আলু, সব্জিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম লাগামছাড়া। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার চুপ করে থেকে তা চলতে দিচ্ছে। কারও কারও প্রশ্ন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার কী-ই বা করতে পারে? কেউ কেউ মনে করেন, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের বিশেষ কিছু করার নেই। অনেকে মনে করেন, মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতির বিষয়, বাজারের নিয়মে তা ওঠা নামা করে। এখানে সরকারের করণীয় কিছু নেই। তাদের এই ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছে এ ব্যাপারে পূর্বতন কংগ্রেস ও সিপিএম সরকারের নিশ্চেষ্ট ভূমিকা দেখে। এই দুটি সরকারকেও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কোনও ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। ফলে বিরামহীন ভাবে বেড়েই চলেছে জিনিসপত্রের দাম। যদিও এর বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবাদও চলছে। সরকারের কাছে অবিলম্বে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের দাবি জানাচ্ছে এস ইউ সি আই (সি)-র মতো দল। কিন্তু সরকার কোনও ভূমিকাই নিচ্ছে না।
মূল্যবৃদ্ধি পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। অতি মুনাফার লক্ষ্য থেকেই পুঁজিবাদী অর্থনীতির উৎপাদক, পরিচালকরা জিনিসপত্রের দাম মাত্রা ছাড়া বাড়ায়। পুঁজিবাদী সরকারও নানা ভাবে মদত দিয়ে থাকে মূল্যবৃদ্ধিতে। ফলে কারণে-অকারণে বছরভর একটু একটু করে জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। অল্প অল্প বৃদ্ধি মানুষ সব সময় খেয়াল করে না। কিন্তু যখন মূল্যবৃদ্ধি মাত্রাছাড়া হয়, তখন তা জনগণের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই মূল্যবৃদ্ধিটা যদি চাল ডাল শাক-সবজি তেল নুন ইত্যাদি খাদ্যপণ্যে ঘটে থাকে, তা হলে তার অভিঘাতটা হয় মারাত্মক। তখন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের খুঁটিনাটি ভাল করে বোঝার প্রয়োজন হয়।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, জনস্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েই সরকারি দলের এমএলএ-এমপিরা জনগণের ভোট নিয়েছেন। তা হলে সেই প্রতিশ্রুতি তাঁরা সরকারে বসে রক্ষা করবেন না কেন? এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অতি মুনাফার জন্য জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটবে, তাদের অর্ধাহার, অপুষ্টির মধ্যে ঠেলে দেবে, আর সরকার এসব চুপচাপ দেখবে, এটাই কি সরকারের কাজ? সরকার এমন স্থবির হয়ে গেলে জনতরঙ্গের ধাক্কায় তাকে সক্রিয় করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।
মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকার কী করতে পারে? সরকারের যে কাজটি প্রথমেই করা উচিত তা হল, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে বেঁধে রাখার জন্য উপভোক্তা-বান্ধব আইন প্রণয়ন করা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অত্যাবশ্যক পণ্য আইন নামে একটি আইন ছিল। সেটি ২০২০ সালে মজুতদারদের স্বার্থে সংশোধন করা হয়েছে। পণ্য আইন (সংশোধন) ২০২০ অনুযায়ী, দানাশস্য, ডাল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ ও আলুর মতো বেশ কিছু ভোজ্যসামগ্রীকে অত্যাবশ্যক জিনিসপত্রের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে মজুতদার চক্র এইসব সামগ্রী যথেচ্ছ মজুত করে একতরফা দাম বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এটা এখনই আইন করে বন্ধ করা উচিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীগুলিকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। জনস্বার্থে এই আইনকে আরও কঠোর করা উচিত। সরকার চাইলে এ কাজ অনায়াসেই করতে পারে।
দ্বিতীয় যে কাজটি সরকার করতে পারে তা হল, গ্রামের হাট থেকে পণ্য কিনে শহরে আনা পর্যন্ত স্তরে স্তরে যে তোলাবাজি হয় তা বন্ধ করা। আনাজ কেনার সময় নানা কমিটি, সমিতির নামে মিডলম্যানদের কাছ থেকে তোলা আদায় হয়। বহু ক্ষেত্রে সরকারি আইন রক্ষকরা এই মিডলম্যানদের কাছ থেকে তোলা আদায় করে থাকে। রেলেও চলে তোলা আদায়। এতগুলি তোলা দেওয়ায় এবং তার সাথে মিডলম্যানদের দফায় দফায় মুনাফা যোগ হওয়ায় সবজির দাম হয়ে যায় মাত্রাছাড়া। এগুলি সরকার সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
তৃতীয় যে কাজটি সরকার করতে পারে তা হল, কৃষিপণ্যের ফরওয়ার্ড ট্রেডিং বন্ধ করা। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার ধীরে ধীরে চুক্তি চাষ চালু করে চলেছে। এই ব্যবস্থায় চাষের আগেই পুঁজিপতিরা কৃষকের ফসল কিনে নেয় এবং সেভাবেই চুক্তি হয়। এই কৃষি-পুঁজিপতিরাই আধুনিক মিডলম্যান। এরা খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারিগর। এদের আটকানো দরকার।
চতুর্থ এবং জরুরি যে কাজটি সরকার করতে পারে তা হল, খাদ্যপণ্যে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য প্রবর্তন এবং আইন করে ব্যক্তিগত ব্যবসা বন্ধ করা। রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য প্রবর্তনের কথা উঠলেই এক শ্রেণির পণ্ডিত বলতে শুরু করেন সরকারের কাজ কি ব্যবসা করা? তারা ভেবেই দেখে না বৃহৎ ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার আগ্রাসন থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার যে অধিকার দেশবাসীর আছে, তা সুনিশ্চিত করা সরকারের কাজ নয়? আর সেটা করার জন্য যদি খাদ্যদ্রব্যে মজুতদারদের দখলদারি খর্ব করতে হয় এবং সে জন্য রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য আনতে হয়, তা হলে সেটা তো গুরুত্ব দিয়ে করা উচিত। কেন তা নিয়ে বাহানা তোলা? মজুতদারদের কাছে একটা সরকার বিক্রি না হয়ে গেলে এটা করা তো তার উচিতই।
কিন্তু সরকার তা করছে না কেন? সরকার কেন নিষ্ক্রিয় থাকে? সরকার জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের প্রতিষ্ঠান– বইয়ে এসব কথা থাকলেও বাস্তবে ভারতের মতো একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে সরকার হল এই পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থারই পাহারাদার। পুঁজিপতি শ্রেণির সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা করাই তার কাজ। ফলে সে নেহাত বাধ্য না হলে জনগণের জন্য কিছু করবে না। এখানেই রয়েছে শক্তিশালী গণআন্দোলনের ভূমিকা।
কংগ্রেস আমলে পশ্চিমবঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আগুনঝরা বাম আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। সেই আন্দোলনে লাঠি-গুলি চলেছে। সে সব উপেক্ষা করে মানুষ লড়েছেন। ১৯৯০ এর দশকে সিপিএমের আমলেও মানুষ মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়েছেন। লাঠি-গুলি চলেছে। বহু আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। শহিদ হয়েছেন এস ইউ সি আই (সি)-র যুবকর্মী মাধাই হালদার। সেইসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে সরকার বদল হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদী শাসনযন্ত্র ও তার নীতিগুলির কোনও পরিবর্তন হয়নি। ফলে আবারও মূল্যবৃদ্ধির ছোবল। মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকারকে সক্রিয় করতে হলে আবারও আন্দোলনের প্রবল জোয়ারই তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা নেই। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) সেই আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।