ভোট তো হল, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের লক্ষ লক্ষ শূন্য পদে নিয়োগ হবে কবে

এই লেখাটা পড়ার সময় মনে করুন, আপনার ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিন বছর বসে আছে চাকরির আশায়। ধরুন আপনার মেয়েটি মাস্টার্স করে বসে আছে পাঁচ বছর। ধরুন আপনি শিক্ষাঋণ নিয়ে খ্যাতনামা বেসরকারি কলেজে সন্তানদের পড়িয়েছেন। এদিকে চাকরির কোনও পরীক্ষাই হচ্ছে না, নিয়োগ কার্যত বন্ধ দীর্ঘদিন। ভাবছেন ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভাবছেন কী দিয়ে ঋণ শোধ করবেন? বেড়ে চলা সুদই বা দেবেন কী করে? এসব চিন্তায় আপনার ঘুম আসে না।

এই পরিস্থিতিতে যদি একটা নির্বাচন আসে, ভোট দেওয়ার আগে কী ভাববেন আপনি? আপনার ছেলের চাকরির প্রশ্নটি কি প্রধান গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন না? অবশ্যই মানুষ এভাবেই ভাববে। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে বেকারত্বের প্রশ্নটি এভাবেই সাধারণ মানুষের সামনে অন্যতম প্রধান বিচার্য বিষয় হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নটিও মানুষকে ভাবিয়েছে। যার ফলে সাম্প্রদায়িক ইসু তুলেও বিজেপি মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। ফলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে বিজেপি।

এই পরিস্থিতিতে ১৪ দলের জোড়াতালির সরকার গঠিত হয়েছে। কেউ কেউ বলছে টিকবে না। পাঁচ বছরের আগে আরেকটা নির্বাচন হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে যাই ঘটুক, অর্থাৎ সরকার স্থায়ী হোক বা মাঝপথে ভেঙে যাক, সে সব তো শুধু সংশ্লিষ্ট দলগুলির স্বার্থের খেলা। সরকারের স্থায়ীত্বের সাথে মানুষের জীবনের স্থায়ীত্বের সম্পর্ক নেই। জনগণকে যে বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে তা হল সরকার পরিচালনার নীতি কী হবে? তা কি জনস্বার্থে পরিচালিত হবে, না তার বিরুদ্ধে, জনগণের কাছে এটাই প্রধান বিচার্য বিষয় হওয়া উচিত।

যে বেকারত্ব নির্বাচনী লড়াইয়ে একটা মারাত্মক ইস্যু হিসেবে কাজ করল, তার সমাধান নিয়ে মোদি সরকারের ভাবনা কী? এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরে শূন্যপদের সংখ্যা ৩০ লাখ। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের শূন্যপদ ৩ লাখ ৫৮ হাজার। এগুলিতে নিয়োগের কোনও সরকারি ঘোষণা লক্ষ করা যাচ্ছে না। অন্য দিকে শিল্পায়ন হচ্ছে না। শিল্প কোথায় হবে, কী শিল্প হবে কেউ জানে না। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয় থেকে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ২০২০-২১, ২১-২২ ,২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের সাধারণ মানুষের সঞ্চয় কমেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্টেও বাজারের চাহিদা কমে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, দেশে বেকারি বেড়ে চলার কারণে আয় কমে গিয়ে পরিবারের সঞ্চয় বিপুল হারে কমেছে। একই সঙ্গে পরিবার পিছু ঋণের বোঝাও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে কী করে? সাধারণ মানুষের সঞ্চয় কমে গেলে, শিল্পপণ্যের বাজার সৃষ্টি হবে কী করে? আর এই বাজারই যদি না থাকে তাহলে শিল্পায়ন হবে না।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন বলছে, ২০২০-২২ সালের মধ্যে ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্পে কেন্দ্রীয় মোদি সরকার প্রকৃত মজুরির হার প্রতি বছরে এক শতাংশ করে কমিয়েছে। আবার মোদি সরকারের ১০ বছরে সব জিনিসের দাম কমপক্ষে প্রায় পাঁচ শতাংশ বেড়েছে। ফলে সব মিলিয়ে সিংহভাগ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেমে গেছে। এই অবস্থায় আন্তরিকতার সাথে চাইলেও কি শিল্প হতে পারে? বাস্তবে শিল্পের নামে ভোটের মুখে শুধু প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হয়, শিল্পায়নের প্রস্তাব থেকে যায় ফাইলবন্দি হয়ে।

বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট প্রায় প্রতি বছরই তৃণমূল সরকার করে থাকে। গত বছরেও করেছে। তাতে কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। গত ১৩ জুন বৃহস্পতিবার নবান্নে শিল্পপতিদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি তাদের পাশে থাকার বার্তাও নতুন করে শুনিয়েছেন, আবার বিজনেস সামিট করবেন বলেছেন। কিন্তু যে প্রশ্ন এতদিন এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) তুলত, সে প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনিক মহলেও। প্রশাসনের একাংশের আধিকারিকদের প্রশ্ন, এতদিন ধরে যে সামিটগুলি হয়েছে, তাতে কী বিনিয়োগ এসেছে এবং বাস্তবায়িত হয়েছে? আসলে বিজনেস সামিটগুলি বাস্তবে একটা শিল্পায়নের লোভনীয় ললিপপ, আশার ছলনায় মানুষকে আটকে রাখার নতুন প্রকরণ।

ফলে শিল্পায়ন হবে, ঘরে ঘরে চাকরি হবে, উন্নয়নের জোয়ার বইবে, আজ একচেটে পুঁজিবাদের স্তরে এসব অলীক ভাবনা। তা হলে হাতের কাছে চাকরির জন্য রইল কী? সরকারি শূন্য পদ পূরণ। সেটা তো কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার চাইলে করতে পারে। করছে না কেন? মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় ভাটা পড়ায় এ বাবদেও খরচ কমানো হচ্ছে।

কেন্দ্রের বিজেপি, রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে এ বিষয়ে তৎপর করতে হলে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া পথ নেই। শিক্ষকপদ সহ সমস্ত শূন্যপদ পূরণের দাবিতে প্রতি বছর নিয়োগ পরীক্ষা নিতে হবে। পরীক্ষা সংক্রান্ত মামলাগুলি দ্রুত নিষ্পত্তি করে নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মী ও কর্মসংকোচন নীতি সরকারকে বাতিল করতে হবে। এই সব দাবি নিয়ে আন্দোলনের উপর নির্ভর করছে শূন্যপদ পূরণের বিজ্ঞপ্তি সরকার জারি করবে কি না।