প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর নির্বাচনী সভাগুলিতে বিদ্বেষ ভাষণের মধ্য দিয়ে যে বিষ দেশ জুড়ে মানুষের মনে ঢেলে দিলেন, তার সাফাই হবে কীসে? যদিও মানুষ এর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, তবুও তা দীর্ঘদিন ধরে সমাজমননে কাজ করে যেতে থাকবে। যে ভাষা তিনি তাঁর বত্তৃতাগুলিতে ব্যবহার করেছেন এবং মানের দিক থেকেও তা এত নিচু যা এর আগে কোনও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। স্বাভাবিক ভাবেই গণতান্ত্রিক মানুষের মনে এ প্রশ্ন বারবার ধাক্কা দিচ্ছে যে, দেশের সর্বোচ্চ নির্বাচিত পদে থাকা একজন ব্যক্তি হয়ে প্রধানমন্ত্রী এত নিচে নামতে পারলেন কী করে?
নির্বাচনের প্রথম দফাতেই বিজেপি নেতৃত্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, গেরুয়া শিবিরের পক্ষে কোনও ভোটের হাওয়া নেই। অথচ ক্ষমতার ভোগদখল ধরে রাখতে মরিয়া বিজেপি। এই রকম পরিস্থিতিতে বিজেপি নেতৃত্বের সামনে একটি রাস্তাই খোলা থাকে, তা হল ধর্মের উস্কানি দিয়ে হিন্দু ভোটকে এক জোট করা। প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির অন্য তাবড় নেতারা দৌড়তে শুরু করে দেন বিভেদ তৈরির পুরনো রাস্তা ধরেই। মুসলিম বিদ্বেষের ফোয়ারা ছুটতে থাকে তাঁদের মুখে মুখে। কংগ্রেসের ইস্তাহারে ‘মুসলিম লিগের মনোভাব’ খুঁজে পান মোদি। বলেন, কংগ্রেস হিন্দুদের বাড়তি সম্পদ, গরু-মহিষ, এমনকি মহিলাদের মঙ্গলসূত্রটি পর্যন্ত মুসলিমদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। বত্তৃতায় জনতার উদ্দেশে বলেছেন, আমার ৪০০ আসন দরকার, না হলে কংগ্রেস বাবরি মসজিদের তালা রামমন্দিরে লাগিয়ে দিতে পারে।
মিথ্যাচারের নতুন প্রকল্প হিসাবে চতুর্থ দফা ভোটের আগে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের তৈরি করা একটি মনগড়া রিপোর্ট, যা বাস্তবের সম্পূর্ণ বিপরীত, তা তুলে ধরে বিজেপি প্রচার করতে নামে, দেশে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছে এবং হিন্দুদের সংখ্যা কমছে– যাতে হিন্দুদের মনে সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সপ্তম তথা শেষ পর্বের আগে মোদি শুধু হিন্দু-মুসলমান বিভাজন তৈরিতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের একটা বড় অংশ যেহেতু খ্রিস্টান তাই মোদি সেখানে মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে খ্রিস্টানদের মনে মুসলিম বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলতে বলেন, অনুপ্রবেশকারীদের কারণে জনজাতি সমাজের মেয়েরা ‘লাভ জেহাদের শিকার হচ্ছেন। এবং তাতে মদত দিচ্ছে শাসক দল জেএমএম। তিনি নিজেকে তাঁদের এক রক্ষাকর্তা হিসেবে তুলে ধরতে বিরোধী দলগুলির নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যতদিন আমি বেঁচে রয়েছি, বিরোধীরা কোনও ভাবেই জনজাতি দলিত, ওবিসিদের সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে যারা ভোট জেহাদ করে তাদের দিতে পারবে না।
এত বিদ্বেষ ছড়িয়েও নিজের উপর ভরসা রাখতে পারেননি মোদি। অবশেষে নিজেকে ‘পরমাত্মার’ প্রেরিত দূত হিসাবে তুলে ধরেছেন। বলেছেন, পরমাত্মাই আপন অভিপ্রেত কাজ করে যাওয়ার জন্য তাঁকে ধরাধামে পাঠিয়েছেন। এবং ২০৪৭ সাল অবধি সেই কাজ সম্পন্ন করার জন্য তিনি বিরাজমান থাকবেন। কেন এ কথা বললেন? দেশের বড় একটা অংশের মানুষের মধ্যে ধর্ম নিয়ে যে আবেগ রয়েছে, তাকে এই ভাবে ভোটের কাজে লাগাতে চেয়েছেন তিনি। নিজেকে ঈশ্বরের দূত বলে প্রচার করে মোদি প্রকারান্তরে বোঝাতে চেয়েছেন, মোদির বিরোধিতা করা মানে ঈশ্বরের বিরোধিতা করা।
