নরেন্দ্র মোদি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে কয়লা-দুর্নীতির অভিযোগ অনেক দিনের। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ মন্ত্রকের তদন্ত সংস্থা ডিআরআই (ডায়রেক্টরেট অফ রেভেনিউ ইন্টেলিজেন্স) ২০১৪ সালে কয়লা-দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। ২০১৬ সালে তারা জানায় যে, এই দুর্নীতিতে যাদের দিকে সন্দেহের আঙুল উঠেছে, তার মধ্যে আদানিদের সংস্থা অন্যতম। সম্প্রতি লন্ডনের প্রখ্যাত সংবাদপত্র ফিনান্সিয়াল টাইমস এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য খতিয়ে দেখে কাগজের প্রথম পাতায় আবার তুলে এনেছে সেই খবর। জানিয়েছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে কম দামে নিম্ন মানের কয়লা আমদানি করে বিপুল দামে তামিলনাড়ুর সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্টন সংস্থা ‘ট্যানগেডকো’-র কাছে বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি মুনাফা লুটেছে আদানিরা। পরিণামে সরকারি রাজস্বের বিপুল ক্ষতি শুধু হয়েছে তাই নয়, চড়া দামে বিদ্যুৎ কিনে সেই দুর্নীতির বোঝা বইতে বাধ্য হতে হয়েছে দেশের খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষকে। মুনাফা লুটের লালসায় বিদ্যুৎ উৎপাদক সংস্থার কাছে ভাল কয়লার নাম করে নিচু মানের বেশি দূষণ সৃষ্টিকারী কয়লা বিক্রি করে এমনকি দেশের মানুষের শারীরিক সুস্থতাকে পর্যন্ত বলি চড়িয়েছে আদানিরা! পাশাপাশি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠে গেছে যে, কীসের বিনিময়ে তারা আদানিদের এই ভয়ঙ্কর দুর্নীতি বছরের পর বছর ধরে অবাধে চালিয়ে যেতে দিল! বিপুল পরিমাণ সরকারি রাজস্ব, যা অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো যেত, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কোন বাধ্যতায় তা আদানিকে নিজের সিন্দুকে ভরে নিতে দিল? বিনিময়ে মোদিজির দল ক’টেম্পো টাকা পেল?
সংগঠিত অপরাধ ও দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানকারী সাংবাদিকদের সংস্থা ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড কোরাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ সংক্ষেপে ওসিসিআরপি-র সংগৃহীত তথ্য, চালান ও অন্যান্য কাগজপত্র খতিয়ে দেখে ফিনান্সিয়াল টাইমস আদানির এই বিপুল লুট ও দেশের মানুষকে প্রতারণার গোটা চিত্রটি নতুন করে তুলে ধরেছে।
ফিনান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, ২০১৩-র ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়া থেকে আদানিদের কেনা কয়লা-ভরা জাহাজটি রওনা হওয়ার পর পরই বন্দর-দফতর একটি সার্টিফিকেট প্রকাশ করে। সেখানে প্রেরক ও প্রাপকের নাম হিসাবে ইন্দোনেশিয়ার সংস্থা ‘জনলিন’ ও ‘ট্যানগেডকো’-র উল্লেখ আছে। সার্টিফিকেটে প্রতি টন কয়লার দাম লেখা আছে ২৮ মার্কিন ডলার, যা নিম্ন মানের কয়লার সেই সময়কার বাজারদর। ট্যানগেডকো-র হাতে পৌঁছনোর আগে এই জাহাজের কাগজপত্র ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের একটি মধ্যস্থাতাকারী কোম্পানি সুপ্রিম ইউনিয়ন ইনভেস্টর লিমিটেডের কাছে পাঠানো হয়। উল্লেখ করা ভাল, এই ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কর-ফাঁকি দেওয়ার একটি স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত। ওই সুপ্রিম ইউনিয়ন ইনভেস্টর আবার এই একই জাহাজের জন্য সিঙ্গাপুরে আদানির কোম্পানির প্রধান দফতরের জন্য একটি চালান তৈরি করে। সেই চালানে কয়লার দাম লেখা ছিল টন পিছু ৩৩.৭৫ ডলার। মান হিসাবে উল্লেখ ছিল ‘প্রতি কিলোগ্রামে ৩৫০০ কিলোক্যালরির কম’– অর্থাৎ এই কয়লার প্রতি কিলো থেকে ৩৫০০ কিলোক্যালরির কম শক্তি উৎপন্ন হবে, যা নিম্ন মানের কয়লায় হয়ে থাকে। কিন্তু এর পরেই আদানির সংস্থা যখন ট্যানগেডকো-র উদ্দেশ্যে এই কয়লা জোগান দেওয়ার চালান তৈরি করে, দেখা যায়, সেখানে সমস্ত হিসেবই পাল্টে গেছে! ওই চালানে নিম্নমানের এই কয়লাই কোনও এক যাদুমন্ত্রে কিলো প্রতি ৬ হাজার কিলোক্যালরি শক্তি উৎপাদনকারী অত্যন্ত উন্নত মানের কয়লায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং তার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি মেট্রিক টনে ৯১.৯১ ডলার!
