বিচারহীনতা অবসানেরশপথে উজ্জ্বল ‘অভয়ার রাত’

৮ সেপ্টেম্বর পেরিয়ে গেল সেই অভিশপ্ত রাতের একটি মাস। দিনটি চিহ্নিত হয়েছিল অভয়ার রাত’ হিসাবে। সে দিন আবার পথে নামলেন হাজার হাজার মানুষ। ওই দিনই সারা বিশ্বে এক সাথে পালিত হল মানব বন্ধন। এই একটি মাসে এমন একটি দিনও ছিল না যেদিন প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে রাস্তায় নামেনি মানুষ। এমন একটি পাড়া মহল্লা পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যাবে না, যেখানকার মানুষ আন্দোলন থেকে দূরে থেকেছেন। ঘটনার তদন্তের ভার কলকাতা পুলিশের হাত থেকে হাইকোর্টের মাধ্যমে সিবিআই নিয়েছে। স্বতঃপ্রণোদিত মামলা শুরু করেছে সুপ্রিম কোর্ট। তার শুনানির দিনের আগেও অপার আগ্রহে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন বহু মানুষই। ৯ সেপ্টেম্বরের শুনানিতেকার্যত কিছু না পেয়ে সে দিনই তাঁরা বহু জায়গায় ডাক দিয়েছিলেন জনতার আদালত’ বসানোর। মুখে মুখে ফিরেছে কথা–‘দিন দিন বিচারহীন, আর কত দিন, আর কত দিন’! হাজারে হাজারে মানুষ জোট বেঁধেছেন–‘বিচারের বাণীকে নীরবে নিভৃতে হারিয়ে যেতে আর দেব না আমরা’– এই দৃঢ় পণ নিয়ে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ‘বিচার চাই’, ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ স্লোগান তুলছেন যাঁরা, তাঁদের কেউ অধ্যাপক, চিকিৎসক, কেউ সাধারণ দোকান কর্মচারী। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সব স্তর থেকে বহু বেড়া ভেঙে তাঁরা এসেছেন। সকলে একে অপরকে চেনেন না। তবু অদ্ভূত এক বন্ধন তাঁরা অনুভব করছেন নিজেদের মধ্যে। আবার এর মধ্যেই কেউ রাজ্য, কেন্দ্র উভয় সরকার এবং বিচারবিভাগের ভূমিকা দেখে ভাবছেন– এত করছি, বিচার পাওয়া যাবে তো? আন্দোলন সফল হবে তো?

এই আন্দোলন চলতে চলতেই পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় ঘটে চলেছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের নানা ঘটনা। কাটোয়ায় রেহাই পায়নি সাড়ে চার বছরের শিশুও। কানে এসেছে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লির একাধিক ধর্ষিতা নারীর অসহায় আর্তনাদ। মানুষের স্মৃতিতে জেগে আছে ১৯৯০-এ সিপিএম শাসনে বানতলায় তিন স্বাস্থ্যকর্মী সহ ইউনিসেফের অফিসার অনিতা দেওয়ানের ধর্ষণ ও তাঁর হত্যার ঘটনা। তাঁদের বাঁচাতে গিয়ে সেদিন নিহত হয়েছিলেন তাঁদের গাড়ির ড্রাইভারও। সেদিনের মুখ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দিয়েছিল, প্রকৃত বিচার তাঁরা দিতে চান না। সে দিনও স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্নীতির সাথে এই হত্যা ও ধর্ষণ যুক্ত বলে অভিযোগ ছিল, তার কোনও তদন্ত হয়নি। ২০০৩-এ নদীয়ার ধানতলায় দুটি বাসের দুই ড্রাইভারকে হত্যা করে এক সাথে প্রায় ৩৫ জন মহিলার শ্লীলতাহানি ও অনেককে ধর্ষণ করার ঘটনাতেও মাত্র চারজনের সামান্য শাস্তির ঘটনা ভোলা যায় না। সে দিন সিআইডির আইনজীবী বলেছিলেন, সাক্ষীদের ৯০ শতাংশই ভয় পেয়ে আদালতে মূল অভিযুক্ত শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাননি। এর পরেও দিদির শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে বারাসাতের রাজীবের মৃত্যু, সরকার বদলের পর পার্কস্ট্রিটের ধর্ষণ, কামদুনির কলেজ ছাত্রীর মর্মান্তিক পরিণতি, হাঁসখালি, মধ্যমগ্রামের ঘটনা– একের পর এক চলতেই থেকেছে। অন্য রাজ্যেও, যেমন উত্তরপ্রদেশের হাথরস, উন্নাও, জম্মুর কাঠুয়া– যেখানে কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি দাঁড়িয়েছে ধর্ষক-খুনিদের পক্ষে। এর যেন শেষ নেই! এ যেন সেই ১৯৯০-এর বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ভয়ানক উচ্চারণ– ‘এমন তো কতই হয়’! বিচার না পাওয়াটাই যেন স্বাভাবিক!