প্রধানমন্ত্রীর এই যে বিদ্বেষ-ভাষণ, যা একই সঙ্গে মিথ্যাভাষণও, তা এমন অনায়াসে চালিয়ে যেতে সাহস করলেন কী করে? যে নির্বাচন কমিশন দেশের গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাটি পরিচালনা করছে সেই কমিশন কেন তাঁকে বিদ্বেষ-ভাষণে বাধা দিল না, কেন তাঁর কৈফিয়ত তলব করল না? তাবড় বিরোধী দলগুলি, যারা ভোটের বাজারে আসর জমিয়ে বসে থেকেছে, তারাই সরকার গড়বে বলে হুঙ্কার ছেড়েছে, তারা কেন এর প্রতিটি মিথ্যাচার চিরে চিরে দেশের মানুষকে দেখিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যাচারী হিসাবে কাঠগড়ায় তুলল না? এই জন্যই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন কমিশন তৈরির এতদিনের প্রথা বদলে ফেলে নিজের ইচ্ছামতো করে সেটিকে গড়ে তুলেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই কোনও কিছু না শোনার ভান করেই কমিশন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্বেষ ভাষণ চলতে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর এই বিদ্বেষ-ভাষণ সমাজে কী ক্ষতি ডেকে আনতে পারে?
ভারতীয় মুসলমানদের বিদেশি বলে দেগে দেওয়া এবং তাঁদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ক্রমাগত নানা মিথ্যা মন্তব্য করার উদ্দেশ্য শুধু পরাজয়ের ভয়ে ভীত হয়ে হিন্দুভোট এক করাই নয়, গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের মনের মধ্যে যে মুসলিম-বিদ্বেষ ইতিমধ্যেই নানা কারণে গড়ে উঠেছে, তাকে আরও বাড়িয়ে তোলাও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রধানমন্ত্রীর বত্তৃতাগুলি মুসলিমদের বিরুদ্ধে নতুন করে অন্ধ বিদ্বেষের জন্ম দেবে এবং বিজেপি-আরএসএস বাহিনীর যে অংশটি ইতিমধ্যেই মুসলিমদের আক্রমণের নিশানা করেছে তাদের উৎসাহিত করবে। এর ফল হিসেবে সমাজে বিভাজন আরও চওড়া হবে। ধর্ম, জাতপাতকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়বে। বাস্তবে এই বিভাজন তৈরি এবং তাকে বাড়িয়ে তোলার কাজটি পুঁজিবাদী শোষণ-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শোষিত মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে দুর্বল করতে পুঁজিপতি শ্রেণির সামগ্রিক ষড়যন্ত্রেরই অংশ।
নরেন্দ্র মোদি গত দশ বছরে যে ভাবে তাঁর ব্যক্তিগত ইমেজ গড়ে তুলেছেন, যে ভাবে এক অংশ দেশবাসীর মধ্যে নিজেকে অতিশক্তিশালী, অপ্রতিরোধ্য এবং হিন্দু অবতার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তাঁর বিদ্বেষপূর্ণ বত্তৃতাগুলি শুনে শ্রোতারা যে ভাবে তালি দিচ্ছেন, তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যে ভাবে অবতারের মুখনিঃসৃত বাণী বলে এক অংশের মানুষ গ্রহণ করছেন তার ফল কতখানি মারাত্মক হতে পারে, তা বুঝতে কোনও সচেতন মানুষেরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এর ভয়ঙ্কর পরিণাম প্রধানমন্ত্রীরও অজানা নয়। তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী অবিরল ধারায় এই মিথ্যাচার করে গেছেন।
ব্যাপারটি শুধু ভোটের ফলাফলের বিষয় নয়। বিজেপি-আরএসএসের দীর্ঘ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফল হিসাবে ইতিমধ্যেই যে সামাজিক কাঠামোটা নড়ে উঠেছে, রাষ্ট্র-প্রধানের মুখ থেকে এমন ধারাবাহিক প্ররোচনা তাকে আরও নড়বড়ে করে তুলবে। দেশের যে বিরাট শিক্ষিত অংশ রয়েছে, যাঁরা এই বিপদ কিছুটা হলেও বোঝেন, তাদের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ হলেও তা জোরালো হল না। অথচ এটা অত্যন্ত জরুরি ছিল।
বাস্তবে গত এক দশকে এটা পরিষ্কার যে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে শিক্ষা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে দেশের মানুষ পেয়ে চলেছে, তার মধ্যে দিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমালোচনামূলক তথা খুঁটিয়ে বিচার করার দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী মনন তৈরি এই শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য নয়। তাই এমনকি বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং ছাত্রদেরও এই শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে ওঠে না।
