Breaking News

ধর্ষকদের রাজনৈতিক প্রশ্রয় বন্ধ হওয়া জরুরি

নারী নির্যাতনে একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিধায়ক-সাংসদরা। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার জোগাড়। ভাবতে অবাক লাগে এরাই আবার নারী সুরক্ষা নিয়ে গলা ফাটান! সম্প্রতি দেশের ১৫১ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলার খবর প্রকাশিত হয়! এডিআর রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে এই তথ্য।

দেখা যাচ্ছে, নারী নির্যাতনের ঘটনায় রাজ্যভিত্তিক জনপ্রতিনিধিদের তালিকায় শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ এবং দলগত হিসেবে শীর্ষে বিজেপি। বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, টিডিপি, বিজেডি, আরজেডি, আপ আরও কত দলের নাম রয়েছে তালিকায়। বর্তমানে দেশে ১৩৫ জন জয়ী বিধায়ক ও ১৬ জন জয়ী সাংসদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে বিজেপির বিধায়কের সংখ্যা ৪৪ জন এবং সাংসদের সংখ্যা ১০ জন, কংগ্রেসের ২৩ জন, তৃণমূল কংগ্রেসের ১০ জন, আপের ১৩ জন, টিডিপি-র ১৭ জন, আরজেডির ৪ জন। এর মধ্যে এমন কয়েকজন সাংসদ-বিধায়কও আছেন, যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ আছে। প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় যে হলফনামা দিয়েছেন, তার ভিত্তিতেই এডিআর এই রিপোর্ট করেছে।

সম্প্রতি আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। দেশের সকল পেশার মানুষই গর্জে উঠেছেন এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছেন, মিটিং, মিছিল, প্রতিবাদ, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন। যথার্থ অর্থেই এ এক গণজাগরণ। সকলের কণ্ঠে একটাই দাবি ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। সর্বত্রই একটা আকুতি– এর অবসান কীসে!

এ রাজ্যে কিংবা অন্য কোনও রাজ্যে অতীতে কিংবা বর্তমানে যেখানেই যারা শাসন ক্ষমতায় আছে বা ছিল সেখানে ধর্ষণের ঘটনায় তারা যা বলেছে তাতে অপরাধীদের রাজনৈতিক প্রশ্রয় বোঝা যায়। কখনও তারা একে ‘ছোট ঘটনা’, কখনও ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, আবার কখনও ধর্ষণের ঘটনাকে ‘এমন ধরনের ঘটনা হয়েই থাকে’ ইত্যাদি বলে, একটি গুরুতর এবং ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধিকে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেছে।

সরকারের পরিবর্তন হলে কিংবা ধর্ষণ প্রতিরোধে কঠোর থেকে কঠোরতর আইন আনা গেলেই কি এই সমস্যার সমাধান হবে? বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে দেখা যাবে সরকারের পরিবর্তন হলেই এই সমস্যার সমাধান হবে এমনটা একেবারেই সত্যি না। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে এবং রাজ্যে বহু সরকার পরিবর্তন হয়েছে, রঙ বদল হয়েছে কিন্তু এই মারাত্মক ব্যাধি বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, ধর্ষণ সম্পর্কে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গিরও বদল হয়নি।

২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের নির্ভয়া কাণ্ডের পরে ধর্ষণ সম্পর্কিত আইনের একাধিক পরিবর্তন হওয়ার পরও, এমনকি নির্ভয়া কাণ্ডে জড়িত অভিযুক্তদের মধ্যে ৪ জনের ২০২০ সালের মার্চ মাসে ফাঁসি হওয়ার পরও দেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর (এনসিআরবি) ২০১৯ সালের এক তথ্য বলছে, সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। একটি সভ্য দেশে এই পরিসংখ্যান লজ্জার।

এ কথা ঠিক, কোনও মানুষই ধর্ষক হয়ে জন্মায় না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে একজন কী ভাবে ধর্ষক হয়ে ওঠে এটাও ভেবে দেখা দরকার। আসলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ধর্ষক হয়ে ওঠার সমস্ত উপকরণ। ধর্ষণের সাথে জড়িয়ে আছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও বিকৃত যৌন আকঙক্ষা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নারীদেহের পণ্যায়ন। খবরের কাগজ, সংবাদমাধ্যম, সমাজমাধ্যম– সর্বত্র বিজ্ঞাপনগুলি নারীদেহ প্রদর্শনের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিনেমা-নাটকের কথা যত কম বলা যায় ভাল। চলছে অশ্লীল ছবির দেদার প্রচার। মদ-জুয়া-সাট্টার দেদার আসর। চলছে পর্নো সাইটের প্রচার। মানুষের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার সব রকম প্রচেষ্টা চলছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, ভোটের স্বার্থে অপরাধীদের ব্যবহার। এ সব চলছে সরকারের প্রশ্রয়েই।

তাই ধর্ষণকে যদি সমাজ জীবন থেকে সত্যি সত্যি বিলুপ্ত করতে হয় তা হলে একদিকে যেমন সমাজ মননে পরিবর্তন আনতে হবে, রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়ন থেকে বাঁচাতে হবে, তেমনই আমাদের দেশে এবং রাজ্যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দাবি দাওয়াকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলনগুলি প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে, সেই আন্দোলনের কর্মসূচিতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দাবিগুলোকেও যুক্ত করতে হবে। এই আন্দোলনের আঁচে-তাপে মানুষের মধ্যে উন্নত জীবনবোধের জন্ম হবে। এ পথেই ধর্ষণ প্রতিরোধে উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা যাবে।