২৩ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে কৃষক ও খেতমজদুর মহাপঞ্চায়েত
কৃষকের চাষের খরচ অত্যধিক হারে বেড়েছে, বাড়ছে ঋণগ্রস্ত চাষির সংখ্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে ঋণগ্রস্ত চাষির আত্মহত্যার সংখ্যাও। ২০১৫ থেকে ২০২২-এর মধ্যেই শুধু ১ লক্ষ ৪৭৪ জন কৃষক ও কৃষিশ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো)। গত ১০ মাসে শুধু মহারাষ্ট্রেই ২ হাজার ৩৬৬ জন কৃষক আত্মহত্যা করে জীবনের জ্বালা জুড়িয়েছেন। খেতে-খামারে গলায় ফাঁস দিয়ে বা কীটনাশক খেয়ে প্রায়শই কৃষকরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেন?
কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। ধান সহ ১৪টি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্প্রতি নামমাত্র বাড়িয়ে তাদের কৃষক-দরদ প্রমাণ করতে ঢাকঢোল পেটাচ্ছে বিজেপি সরকার। ধানে প্রতি কুইন্টালে বাড়িয়েছে ১১৭ টাকা। অর্থাৎ কেজি প্রতি বৃদ্ধি মাত্র ১.১৭ টাকা। এটা চাষির সাথে ঠাট্টা নয়!
প্রতি কুইন্টাল ধানে অন্তত ৩১০০ টাকা না পেলে চাষির ন্যূনতম লাভ থাকে না। সেখানে সরকার মাত্র ২৩০০ টাকা সহায়ক মূল্য ঘোষণা করেছে। এতে যে চাষিদের ক্ষতির মুখেই পড়তে হবে, তা কি সরকারের যে মন্ত্রী-আমলারা এই মূল্য স্থির করছেন, তাঁদের অজানা? যদি সত্যিই অজানা হয় তবে তো তাঁরা এই কাজের যোগ্যই নন। আর যদি জেনেই এ কাজ করেন, তবে এই সরকারকে কৃষক স্বার্থবিরোধী বলা হবে না কেন?
২০২০-২১-এ দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল– স্বামীনাথন কমিটি নির্ধারিত হারে এমএসপি দিতে হবে। ফসলের ন্যায্য দাম চাষির হাতে পৌঁছনোর জন্য সরকারের ফসল কেনার সুব্যবস্থা, চাষির লোকসান হলে সরকারি সহায়তা বা ঋণ মকুব, সস্তায় বীজ-সার-কীটনাশকের বন্দোবস্ত ইত্যাদি। এগুলি কি একটা নির্বাচিত সরকারের কাছে দেশের কৃষকদের খুব অন্যায় দাবি? অথচ সেই দাবিগুলি মেনে নিতে সরকার নারাজ। এক কথায় দেশের কৃষকরা যাতে ঠিকমতো সংসার প্রতিপালন করতে পারে এবং আগামীতে খাদ্য উৎপাদন বজায় রেখে দেশবাসীর জন্য খাদ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে পারে, সে জন্য অপরিহার্য ন্যূনতম অধিকার তারা দাবি করেছিল। তার সাথে তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল– কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেট মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না। কর্পোরেটদের হাতে ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিজেপি সরকার যে আইন আনতে চেয়েছিল, তার বিরুদ্ধে দেশের কৃষকরা দিল্লির রাস্তায় শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা অগ্রাহ্য করে, পুলিশি দমন-পীড়ন সহ্য করে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন। শহিদের মৃত্যু বরণ করেছেন ৭০০-র বেশি কৃষক। আন্দোলনের চাপে সরকার বাধ্য হয়েছিল কৃষক-বিরোধী তিনটি কালা আইন প্রত্যাহার করতে। কিন্তু এমএসপি-র প্রতিশ্রুতি সরকার রক্ষা করেনি। ফলে কৃষক সমাজের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। বাড়ছে বিক্ষোভ এবং তা আন্দোলনের আকারে মাঝেমধ্যেই ফেটে পড়ছে। অথচ সরকার চাইলেই সার-বীজ-কীটনাশকের দাম নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বেঁধে দিয়ে বা ভর্তুকি দিয়ে ফসলের উৎপাদন খরচ কমাতে পারত। তা না করে বহুজাতিক সংস্থার অবাধ লুঠের জন্য এগুলি তাদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। মনসান্টো সহ ২০টি বহুজাতিক কোম্পানি সার, বীজ, কীটনাশক উৎপাদন ও বিক্রির বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা কৃষকের পকেট কেটে নিজেদের লাভের ভাণ্ডার আরও ভরিয়ে তুলছে। সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
যেহেতু ফসল বিক্রির সরকারি ব্যবস্থাপনা নেই, তাই কৃষককে যেতে হয় ফড়ে-আড়তদার এবং ব্যবসায়ীদের কাছে। এই সুযোগে অত্যন্ত কম দামে চাষির কাছ থেকে ফসল কিনে নেয় মুনাফাবাজরা। সেই ফসলের একটা অংশ বাজারে বিক্রি করে চড়া দামে। বাকি অংশ মজুত করে রেখে দেয়, চাহিদা বাড়লে আরও বেশি মুনাফায় বিক্রি করার জন্য। এই মধ্যস্বত্বভোগী আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলির শোষণের শিকার একদিকে চাষিরা, অন্য দিকে খাদ্যদ্রব্যের ক্রেতা বিপুল সংখ্যক জনসাধারণ।
সরকারি ঋণ-ব্যবস্থাও অত্যন্ত জটিল। চাষিরা সহজে সেই ঋণ পান না। ফলে কৃষকরা গ্রামীণ মহাজন-সুদখোরদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন। সেই ঋণ শুধতে বহু সময়েই কৃষককে সর্বস্বান্ত হতে হয়। যতটুকু ব্যাঙ্কঋণ চাষিরা পান, চাষে ক্ষতি হলে সেই ঋণ মকুবের বিষয়ে উচ্চবাচ্য পর্যন্ত করে না সরকার। কিন্তু কর্পোরেট কোম্পানিগুলির ঋণ মকুব হয়ে যায় অনায়াসে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের চাষিদের মধ্যে এই প্রশ্ন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে যে, এই সরকার– কৃষকদের না কর্পোরেট-মালিকদের?
