ঘটনা একঃ পঁচিশ বছরের যুবক, জন্মদিনের পার্টিতে বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছিল। আয়োজনও মন্দ ছিল না। সঙ্গে ছিল মদ। সেটি অবশ্যই দরকার, আর কিছু থাক বা না থাক। সেই আয়োজনেই বোধহয় একটু খামতি ছিল, বা বলা ভাল, বন্ধুদের রাক্ষুসে তেষ্টার কাছে তা কম পড়ে গিয়েছিল। তারই মাশুল গুনতে হল ‘বার্থ ডে বয়’-কে। পাঁচতলার উপর থেকে তাকে ফেলে দেওয়া হল নিচে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় তার।
এরকমই মদ্যপ অবস্থায় নানা ধরনের অসামাজিক কাজ, ধর্ষণ, গণধর্ষণের মতো ভয়ানক ঘটনা হামেশাই ঘটে চলেছে, যা দেখে অনেকেই দুঃখ পান। সমাজটা কোথায় চলেছে বলে হা-হুতাশ করেন। কিন্তু কোনও সমাধান হয় না তাতে। ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলে। সরকারি উদ্যোগে খোলা হতে থাকেই আরও মদের দোকান। উৎসবের সময় দিন রাত যাতে মদের জোগান অব্যাহত থাকে, সেদিকে কড়া নজর থাকে সরকারের। হাসপাতালে চিকিৎসা, ওষুধের জোগান না থাকলেও ক্ষতি নেই, মদের দোকান খোলা থাকা চাই– সরকারের মনোভাব এমনই। যত খুশি মদ খাও, ফুর্তি করো, অমানবিক, অসামাজিক হও, ক্ষতি নেই। মদ বিক্রি করে টাকা আসুক সরকারি ভাণ্ডারে। প্রাপ্তি আরও – মদ খেয়ে ঝিমিয়ে থাকলে বেলেল্লাপনা করবে কিন্তু চাকরি চাইবে না, ন্যায়-অন্যায়ের কথা তুলবে না, প্রতিবাদ করবে না। এমন অবস্থাই তো শাসকের আদর্শ।
ঘটনা-দুইঃ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সবং-এর মশাগ্রাম নামের একটি অখ্যাত গ্রাম। সেখানে সরকারি মদের দোকান খোলার প্রচেষ্টা রুখে দিলেন গ্রামেরই সাহসী কয়েকজন মহিলা। তাঁদের পাশে এক জোটে দাঁড়ালেন সাধারণ নাগরিক এবং বিশিষ্ট মানুষজন। মদের দোকান খোলার পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেই গ্রামের মানুষের উদ্যোগে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভাবে আবগারি দপ্তর, জেলাশাসক, সবং থানার বিডিও, ওসি, অঞ্চল প্রধান এবং সেখানকার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার কাছে গ্রামবাসীদের স্বাক্ষর সংবলিত চিঠি দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও দশগ্রাম অঞ্চলের তৃণমূল নেতা অনন্ত তুং-কে মদের দোকান খোলার সরকারি লাইসেন্স দেওয়া হয়। তুং সাহেব আগে খাজুরি দশগ্রামে মদের দোকান খোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে খুলতে পারেননি। চলে আসেন মশাগ্রামে। এই স্থানের অদূরে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। এলাকার মানুষজন দলমত নির্বিশেষে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। মায়েরা ঝাঁটা, লাঠি নিয়ে বেরিয়ে আসেন। শুরু হয় মদের দোকানের পাশে বিক্ষোভ, মিছিল, অবস্থান। দোকানে তালা লাগিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা। দেহাটি-দিঘা রাস্তা অবরোধের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে প্রশাসন মদের দোকান বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। মন্ত্রীও বলতে বাধ্য হন, ‘গ্রামের মানুষ চান না, তাই মশাগ্রামে আর মদের দোকান খোলা হবে না।’
কায়েমি স্বার্থবাদীরা মদের নেশায় যুবসমাজকে যতই বিপথগামী করতে চেষ্টা করুক, সমাজের ভিতরে থাকা শুভবুদ্ধির শক্তি অবশ্যই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। দাঁড়াচ্ছেও।