ঠিক এখানেই আঘাত করেছে আর জি কর আন্দোলন। ‘আমার বোনের বিচার চাই’ বলছে যে মেয়েটি বা ঠিক তার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি, তাদের চোখে আশার বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে যায়– বিচারের দাবি তারা আদায় করবেই। ওই নির্যাতিতা, নিহত মেয়েটি তাদের সকলের আত্মীয় হয়ে উঠেছে। এক একটা প্রতিবাদী আন্দোলন কখনও কখনও ঘটে যাওয়া সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে। আর জি কর আন্দোলন আজ সেই ভূমিকাই পালন করছে। বহু দিনের সঞ্চিত ক্ষোভ আজ ভাষা পেয়েছে এই আন্দোলনে। এই আন্দোলন একটার পর একটা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ১৪ আগস্ট রাত দখল কর্মসূচিতে সমস্ত গণ্ডি ভেঙে মানুষ লাখে লাখে রাস্তায় নেমেছেন। সরকার আন্দোলন থেকে ছাত্রদের দূরে রাখার জন্য নির্দেশিকা জারি করলে তা অমান্য করে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে মিছিলে হেঁটেছেন তাদের শিক্ষক শিক্ষিকারা। জুনিয়র ডাক্তাররা লালবাজারে কলকাতা পুলিশের হেড কোয়ার্টারের অদূরে রাস্তায় ২২ ঘন্টা বসে থেকেছেন অবিচল দৃঢ়তায়। তাঁদের শিরদাঁড়ার জোরটা বোঝাতে কলকাতার নগরপালের টেবিলে তার একটি প্রতিলিপিও তাঁরা দিয়ে এসেছেন। মানুষ অক্লান্ত– শেষ দেখে ছাড়ার জেদে তাঁরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।