এখনও কৃষি মূলত প্রকৃতি-নির্ভর। তাপপ্রবাহ, খরা, বন্যা, অসময়ে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টির কারণে কৃষকের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফসল বিমা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বাঁচার একটা অবলম্বন। এর জন্য সরকার ঘোষিত ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’ রয়েছে। কিন্তু তার এমন সব জটিল শর্ত রয়েছে, যাতে ক্ষুদ্র ও মধ্য চাষির কাছে এর সুযোগ প্রায় পৌঁছয় না। কিন্তু বিমার সুযোগ কর্পোরেট কোম্পানিগুলি অনায়াসেই হস্তগত করে।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো সেচ ও বিদ্যুৎ বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিয়েছে সরকার। ফলে চাষের জন্য কৃষককে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। সরকারের হাতে থাকলে স্বল্পমূল্যে কিংবা বিনামূল্যে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ নিতে পারত কৃষক। এখন বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি স্মার্ট মিটার নিয়ে আসায় বাড়তি বিদ্যুৎ বিলের বোঝা গৃহস্থের সাথে চাপছে কৃষকের ঘাড়েও। সরকারের কৃষি-নীতি কৃষিকে অলাভজনক করে তুলছে।
এ ছাড়াও সরকারি অবহেলার শিকার হচ্ছেন গ্রামীণ বেকার যুবকরা। ১০০ দিনের প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি-শ্রমিক হিসাবে কিছু কাজ করানো হয় কৃষিক্ষেত্রে। কিন্তু তাদের কর্মদিবস দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪২-এ। মজুরি বৃদ্ধির দাবিও মানা হয়নি। গ্রামীণ বেকার যুবকদের কোনও রকমে দিন যাপনের ক্ষেত্রে এই প্রকল্পের কিছুটা হলেও যে ভূমিকা ছিল এবং যাতে কৃষকদেরও অনেকখানি সুবিধা হত, বরাদ্দ কমিয়ে তাকে আরও খোঁড়া করে দিয়েছে সরকার।
এক সময়ে বামপন্থী আন্দোলনের স্লোগান ছিল ‘কৃষককে জমি দাও’। আজ দেশের পুঁজিবাদী সরকারগুলির স্লোগান ‘কর্পোরেটকে জমি দাও’। বনবাসী-উপজাতি-জনজাতি এলাকাগুলিতে কোনও ক্ষতিপূরণ না দিয়েই, কোথাও নামমাত্র দিয়ে খনি ও অন্যান্য কাজের অজুহাতে বহুজাতিক কোম্পানি জমি লুট করছে সরকারি সহায়তায়।
সরকারের সহায়তায় কর্পোরেটের কৃষিক্ষেত্রকে লুটের মোকাবিলা করতে হলে দিল্লির কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে কৃষক ও খেতমজুরদের সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। খেত-খামার থেকে শহর সর্বত্র আওয়াজ তুলতে হবে– কৃষক স্বার্থে সরকারি কৃষি-নীতি তৈরি করো, কর্পোরেটদের স্বার্থে নয়।
ইতিমধ্যেই সংগ্রামী কৃষক সংগঠন এআইকেকেএমএস-এর নেতৃত্বে রাজ্যে রাজ্যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এআইকেকেএমএস সহ অন্যান্য কৃষক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ ‘সংযুক্ত কিসান মোর্চা’র নেতৃত্বে দিল্লিতে কৃষকদের আন্দোলন চলেছে লাগাতার। সেই আন্দোলনকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে সংযুক্ত কিসান মোর্চা ৯ আগস্ট ‘কর্পোরেট হটাও’ দিবসের ডাক দিয়েছে। এআইকেকেএমএস ন্যায্য এমএসপি, ফড়েদের হাত থেকে চাষি ও জনসাধারণকে বাঁচাতে চাষির কাছ থেকে সরাসরি ফসল কিনে সরকারি ব্যবস্থাপনায় জনগণের মধ্যে বিক্রি, বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, কৃষক ও খেতমজুরদের পেনশনের দাবি সহ অন্যান্য দাবিতে ২৩ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে কৃষক ও খেতমজুরদের মহাপঞ্চায়েতের ডাক দিয়েছে।