও উৎসাহ দেবে। তাতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে ওঠার রাস্তাটাই ধাক্কা খাবে। বাস্তবে মুসলিম কিংবা হিন্দু উভয় মৌলবাদই গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক।
বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মানুষের রুখে দাঁড়ানোর যে নজির সৃষ্টি করেছে তা ভারত সহ বিশ্বের খেটে খাওয়া গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে প্রেরণা। বাংলাদেশের শোষিত মানুষ, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ গণঅভ্যুত্থানের অর্জিত সাফল্যকে বিপথগামী করতে দেবে না, প্রতিরোধ করবেই।