যদিও আন্দোলনের কেন্দ্রে থাকা জুনিয়র ডাক্তারদের উপলব্ধি– সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনের প্রকৃত সুরটাকে গ্রহণ করতে পারলেও ভোটসর্বস্ব রাজনীতিবিদ ও তাঁদের দলগুলো তা বুঝতে একেবারে অক্ষম। তাই তারা বিচারের দাবির অভিনয় করলেও নজরটা থেকে যাচ্ছে গদির দিকেই। চলছে তাঁদের অশ্লীল কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। অন্য দিকে সাধারণ মানুষের দফা এবং দাবি এক– বিচার চাই। রাজ্য সরকারের পুলিশের প্রমাণ চাপা দেওয়ার জন্য ন্যক্কারজনক ভূমিকার জন্য তাঁরা ধিক্কার জানাচ্ছেন যেমন, একই সাথে সিবিআইয়ের ঢিলেঢালা মনোভাব, আদালতের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে তাঁরা পিছপা নন। যে সিবিআই সারদা, নারদা থেকে শুরু করে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় বছরের পর বছর ধরে কার্যত একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কোনও নেতা বিজেপিতে নাম লেখানো মাত্র যে সিবিআইয়ের চোখে অদৃশ্য হয়ে যান, উত্তরপ্রদেশের হাথরসে সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করতে অতি তৎপর অথচ দোষীদের শাস্তি দিতে অক্ষম যে সিবিআই– তাদের হাতে তদন্তের ভার ছেড়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকা সম্ভব কি! আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা দাবি করেছিলেন, তদন্ত হোক বিচারবিভাগের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি গ্রহণ করতে অনেকেই খুশিও হয়েছেন। কিন্তু যখন এই মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা পর্যন্ত জানাচ্ছেন, শীর্ষ আদালতের মূল মাথাব্যথা হল দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনকে একটু সংযত করা, ডাক্তারদের কাজে ফেরানো (আনন্দবাজার পত্রিকা ৬.০৯.২৪), তখন যেন মনের কোণে সন্দেহ ঝিলিক দিয়ে যায়। ৯ সেপ্টেম্বরের শুনানিতেও ডাক্তারদের আন্দোলন তুলে নেওয়ানোই যেন বিচারব্যবস্থার একমাত্র মাথাব্যথা হিসাবে দেখা গেছে। আবার একটি দিন ছাড়া কিছুই মেলেনি। ধাক্কা খেয়েছে মানুষ। তবে কি আবার সেই বিচারহীনতার পুনরাবৃত্তি! সুপ্রিম কোর্ট কিংবা হাইকোর্ট কালকেই বিচার শেষ করে দেবে এমন অবাস্তব দাবি মানুষ করেনি। বিচারের দাবি তুলে রাস্তায় নামা মানুষের চাহিদা খুব সামান্য– আদালত এবং তদন্তকারী সংস্থা সত্য উদঘাটনে তাদের সদর্থক ভূমিকাকে স্পষ্ট করুক। রাষ্ট্রের কর্ণধার, প্রশাসন, বিচারবিভাগের কাছে মানুষের এটুকু চাওয়াও কি অনেক বেশি!

আর জি করের মহিলা চিকিৎসকের মূল্যবান জীবনের মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি যে ব্যথা যন্ত্রণা মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে তারও মূল্য অনেক। এ জন্যই হরিয়ানার স্বঘোষিত গো-রক্ষকদের হাতে নিহত আরিয়ান মিশ্রের পরিজন বাড়ির দরজায় ব্যানার ঝুলিয়েছেন– উই ওয়ান্ট জাস্টিস। যে মানুষটা এতদিন মিছিল দেখলে বিরক্তি প্রকাশ করতেন, প্রতিবাদের থেকে শত হস্ত দূর থাকতেন, তিনিও আজ কোনও না কোনও পাড়ায় রাত জাগছেন। যে খবরের কাগজ মিছিলে শুধু যানজট দেখেছে এতদিন, তারাও আজ প্রতিবাদী মিছিলের শক্তিকে অস্বীকার করতে পারছে না। সে হিসাবে বিবেকবান মানুষের বিচারে এ বড় উজ্জ্বল দিন এবং শাসক শ্রেণির পক্ষে এ সুখের দিন নয়। আন্দোলন, প্রতিবাদ কখনও দাবি আদায় করতে পারে, কখনও পারে না। কিন্তু তা নিয়ে শাসক শ্রেণি বিশেষ মাথা ঘামায় না। তারা মাথা ঘামায় একটা বিষয়ে– প্রতিবাদ যেন আরও প্রতিবাদের জন্ম না দেয়! তারা জানে প্রতিবাদের শক্তি মাথা তুললে তা সমাজে বড় চরিত্র সৃষ্টির জমি তৈরি করে, মানুষকে চিন্তা করতে, ঠিক ভুল চিনতে শেখায়। আন্দোলনের রাস্তা মানুষকে সমাজটার খোলনলচে বদলে নতুন সমাজ আনার রাস্তা দেখতে শেখায়। দলীয় পতাকাহীন এই আন্দোলনের মধ্যে বহু মতের, পথের মানুষ মিশে আছেন। মানুষ তাঁদের ভূমিকা দেখছেন। কারা আন্দোলনকে নিজের দলের গদিলাভের হাতিয়ার করতে ব্যস্ত, অন্য দিকে কারা মানুষের সংঘশক্তি গড়ে তুলতে, তাদের নিজস্ব সংগ্রামের হাতিয়ার গড়ে তুলতে সচেষ্ট– সে রাজনীতির পার্থক্য একটু হলেও স্পষ্ট হবে। আন্দোলন চলতে চলতে ঠিক ভুলের দ্বন্দ্ব আসবে, মানুষ রাজনীতির পাঠ নিতে পারে এই রাস্তায় থাকতে থাকতেই। তারা চিনতে পারে দলগুলির স্বরূপকেও। লড়াই করতে শিখলে মানুষ এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে বিচারব্যবস্থার স্বরূপও চিনবে। সমাজ বদলের সঠিক পথও এই রাস্তাতেই চিনবে মানুষ। তাই আন্দোলনের রাজপথই সমাজ শিক্ষার সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। সেই কারণেই শাসক শ্রেণির সেবাদাস দলগুলি আন্দোলনের সম্ভাবনায় জল ঢালতে কখনও তড়িঘড়ি ধর্ষকের ফাঁসির দাবি তোলে, কখনও এনকাউন্টারে সব চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এ বিষয়ে বিজেপি, তৃণমূল কিংবা কংগ্রেস কারও সঙ্গে কারও কোনও পার্থক্য নেই।