এই শিক্ষাব্যবস্থার গুণে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশের মধ্যে এমন একটা বুদ্ধিবৃত্তি কাজ করে চলেছে, যা কার্যত শূন্যগর্ভ। একজন সমাজমনস্ক, অনুভূতিশীল সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করার পরিবর্তে তা শুধুমাত্র কাজের দক্ষতাতেই দড় করে তোলে, চিন্তাশক্তিরহিত, দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলে। গোটা স্কুল এবং কলেজ শিক্ষাটাই আবর্তিত হচ্ছে এমনই ‘বুদ্ধিমান রোবট’ তৈরিকে কেন্দ্র করে যাতে জীবন বস্তুগত ভাবে সুখের হয়। এই শিক্ষার মধ্যে নৈতিকবুদ্ধি, মানবতা, সমাজমনস্কতা, দরদবোধ, ভালবাসার জায়গা থাকে না। বরং এইসব গুণগুলি থাকলে তা সমালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। কারণ এগুলির কোনওটিই বাজারের ধর্ম অনুযায়ী অধিক উৎপাদনে সহায়তা করে না। সমাজের এই অংশটিই করোনা দূর করতে মোদির থালা বাজানোর ডাকে অতি সহজে সাড়া দেয়।
আর যে বুদ্ধিবৃত্তি মতবাদিক আদানপ্রদানের দরজা বন্ধ করে দেয়, পরমত সহিষ্ণুতা থেকে দূরে থাকে তা ঘৃণা এবং গুজবের সহজ শিকার হয়। সমাজের এই অংশটি হয়ে ওঠে বিজেপির তথা নরেন্দ্র মোদির ভক্ত। তারাই মুসলমানদের মধ্যে তাদের জীবনের সব অপ্রাপ্তি, বঞ্চনার জন্য দায়ী কল্পিত শত্রুকে খুঁজে পেয়ে তার বিরদ্ধে সব ক্ষোভ উগরে দেয়। আর এ-সব কিছুর জন্য আসলে যে দায়ী সেই পুঁজিবাদ থেকে যায় আড়ালে। এই অংশটিই শাসকের মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত হয় সবচেয়ে বেশি। বহু খুঁজেও নিজের জীবনে উন্নয়নের কোনও ছোঁয়া খুঁজে না পেয়েও শাসকের সাথে গলা মিলিয়ে বলতে থাকে– দেশ এগোচ্ছে।
বিজেপির হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটি তো সফল শুধু এই জন্য নয় যে, তারা তাদের প্রচারকে আপাত যুক্তিপূর্ণ করে প্রচার করে এবং ব্যাপক ভাবে সেগুলিকে ছড়িয়ে দেয়, তা সফল এই জন্যও যে, এই ধরনের মানুষদের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে ঘৃণাটা সহজেই ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং তাদের ক্ষিপ্ত করে তোলা যায়। এরই ফলে সমাজ জীবনে, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে অনুভূতিহীন শব্দের, কথার, মতের ঝড় উঠতে পারছে।
প্রশ্ন হল, দেশের মানুষ, যারা এর মারাত্মক বিপদটা কিছুটা হলেও ধরতে পারে, তারা কি চোখের সামনে এতবড় একটা সর্বনাশ নীরবে ঘটতে দেবে? সমাজমনন যদি বিদ্বেষ-বিষে পূর্ণ হয়ে ওঠে তবে ব্যক্তির দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে যায়, সত্য বিচারের ক্ষমতা কমে যায়। মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। তাতে ক্ষতি সবচেয়ে সাধারণ মানুষেরই। কারণ তারা তখন শাসকের বিচারবুদ্ধিতেই সব কিছুকে বিচার করতে থাকে। তাতে লাভ শাসক শ্রেণিরই, যারা নিশ্চিন্তে দেশের ৯৯ ভাগ মানুষকে শোষণ করে নিজেদের মুনাফার ভাণ্ডারকে আকাশছোঁয়া করে চলেছে। তাই আজ সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সত্যের চর্চা, যুক্তির চর্চা, ইতিহাসের চর্চা। প্রয়োজন শাসক শ্রেণির প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের স্বার্থকে খুঁজে বের করতে শেখা, যা বাস্তবে নিজেকে শ্রেণি সচেতন করে তোলা। প্রয়োজন যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষতাকে বোঝা এবং তার চর্চা করা। এ না হলে বারে বারেই শোষিত মানুষকে শাসক শ্রেণির ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হবে।