এইভাবে নিচু মানের কমদামি কয়লা আমদানি করে তাকে উঁচু মানের কয়লা বলে চালানো এবং চড়া দামে জোগান দিয়ে বিপুল মুনাফা লোটার ঘটনা এক-আধবার ঘটেছে এমন নয়। ওসিসিআরপি-র তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ফিনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, ২০১৪-র জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে কমপক্ষে ২২টি জাহাজে বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানি করে ট্যানগেডকো-কে বিক্রি করেছে আদানির সংস্থা এবং অন্যায় ভাবে লুটে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
গত বছর লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমস আরও একটি বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেছিল। তারা জানিয়েছিল, ২০২১ থেকে ’২৩-এর মধ্যে ভারতে আমদানি করা কয়লা বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করানোর জন্য আদানিরা কয়েকটি মধ্যস্থতাকারী সংস্থাকে ৫০০ কোটি ডলার ঘুষ দিয়েছিল। কয়লা-দুর্নীতিতে আদানির বেআইনি মুনাফার পরিমাণ যে কতখানি বিপুল, এ থেকে হয়তো তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সেই সময়ে কিছুটা শোরগোল উঠলেও তা বেশি দূর গড়ায়নি।
চড়া দাম দিয়ে নিচু মানের কয়লা কিনতে গিয়ে তামিলনাড়ূর সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদক সংস্থা ট্যানগেডকোর কত টাকা নষ্ট হয়েছে, তার হিসেব দিয়েছে সেখানকার একটি অসরকারি সংস্থা ‘আরাপ্পোর ইয়াক্কাম’। সংস্থাটির হিসাব, এই কারণে ২০১২ থেকে ২০১৬-র মধ্যে ট্যানগেডকোকে হারাতে হয়েছে মোট ৬ হাজার কোটি টাকা। এর প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ৩ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে আদানির সরবরাহ করা কয়লা কেনার কারণে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ট্যানগেডকো কর্তৃপক্ষ সম্পর্কেও। ২০১৭ সালের একটি রিপোর্টে খোদ সিএজি-ই প্রশ্ন তুলেছিল যে, বেশি দাম দিয়ে খারাপ মানের কয়লা পাওয়া সত্ত্বেও কোন যুক্তিতে তামিলনাড়ূর এই সরকারি সংস্থাটি কয়লা কেনার জন্য আদানিদের সংস্থাকে নির্বাচন করে।
বাস্তবে আদানির দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ পুঁজিবাদী ভারত রাষ্ট্রে‘স্যাঙাৎতন্ত্রে’র রমরমাকেই তুলে ধরল, যেখানে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাটাই কাজ করে চলে গুটিকয়েক একচেটিয়া পুঁজিপতির মুনাফা রক্ষার স্বার্থে। আগেই বলা হয়েছে, ডিআরআই ২০১৪ সালে কয়লা-দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। ২০১৭ সালে এ বিষয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতনামা আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ দিল্লি হাইকোর্টে যান। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে ২০১৮ সালে ডিআরআই আদালতকে জানায়, সিট গঠনের প্রয়োজন নেই। এরপর ২০১৯-এ বম্বে হাইকোর্টে আদানিরা একটি মামলায় জিতে যাওয়ার পর ওই আদালত ডিআরআই-এর ওপর আদানির কয়লা আমদানি সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ বিদেশ থেকে সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ডিআরআই এরপর তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায়। কিন্তু তার পর থেকে এখনও পর্যন্ত এই মামলার আর কোনও অগ্রগতি হয়নি।
