দিল্লিতে কৃষক মহাসমাবেশ বিজেপি সরকারের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী কৃষি-নীতি প্রতিরোধের ডাক

২৩ সেপ্টেম্বর দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হল কৃষক মহাসমাবেশ। এ আই কে কে এম এস-এর ডাকে দেশের ২১টি রাজ্য থেকে হাজার হাজার কৃষক ও খেতমজুর সমবেত হয়েছিলেন এই মহাসমাবেশে। তাঁরা সমবেত হয়েছিলেন একটা দুর্জয় প্রতিজ্ঞা নিয়ে, দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের শহিদদের অপূরিত কাজ পূর্ণ করার তাগিদ বুকে বহন করে। তাই তাঁদের কণ্ঠে ছিল–‘আমরা লড়ব, আমরা জিতব’– এই স্লোগান।

তালকাটোরা কৃষক আন্দোলনের মঞ্চ থেকে তাই সে দিন (২৩ সেপ্টেম্বর) ঘোষণা করা হয়েছে কৃষক আন্দোলনকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান। ঘোষণা করা হয়েছে– ১৭ নভেম্বর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রাইয়ের প্রয়াণ দিবসে দেশব্যাপী জেলা স্তরে কিসান-খেতমজুর বিক্ষোভ সমাবেশ করা হবে। ২০২৫-এর ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যে রাজ্যে হাজার হাজার কৃষকের রাজভবন অভিযান সংগঠিত হবে।

আবেদন জানানো হয়েছে, এখন থেকে দেশব্যাপী কৃষক কর্মী ও সংগঠকদের কাজ হবে গ্রামে গ্রামে কৃষক কমিটি গড়ে তোলা, প্রতিষ্ঠিত কৃষক কমিটিগুলোকে আরও সজীব ও প্রাণবন্ত করা, আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করা, স্থানীয় দাবিগুলো নিয়ে বিক্ষোভ সংগঠিত করা, মহান নেতা শিবদাস ঘোষের শিক্ষা ও চিন্তাকে বৃহত্তর কৃষক সমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

একটা বিষয় গুরুত্ব সহকারে কৃষক মহাসমাবেশে আলোচিত হয়েছে। তা হল, মহান নেতা শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে কৃষক সংগ্রাম গড়ে তুলতে না পারলে সাধারণ মানুষের মুক্তি নেই। ভারতের বুকে তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন, এ দেশে কৃষক জীবনের সমস্ত সমস্যার মূল কারণ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্তে্রর শাসন-শোষণের চাপেই কৃষক ক্রমাগত জমিহারা হয়ে খেতমজুরে পরিণত হচ্ছে, দেনার দায়ে আত্মহত্যার পথ নিতে বাধ্য হচ্ছে। তাই, এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোকে সবলে উচ্ছেদ করতে না পারলে কৃষক-খেতমজুরদের মুক্তি নেই। আর তাই কৃষক-খেতমজুরদের এই সংগ্রামের উপযুক্ত করে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে।

মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের এই অমূল্য শিক্ষাকে কৃষকরা এখন সমগ্র জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারছেন। তাঁরা অনুভব করতে পারছেন, সমস্ত ক্ষেত্রেই তাঁদের সামনে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি। তাঁদের ন্যায়সঙ্গত দাবি এমএসপি-কে আইনসঙ্গত করা ও উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দরে তা কিনে নেওয়া। সরকার তা মেনে নিচ্ছে না আদানি-আম্বানিদের স্বার্থে। কারণ এতে ওদের মুনাফার পাহাড়ে টান পড়বে। সরকার সার-বীজ-তেল ইত্যাদি সস্তা দরে সরবরাহ করার দাবিতে কান দিচ্ছে না, বহুজাতিক কোম্পানির সেবাদাসত্ব করার প্রয়োজনে। সরকার বিদ্যুৎ বিল ২০২৩ নিয়ে এসেছে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। সব ক্ষেত্রেই কৃষকের সাধারণ শত্রু বহুজাতিক কোম্পানি। তাই এই শত্রু ও তার সেবাদাস বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার জন্য বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু,আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার কৃষকরা সমবেত হয়েছিলেন এই কৃষক মহাসমাবেশে। কর্ণাটক থেকে এসেছিলেন নারকেল চাষিরা, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে দুগ্ধ উৎপাদনকারীরা, উত্তরপ্রদেশ থেকে আখ চাষিরা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাট চাষি, ধান চাষি, চা চাষিরা, হরিয়ানা থেকে গম চাষিরা। উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ ও দিল্লির গ্রামাঞ্চল থেকে সরকার যে সব চাষিকে উচ্ছেদ করে তাঁদের জমি ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে, সদলবলে এসেছিলেন তাঁরাও। এসেছিলেন অসংখ্য খেতমজুর– যাঁদের সারা বছর কাজ ও ন্যায্য মজুরি দেওয়ার দায়িত্ব অস্বীকার করছে কেন্দ্রীয় সরকার। ঋণভারে জর্জরিত হয়ে যাঁরা আত্মহত্যার বেদনাদায়ক পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, এসেছিলেন সেই সব পরিবারের প্রতিনিধিরাও। এই কিসান মহাসমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের নেতারা– যাঁরা যোগ্যতার সাথে নেতৃত্ব দিয়ে এই আন্দোলনকে বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

আসামের ব্রহ্মপুত্র নদীর বন্যা ও নদী ভাঙনে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যান। এই মহাসমাবেশে নদী ভাঙন প্রতিরোধ ও উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। দাবি করা হয়, আসামের দুর্গত মানুষদের এই ভয়াবহ সমস্যাকে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা হিসাবে দেখতে হবে এবং তার প্রতিকারে অবিলম্বে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

একটা বিষয় বিভিন্ন বক্তাদের আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে। তা হল, কেন্দ্রীয় সরকার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। শুধু তাই নয়, এমএসপি চালু না করার পিছনে তারা অর্থের অভাবের বিষয়টা বারবার উল্লেখ করেছে। মহাসমাবেশের মঞ্চ থেকে এই কথাটা জোরের সাথে তুলে ধরা হয়েছে– ২৩টি কৃষিপণ্য এমএসপি দরে কিনে নেওয়া এবং তাকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষের কাছে কম দামে পৌঁছে দিতে গেলে বছরে মাত্র কম-বেশি ২ লক্ষ কোটি টাকা সরকারকে অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। দেশের ১৩০ কোটি মানুষের জন্য এই টাকা বরাদ্দ করা কি খুব কঠিন? সরকার গত দশ বছরে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ১৫ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করেছে, এর সাথে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো দিয়েছেই। তা হলে ১৩০ কোটি মানুষের জন্য প্রতি বছর এই সামান্য টাকা বরাদ্দ করা হবে না কেন? মনে রাখতে হবে, কৃষকের কাছ থেকে লাভজনক দামে শস্য কিনে কম দামে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দাবি কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রথম তুলেছিলেন ১৯৫০ সালে, পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য আন্দোলনের সময়। বলেছিলেন, মানুষকে খাওয়ানো ও কৃষক-খেতমজুরদের রক্ষা করা যে কোনও সভ্য সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব।

বিগত কংগ্রেস সরকার সেই দায়িত্ব পালন করেনি, বর্তমান বিজেপি সরকারও সেই দায়িত্ব পালন করতে চাইছে না। শুধু তাই নয়। তাঁরা সংগ্রহ মূল্য সামান্য কয়েক টাকা বাড়িয়ে তাকেই এমএসপি চালুর দাবি করে জনগণকে প্রতারিত করছে। এই মিথ্যাচারের জবাব দিতে এবার কৃষকরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মহাসমাবেশে কৃষকরা এ বার শপথ নিয়েছেন, মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে পাথেয় করে তাঁরা দেশব্যাপী সুদৃঢ় কৃষক সংগ্র্রাম গড়ে তুলবেন। আগামী দিনের ঘোষিত কর্মসূচি এই সংগ্রামের সূচনা মাত্র।