উত্তরবঙ্গের চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ দাবি উঠছে। ওখানেও কি আর জি কর হাসপাতালের মতো ধর্ষণ ও হত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে? এগুলি সব জায়গার মতো চা-বাগানেও কমবেশি আছে। এ ছাড়া আছে শ্রমিকদের অভাব অনটনের সুযোগ নিয়ে নারী পাচারের সমস্যা। প্রতি বছর বাগান থেকে বহু মেয়ে পাচার হয়ে যায়। বাগান যখন বন্ধ থাকে তখন ভিন রাজ্যে কাজ দেওয়ার নামে মেয়েদের নিয়ে যায় আড়কাঠিরা। তারপর সেই হতভাগ্য মেয়েগুলি বিক্রি হয়ে যায়। হাত বদল হতে হতে শেষে ঠাঁই হয় পতিতাপল্লীতে। এ সব দীর্ঘকাল ধরে চললেও এবং এই ঘটনাগুলো ক্ষোভের তীব্রতা বাড়ালেও উই ওয়ান্ট জাস্টিস সার্বজনীন স্লোগান হিসেবে আগে উঠে আসেনি। যদিও মানুষের ক্ষোভের মধ্যে জাস্টিস তথা ন্যায়বিচার পাওয়ার আকুতি ছিল। আর জি কর আন্দোলন সেই সুপ্ত আকুতিকে ভাষায় ব্যক্ত করেছে।
চা বলয়ে এই দাবির কেন্দ্রবিন্দু হল মালিকের লাগামছাড়া বেতন-বঞ্চনা ও বেতন-বৈষম্য। চা বাগানে শ্রমিকদের ন্যূনতম কোনও বেতন কাঠামো নেই। চা শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন স্থির করতে ২০১৫ সালে সরকার একটি কমিটি গড়েছিল। আজ অবধি সেই কমিটি একটিও সুপারিশ প্রসব করেনি।
১৯৯২ সালে পঞ্চদশ শ্রম সম্মেলনের সুপারিশ মানলে চা শ্রমিকদের নূ্যনতম মজুরি হওয়ার কথা দৈনিক ৬০০ টাকার বেশি। কিন্তু কোনও ভাবেই ওই পরিমাণ মজুরি শ্রমিকদের দেওয়া হয় না। কত কম দেওয়া হয়? তথ্য বলছে, দৈনিক ৩৫০ টাকার মতো তাদের কম দেওয়া হয়। এটাকেই বলে শ্রম-চুরি। গড়ে ২৫০ টাকার বেশি পায় না শ্রমিকরা। অর্থাৎ এমনিতেই শ্রমিক যা মূল্য উৎপাদন করে তার একটা ভগ্নাংশ মাত্র মালিক তাকে দেয়। চা বাগানে পুরো ৬০০ টাকা দিলেও পুরো ন্যায্য মজুরি শ্রমিক পেত না। এটাই অর্থনীতির ভাষায় আন-পেইড লেবার অর্থাৎ না দেওয়া মজুরি। এই মজুরিই মালিকের মুনাফার উৎস। তার ওপর এই লুট শ্রমিককে একেবারে পথে বসানোর ব্যবস্থা করেছে। পিএফ একটি শ্রমিক কল্যাণ প্রকল্প। এটাকেও মালিকরা ব্যবহার করছে শ্রম চুরির হাতিয়ার হিসেবে। কী ভাবে? সে কথাই বলেছেন কার্সিয়াং-এর এক শ্রমিক গীতা রাউত। তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শ্রমিকদের যতটুকু মজুরি দেওয়ার কথা সেখান থেকে দৈনিক ৩০ টাকা কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু সেই টাকা পিএফ ফান্ডে জমা পড়ে না। গীতা দেবী জানালেন, তাঁর নিজের বাগানে পনেরো কোটি টাকা পিএফ ফান্ড বকেয়া।
সর্বোচ্চ মুনাফা করার লক্ষ্য থেকে শ্রমিকের শ্রম চুরির বহু উপায় মালিকরা বের করেছে। আগে চা বাগানের শ্রমিকরা যে শ্রম দিয়ে সম্পদ তৈরি করে, সেই শ্রমের মূল্যের একটি অংশ কিছু বস্তুগত সুবিধার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের দেওয়া হত। যেমন শ্রমিকদের রান্নার জ্বালানি দেওয়া হত। চা পাতা দেওয়া হত। ছাতা-চপ্পল দেওয়া হত। এগুলো সব বন্ধ। শ্রমিকদের কোয়ার্টার মেরামতির দায়িত্ব ছিল মালিকের। সেটাও মালিক করছে না। অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্সের সুযোগ ছিল। সেটাও এখন ৫০০ টাকা না দিলে মেলে না। এগুলি না দিয়ে মালিক তার মুনাফার অঙ্ক বাড়িয়ে চলেছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকদের অভাব, অর্থনৈতিক সঙ্কট ক্ষোভের জন্ম দিয়ে চলেছে।
শ্রমিকদের দাবি, কাজ করব সবটা। টাকা সবটা পাব না কেন? ন্যায্য প্রশ্ন। কিন্তু এর উত্তর কোথায়? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, কেন্দ্র বা রাজ্যের শাসক দল, তাদের মদতপুষ্ট দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, মালিক এবং একদল আড়কাঠি মিলে চা বলয় জুড়ে এক মারাত্মক অশুভ চক্রের জন্ম দিয়েছে। এ রাজ্যের পূর্বতন সরকারগুলির আমলেও এ জিনিস চলেছে। এখন তা একেবারে লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে। একদিকে পুঁজিবাদী নিয়মেই শোষিত হওয়া, অন্যদিকে এই চক্র। একে ভাঙতে হলে সঠিক রাজনৈতিক শক্তিকে খুঁজতে হবে শ্রমিকদের।