আর জি কর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার পর সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা রক্ষায় আরও বেশি পুলিশি নজরদারির দাবি জোরালো হচ্ছে। কলকাতার পুলিশ কমিশনারও জানিয়েছেন, নারী-হিংসার প্রতি পুলিশ ‘জিরো টলারেন্স’ নিয়ে চলবে। এ কথা ঠিক, নারীরা যাতে অবাধে পথ চলতে পারে, কর্মস্থলে কাজ করতে পারে, তার জন্য পুলিশি নিরাপত্তা সব ক্ষেত্রেই জোরদার হওয়া দরকার। কোনও নারী বিপদে পড়ে ডাকলেই যাতে কাছাকাছি কোনও পুলিশের সহায়তা পেতে পারেন তার ব্যবস্থা হওয়াও জরুরি। তার জন্য পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো এবং সর্বত্র সিসি ক্যামেরা বসানো দরকার। কোনও অপরাধ ঘটলে তার তদন্তে এই ক্যামেরা অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে।
কিন্তু পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে এবং সর্বত্র সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে কি নারীদের উপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা অপরাধ কমানো যাবে? কিংবা নারী নিগ্রহ বা ধর্ষণ-হত্যার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কড়া আইন আনার দ্বারা? কী বলছে সরকারি তথ্য? ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে প্রতি ১৫ মিনিটে দেশে একজন মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন। নির্ভয়া কাণ্ডের পরে প্রবল গণবিক্ষোভের ধাক্কায় আইন বদলেছে, কঠোর হয়েছে সাজা। কিন্তু তার দ্বারা কি পরিস্থিতি বদলেছে? ওই তথ্যই বলছে, ২০২২ সালেও প্রতি ১৫ মিনিটে ধর্ষিতা নারীর সংখ্যাটা এতটুকু পাল্টায়নি।
অর্থাৎ শুধু আইন দিয়ে, পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে মহিলাদের উপর অপরাধ কমানো যেতে পারে না। তা ছাড়া, সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, পুলিশি ব্যবস্থাটিও যেমন একদিকে দুর্নীতিতে ছেয়ে রয়েছে, তেমনই ক্ষমতাসীন দলের অনুগত সেবক হিসাবে কাজ করার অভ্যাস পুলিশকে দলদাসে পরিণত করেছে। এই অবস্থায় পুলিশের পক্ষে স্বাধীন ভাবে কাজ করা যে সম্ভব নয়, আরজিকরে পুলিশি তদন্ত তার টাটকা প্রমাণ। পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস, চরম দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক দলগুলি আজ রাজনীতির যে দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েছে তাতে দেখা যায় ধর্ষক-খুনিদের বেশির ভাগই এ রকম কোনও না কোনও দলের মদতপুষ্ট। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শাসকরা শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তাদের আড়াল করতেই ব্যস্ত থাকে। তা সে এ রাজ্যের তৃণমূল সরকারই হোক, উন্নাও, হাথরস, কাঠুয়ার ঘটনায় বিজেপি সরকারই হোক বা পূর্বতন সিপিএম সরকারই হোক।
কেন্দ্রীয় সরকার নতুন ন্যায় সংহিতা আনার সময় পুলিশের হাতে অপরিসীম ক্ষমতা তুলে দেওয়ার অজুহাত হিসেবে বলেছিল, এর ফলে অপরাধ কমবে। কিন্তু পুলিশ নিজেই যেমন রাজ্যে রাজ্যে নানা অপরাধে অভিযুক্ত, তেমনই অভিযুক্ত ধর্ষক, নারী নির্যাতনকারীদের আড়াল করার জন্য। তা হলে উপায়? মহিলাদের উপর আক্রমণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন কি বাড়তেই থাকবে?
