ইজরায়েলের হামলার বলি এবার লেবাননের সাধারণ মানুষ

লাগাতার নৃশংস হামলা চালিয়ে প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর এ বার লেবাননে চরম অনৈতিক প্রক্রিয়ায় হামলা চালাল ইজরায়েল। যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত পেজার ও ওয়াকি-টকির ব্যাটারিতে আগে থেকে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে রেখে ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর সেগুলিতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫১ জন। আহত প্রায় ৪ হাজার, যার মধ্যে ৩০০ জনের আঘাত গুরুতর। এই হামলার পিছনে ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ রয়েছে বলে বিশ্ব জুড়ে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করেছে। ইজরায়েল এই বিস্ফোরণের দায় সরাসরি স্বীকার না করলেও অস্বীকারও করেনি।

প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা-যোদ্ধাদের সংগঠন ‘হামাস’-এর লড়াইয়ে পাশে থাকার কারণে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন ‘হিজবুল্লা’ ইজরায়েলের কোপদৃষ্টিতে রয়েছে। পেজার বিস্ফোরণের ছক কষে ইজরায়েল হিজবুল্লা সদস্যদের উপর হামলা চালানোর ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু তারা ছাড়াও লেবাননের সাধারণ মানুষ, এমনকি শিশুরাও বিপুল সংখ্যায় আচমকা এই আক্রমণে আহত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের বেশিরভাগই তরুণ। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ৮ বছরের মেয়েও। আহত হয়েছেন লেবাননে ইরানের রাষ্ট্রদূতও। বিস্ফোরণে অনেকেরই একটি বা দুটি চোখই নষ্ট হয়ে গেছে। রক্তের চরম অভাব দেখা দিয়েছে লেবাননের হাসপাতালগুলিতে।

বছরের পর বছর ধরে প্যালেস্টাইনে নির্বিচার হামলা চালিয়ে সেখানকার আদি বাসিন্দা আরবদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্তে্র মেতে রয়েছে উগ্র ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েল। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডে সেই হামলা তারা তীব্রতর করেছে। নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে তারা। গত এগারো মাসে ইজরায়েলের আক্রমণে নিহত হয়েছেন ৪০ হাজারের বেশি প্যালেস্তিনীয়, যার প্রায় অর্ধেকই শিশু। এই আক্রমণে ইজরায়েলকে মদত দিয়ে চলেছে সাম্রাজ্যবাদ-শিরোমণি আমেরিকা। বিশ্বের দেশে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন এই বর্বর গণহত্যার জন্য ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে, তখন সে সবের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে এ বার নতুন করে লেবাননে তারা হামলা চালাল।

লেবানন সরকারের মতে এই বিস্ফোরণের পিছনে আছে ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ইজরায়েল সে কথা স্বীকার না করলেও সে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, ‘হিজবুল্লা যা করেছে, তার দ্বিগুণ দাম চোকাতে হবে তাদের’। ফলে স্পষ্ট হয়েই যায় যে, বিজ্ঞানের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সম্পূর্ণ অনৈতিক উপায়ে লেবাননে এই বিস্ফোরণের ছক সাজিয়ে সেই দামই আদায় করতে চেয়েছে ইজরায়েল। শুধু তাই নয়, পেজার বিস্ফোরণের মাত্র কয়েক মিনিট আগে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর করা একটি ফোন কলের খবর একটি ওয়েবসাইট সূত্রে সামনে এসেছে। সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু না বললেও আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে এই ফোনে তিনি জানিয়েছেন, লেবাননে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

তবে কী উপায়ে লেবাননের আমদানি করা পেজারগুলির ব্যাটারিতে বিস্ফোরক ভরা হল, সে রহস্য এখনও উদঘাটিত হয়নি। জানা গেছে, যে পেজারগুলিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেগুলি তৈরির জন্য তাইওয়ানের ‘গোল্ড অ্যাপোলো’ কোম্পানিকে বরাত দিয়েছিল হিজবুল্লা। বিস্ফোরণের পর ওই কোম্পানির মালিক জানিয়েছেন, তাঁরা হাঙ্গেরির একটি কোম্পানিকে সেগুলি বানানোর সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়েছিলেন। এ দিকে হাঙ্গেরির ওই কোম্পানি শুধু নয়, সে দেশের সরকারও জানিয়ে দিয়েছে, ওই পেজারগুলি তাদের বানানো নয়। ফলে গোটা ছকটি স্পষ্ট না হলেও এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, এই পেজার বিস্ফোরণের পিছনে মোসাদের বড়সড় ষড়যন্ত্র রয়েছে।

এই ষড়যন্তে্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যুক্ত থাকার সম্ভাবনা যথেষ্টই। কারণ এ কথা আজ আর গোপন নেই যে, গোটা বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও তার স্যাঙাৎ রাষ্ট্রগুলি বিপুল অস্ত্রের সম্ভার নিয়ে ইজরায়েলের এই হানাদারির পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতির কারণে সাম্রাজ্যবাদী শিবির আজ বিশ্ব-জনমতকে এ ভাবে দু’পায়ে মাড়ানোর স্পর্ধা দেখাতে পারছে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত রাষ্ট্রটিও দেশের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐতিহ্য ও জনসাধারণের প্রতিবাদ দু’পায়ে দলে একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের মুনাফার স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়িয়ে চলেছে।

আন্তর্জাতিক রীতিনীতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্যালেস্টাইনে গণহত্যায় লিপ্ত ইজরায়েলে বিপুল অস্ত্র রপ্তানির পাশাপাশি ভারত থেকে কর্মক্ষম তরুণদের ইজরায়েলে শ্রমিক-কর্মচারীর কাজে পাঠাচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তাই প্যালেস্টাইনে নির্মম গণহত্যা ও লেবাননে পেজার বিস্ফোরণে শিশু সহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর দায় বিজেপি সরকারও এড়িয়ে যেতে পারে না।

About suphal