এই আন্দোলনের পরে আর সমাজে ধর্ষণ থাকবে না, সরকারি গদির মধু-ভাণ্ডের চারপাশে ঘোরা রাজনৈতিক দলগুলো দুষ্কৃতীদের মদত দেওয়া বন্ধ করে দেবে, সরকারি দল দুর্নীতিকে আর প্রশ্রয় দেবে না, পুলিশ শাসক দলের হয়ে অপরাধ চাপা দেওয়ার চেষ্টা আর কোনও দিন করবে না– এমনটা ভেবে নেওয়া নিশ্চয়ই কষ্ট-কল্পনা। কিন্তু লাগামটা ছুঁড়ে ফেলার যে পথ এই আন্দোলন মানুষকে দেখিয়ে যাচ্ছে, তার শিক্ষা ব্যর্থ হতে পারে না। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর শিক্ষা– ‘‘স্কুলে-কলেজে, ঘরে বাইরে, পথে ঘাটে, যেখানে অত্যাচার, অবিচার বা অনাচার দেখিবে সেখানে বীরের মতো অগ্রসর হইয়া বাধা দাও। … আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে শক্তি যদি কিছু সংগ্রহ করিয়া থাকি তাহা শুধু এই উপায়েই করিয়াছি।’’ এটাই শক্তির উৎস। ঠিক এই শিক্ষাটাকেই ভয় পায় শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি। তারা জানে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলে মানুষ একদিন শুধু ধর্ষকদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে না, সমাজের সমস্ত অন্যায়ের প্রতিকারের পথেই ধাবিত হবে আন্দোলন। এ জন্য দেশের আসল শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি তাই সমাজে বিশেষত ছাত্র যুবদের নৈতিক মেরুদণ্ডটাকে নষ্ট করতে নানা আয়োজন করে। দুর্নীতি, মদ-মাদক-বিকৃত যৌনতার নেশায় তাদের সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দিতে চায় তারা। মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, ‘‘ভারতবর্ষের শাসক সম্প্রদায় জাতির নৈতিক চরিত্রটিকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলার ষড়যন্ত্রের লিপ্ত। তারা অত্যন্ত ধুরন্ধর। তারা জানে যে, শত অত্যাচার ও দমনপীড়ন করেও, না খেতে দিয়েও একটা জাতিকে একটা দেশের জনসাধারণকে শুধু পুলিশ ও মিলিটারির সাহায্যে বেশি দিন পদদলিত করে রাখা যায় না। … যদি জনশক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, যদি তাদের নৈতিক বল অটুট থাকে…।’’

আজ এই নৈতিক বলই মাথা তোলার শক্তি জোগাচ্ছে মানুষকে। পরস্পর হাত ধরে রাত জাগছে মানুষ, শয্যা কণ্টকময় হচ্ছে শাসকের।