দোকান-মালিকদের ধর্মীয় পরিচয়ের নির্দেশ বিশেষ মতলবেই

উত্তরাখণ্ডের কাঁওয়ার বা শিবভক্তদের যাত্রা বহু বছর ধরে চলছে। কিন্তু এ বছরই হঠাৎ যাত্রাপথের দোকানদারদের পরিচয় লিখে রাখার কথা উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড সরকারের মাথায় এল কেন? আপাতত সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ব্যাপারটা স্থগিত হলেও বিষয়টা ভাবিয়েছে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে। তাঁরা ব্যথিত, উদ্বিগ্ন।

উত্তর ভারত বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এই দুটি রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ বছরের পর বছর ধরে কাঁওয়ার যাত্রা করে থাকেন। শ্রাবণ মাসে হরিদ্বারের গঙ্গা থেকে জল নিয়ে শিবের মাথায় ঢালতে মাইলের পর মাইল খালি পায়ে পাড়ি দেন তারা। হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, দিল্লি থেকে পুণ্যার্থীরাও এই যাত্রায় অংশ নেন। কুম্ভে বা কাশ্মীরে অমরনাথ যাত্রার মতো এতেও প্রশাসনের বিশেষ নজরদারি থাকে, যাতে আগত অসংখ্য মানুষের কোনও অসুবিধা না হয়। সে তো প্রতিটি রাজ্যেই নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ভিড় সামলাতে সরকার এবং প্রশাসনকে তৎপর হতে হয়। কিন্তু এবার হঠাৎ কাঁওয়ার যাত্রা গোটা দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল কেন? কেনই বা তড়িঘড়ি জারি হল প্রশাসনিক নির্দেশিকা? কেনই বা সর্বোচ্চ বিচারালয়কে হস্তক্ষেপ করতে হল? কারণ প্রথমে মুজফফরনগর, পরে গোটা উত্তরপ্রদেশের প্রশাসন কাঁওয়ার যাত্রাপথের সর্বত্র বাধ্যতামূলক ভাবে খাবারের দোকানের মালিকদের নাম ও ফোন নম্বর টাঙানোর সরকারি নির্দেশিকা জারি করে বলেছে, নির্দেশিকা না মানলে মোটা টাকা জরিমানা করবে বা আইনি ব্যবস্থা নেবে। উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকার ও বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশও একই পথে হাঁটে।

সরকারের এই সিদ্ধান্তে যাত্রাপথের কয়েকশো ধাবা মালিক এবং হাজারে হাজারে কর্মচারী আশঙ্কায় পড়েন, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ধাবা বন্ধ করতে হলে তাদের রুটি-রুজি বিপন্ন হবে। তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিজনরাও সংকটে পড়বেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বহু বছর ধরে গড়ে ওঠা প্রীতির সম্পর্কও ক্ষুণ্ন হবে। জানা গেছে, ২০২৩-এ এক নির্দেশিকায় সংখ্যালঘুদের ধাবা চিহ্নিত করে সেগুলি বন্ধ করে দিয়েছিল যোগী সরকার। বর্তমানে ২৩০ কিলোমিটার সুদীর্ঘ কাঁওয়ার যাত্রাপথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মালিকদের যে কোনও ধরনের দোকান (খাবার, মুদি, ফল, সবজি পর্যন্ত) বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় বিজেপি সরকার, যদি তাঁরা নিজেদের নাম দোকানের সামনে লিখে না রাখেন। এমনকি সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থানগুলিকেও কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এই পরিকল্পনা হঠাৎ করে নেওয়া হয়নি।

কোনও মানুষ কী খাবে না খাবে, কে কোন ধর্মাচরণ করবে এটা একটা গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের নিজস্ব বিষয়। গণতন্ত্রের যতটুকু ঠাটবাট রয়েছে, সে ক্ষেত্রে এই অধিকারে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে কি? নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ পরস্পরের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে একসাথে আনন্দ উপভোগ করেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এটাই সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক আচরণ। এই সম্প্রীতির পরিবেশটিকে ভাঙাই বিজেপির লক্ষ্য। সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই এমন অগণতান্ত্রিক, অপমানজনক শর্ত চাপানো হচ্ছে। ‘কাঁওয়ারি’দের নিরাপত্তার অজুহাত তুলে ধাবা মালিকদের নেমপ্লেট লাগানোর নির্দেশ দিয়েছে সরকার, তা না লাগানোর ফলে যাত্রী নিরাপত্তা কী ভাবে বিঘ্নিত হচ্ছিল, কোথাও বলা হয়নি। আসলে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ্যে এনে তাদের ‘ওরা’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই সরকারের এই ঘৃণ্য পদক্ষেপ।