মনে রাখতে হবে, পুলিশ, সিসি ক্যামেরার সংখ্যা যতই বাড়ানো হোক, আইনকে যত কঠোরই করা হবে, সমাজে তার থেকে অনেক বেশি হারে বেড়ে চলেছে মহিলাদের উপর অপরাধের সংখ্যা। এবং তা এতই দ্রুত গতিতে যে তার সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থা তাল দিয়ে উঠতে পারছে না, পারবেও না। অর্থাৎ অপরাধের মূল উৎস অপরাধী তৈরির প্রক্রিয়াটিকে বন্ধ না করে শুধুমাত্র তার প্রতিরোধের ব্যবস্থা বাড়িয়ে তার মোকাবিলা করা যাবে না।
পুঁজিবাদী এই সমাজ মূলত পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষদের আধিপত্য সমাজ জুড়ে। আজও অধিকাংশ পরিবারেই শিশুরা শৈশব থেকেই শেখে মহিলারা পুরুষের থেকে সব দিক থেকেই পিছিয়ে। মহিলামাত্রেই ভোগের সামগ্রী। মহিলারা যে সব দিক থেকেই পুরুষের সমান ক্ষমতার অধিকারী– এই শিক্ষাটাই গড়ে ওঠে না। তাই মহিলাদের সম্মান দিতে, মর্যাদা দিতে তারা শেখে না। বরং একটা বিদ্বেষের মনোভাব গড়ে ওঠে। এমনকি বড় বড় ডিগ্রিধারীরাও নিজেদের ক্ষমতা বোঝাতে হামেশাই উল্লেখ করেন যে, তাঁরা চুড়ি পরে থাকেন না। টিভি সিরিয়ালগুলোতে অধিকাংশ নারী চরিত্রকেই দেখানো হয় বস্তাপচা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, পুরুষের নির্দেশে চলা কিছু পুতুল হিসাবে। ব্লেডের বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত নারী দেহ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে নারীকে ভোগের বস্তু হিসাবে তুলে ধরা হয়। সব সরকারই মদের ঢালাও লাইসেন্স দিয়ে চলেছে। সমাজমাধ্যমে পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি। অথচ সরকারগুলি চোখ বন্ধ করে রেখেছে। অর্থাৎ সমাজ পরিচালক যাঁরা তাঁদের মানসিকতাও সমাজ জুড়ে নারীর উপর আক্রমণের অনুকুল পরিবেশ তৈরি করে চলেছে। তাই মহিলারা সহজেই আক্রমণের শিকার হন।
এই যে সমাজ-মানসিকতা– এটা কি আইন করে আর সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে বদলানো যায়? এটা বদলানোর কথা ছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনে, যেটা ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, অর্থাৎ যখন আমাদের দেশে জাতি গড়ে উঠছিল। তখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামন্তী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বদল ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক মানসিকতার প্রসার ঘটানোর অর্থাৎ নারীর মর্যাদা, নারী-পুরুষ সমানাধিকারের বিষয়গুলিকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন ছিল। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশে যখন স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠেছে তখন আন্তর্জাতিক ভাবে পুঁজিবাদ তার প্রগতিশীল চরিত্র হারিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে। তার প্রভাব পুরোমাত্রায় পড়েছিল আমাদের দেশের বুর্জোয়া নেতৃত্ব তথা কংগ্রেস নেতৃত্বের উপর। তাই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে পুরনো মনন, ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি বদলের কাজটি গুরুত্বহীন হয়েই থেকে গেছে। অথচ একমাত্র এর মধ্য দিয়েই নারী-পুরুষ সমানাধিকার, নারীর প্রতি মর্যাদার মনোভাব সমাজে গড়ে উঠতে পারত। তা না হওয়ার ফলে, নারীর প্রতি সমমর্যাদার মানসিকতা গড়ে না ওঠায়– নারীকে দমন করে, নিষ্পেষণ করে প্রভুত্ব ফলাতে চায়, নারীকে অপমান করেও পুরুষ নিজেকে অপরাধী মনে করে না।
আজ যদি সমাজে নারীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হয়, মর্যাদা রক্ষা করতে হয় তবে যেমন সর্বত্র পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি করতে হবে, তেমনই নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষাটিকে সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। বাড়িতে, স্কুল-কলেজ সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে নারীকে সমান মর্যাদায় তুলে ধরতে হবে। আমাদের দেশে নবজাগরণ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, নজরুলরা নারীমুক্তির পক্ষে যে উজ্জ্বল শিক্ষাগুলি রেখে গেছেন, সেগুলির গভীর চর্চা আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে।
শরৎচন্দ্র তাঁর নারীর মূল্যে বলেছিলেন, ‘‘নারী লইয়া পুরুষের এই যে পুতুল-খেলা, এই যে স্বার্থপরতা, পাশববৃত্তির এই যে একান্ত উন্মত্ততা, সে শুধু নারী জাতিকেই অপমানিত ও অবনমিত করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, পুরুষ, …সমাজকে এবং সমস্ত মাতৃভূমিকে ঐ সঙ্গে টানিয়া নামাইয়া আনিয়াছে’’ (নারীর মূল্য)। নজরুল নারীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘‘মুছে ফেল যত দাসীর চিহ্ন, যেথা যত আভরণ।’’ এ একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন, মানসিকতা বদলের আন্দোলন। এই আন্দোলন নারী-পুরুষ সম্মিলিত ভাবে গড়ে তুলতে হবে। যে সমাজ প্রতি মুহূর্তে এই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার জন্ম দিয়ে চলেছে, সেই পুঁজিবাদী সমাজকে বদলে নতুন উন্নততর সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এই আন্দোলনকে। রেনেসাঁর আন্দোলন যেদিন গড়ে উঠেছিল, সেদিন এর মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্খা ছিল। আজও যদি সমাজ মননে বদল আনার জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে জোরদার করতে হয়, তবে তার মধ্যেও এই সমাজ পরিবর্তনের বিষয়টিকে যুক্ত করতে হবে। তা না হলে প্রবল প্রতিবাদের ফল হিসাবে হয়তো একটা ঘটনায় দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে, কিন্তু পর মুহূর্তে আরও অজস্র একই রকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আরজি করে মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার বিচার ও শাস্তি চেয়ে প্রতিবাদ করার সময় আমাদের এই কথাগুলিকে মনে রাখতে হবে।