গণতান্ত্রিক সমস্ত মানুষ দলমত নির্বিশেষে এই ঘৃণ্য পদক্ষেপের নিন্দা করছেন তীব্র ভাষায়। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে স্থানীয় ধাবা মালিক এবং তাঁদের কর্মচারীরা বলছেন, ‘আগে প্রতি বছর আমরা সমস্ত যাত্রীদের পরিষেবা দিয়েছি। তাঁরাও জানতে চান না আমাদের ধর্মপরিচয়, আমরাও পরম বিশ্বাসে তাঁদের হাতে খাবার, ফল তুলে দিই। এমনকি যাত্রাপথে আহতদের শুশ্র+ষা করে সুস্থ করে তুলি। মানুষ হিসাবে মানুষের পাশে দাঁড়াই। এর সাথে যেমন আমাদের জীবন-জীবিকা যুক্ত, তেমনই রয়েছে মানবিকতাও।’ এই ঐক্যের ছবিই আঁকা রয়েছে কাঁওয়ার যাত্রাপথে সামলি, শাহরানপুর, মুজজফরনগর, বিজনৌর, খাটাউলি প্রভৃতি এলাকার মানুষের মনে!

আর এই একতাকেই ভয় পেয়ে তাতে ফাটল ধরাতে চায় বিজেপি সহ শাসক দলগুলি। তারা চায় হিন্দু-মুসলিম, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের মানুষ পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখুক। পরস্পর দ্বন্দে্ব লিপ্ত হোক। এ ভাবে তাদের মধ্যে বিভাজনের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে শাসকরা নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে চায়। দেশে কেন এত বেকার, কেন মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার হচ্ছে মানুষ, কেন অনাহারে মারা যাচ্ছে অসংখ্য শিশু, কেন চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে গরিবরা– এই অসংখ্য অপ্রিয় কেন-র উত্তর যাতে না দিতে হয়, তার মোকাবিলায় বিভেদ-রাজনীতি মহৌষধ। তাই তাকেই হাতিয়ার করেছে শাসক দল।

কাঁওয়ার যাত্রাপথে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বিদ্বেষ তৈরির অন্যতম কারণ গোটা দেশের সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রেখে শাসকের কাছে নতজানু হতে বাধ্য করা, অন্যদিকে উগ্র হিন্দুত্বে সুড়সুড়ি দিয়ে দেশের সংখ্যাগুরু ভোটব্যাঙ্ককে নিজেদের কবজায় রাখা। দেশের বেশিরভাগ মানুষ যাতে ধর্মের আফিমে বুঁদ হয়ে থেকে শাসকদের বদমায়েসি ধরতে না পারে, বুঝতে না পারে এই দলগুলির পৃষ্ঠপোষক পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থাটাই তাদের হতদরিদ্র অবস্থার জন্য দায়ী– সে জন্যই শাসকের এই কৌশল।

শুধু কিছু মৌখিক বিবৃতি কিংবা আইনি বিরোধিতার পথে এই বিদ্বেষ-রাজনীতির মোকাবিলা করা যাবে না। ক্ষমতাসীন দলগুলি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, বিরোধী দলগুলি ক্ষমতার দখল নেওয়ার জন্য সুযোগ পেলেই বিদ্বেষ রাজনীতিকে কাজে লাগায়। তাই বর্তমান ভোটসর্বস্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে এই ধর্ম-বর্ণের বিভেদকে দূর করা যাবে না, একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ তথা সেকুলার চিন্তার ব্যাপক চর্চা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়েই একে কিছুটা হলেও সংযত করা যেতে পারে– যে চিন্তার চর্চা ভোটসর্বস্ব এই দলগুলি কেউই করে না। প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কায়েম করতে হলে বদলাতে হবে এই সমাজ ব্যবস্থাকেই। নতুন সমাজ গঠনের সংগ্রাম যারা চালাচ্ছে, আজ তাদেরই শক্তিশালী করতে হবে।