এ কথা আজ সকলেরই জানা যে, একচেটিয়া পুঁজিপতি গৌতম আদানির প্রধান পৃষ্ঠপোষক স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কেন্দ্রে বিজেপি শাসনের গত দশ বছরে মোদিজি ও তাঁর সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আশীর্বাদ আদানি সাহেবের আকাশছোঁয়া উত্থানে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। এর আগে তিনি ছিলেন গুজরাটের একজন সাধারণ শিল্পপতি মাত্র। ফলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, কয়লা-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর দশ বছর পার হয়ে গেলেও কোন যাদুমন্ত্রে আদানি সাহেব আজও বহাল তবিয়তে তাঁর অনৈতিক কাজ-কারবার চালিয়ে যেতে পারছেন। অপরাধের শাস্তি হওয়া দূরের কথা, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা সত্তে্বও খোদ সরকারি প্রশাসন পর্যন্ত এত বড় একটা দুর্নীতির তদন্তের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না কেন, কোন শক্তি এর পিছনে কাজ করছে, সে কথাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। সম্প্রতি ২১টি আন্তর্জাতিক সংস্থা ভারতের প্রধান বিচারপতির কাছে এক চিঠিতে আদানির বিরুদ্ধে তদন্তের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। চিঠিতে তাঁরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পত্রিকা ‘দ্য ল্যান্সেট’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে যেখানে প্রতি বছর ২০ লক্ষ মানুষ দূষিত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হওয়ার কারণে প্রাণ হারান, সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আদানির আমদানি করা বিপুল দূষণ সৃষ্টিকারী নিচু মানের কয়লার ব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার।
অথচ কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকারের কোনও হেলদোল নেই। ভোটের মরশুমে বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে সরকারি এজেন্সিগুলিকে লেলিয়ে দিতে, সরকারের কোনও নীতির বিরোধিতাকে ‘দেশদ্রোহিতা’ বলে দেগে দিয়ে প্রতিবাদীদের জেলে ভরতে এই সরকারের যতখানি তৎপরতা, আদানিদের মতো একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজির মালিকদের নির্লজ্জ লুঠের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাদের ততখানিই উদাসীনতা। আসলে পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবেই নিজের সরকারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থের মোদিজিদের এই ‘জো হুজুরি’। শুধু বিজেপি সরকারের আমলেই নয়, এই লুটপাটের শুরু অনেক আগে থেকে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন পূর্বতন ইউপিএ সরকারের আমলে জিন্দাল, মিত্তালদের মতো একচেটিয়া কারবারিদের বেআইনি পথে কয়লা ব্লক বেচে দেওয়া হয়েছিল। এইসব লুটেরা কোম্পানিগুলি সেই কয়লা বিপুল দামে বাজারে বিক্রি করে দেশের মানুষের কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা লুটে নিয়েছিল। তাই নিয়ে সিবিআই তদন্তও হয়। যদিও অভিযুক্ত তৎকালীন শাসক দল কংগ্রেস ২০১৩ সালে সিবিআই-এর সেই রিপোর্ট পাল্টে দিয়েছিল।
নির্বাচনী জনসভাগুলিতে মোদিজি বলে চলেছেন, সাধারণ মানুষের উপর যারা লুটপাট চালাচ্ছে, নির্বাচিত হলে তাঁর সরকার তাদের নাকি জেলে পাঠাবে। দুর্নীতিগ্রস্তদের সম্পত্তির নাকি এক্স-রে করবেন তিনি। মানুষ অবশ্য এইসব ‘জুমলা’য় আর বিশ্বাস করেন না। গত দশ বছর ধরে আদানিদের মতো লুটেরা পুঁজিপতিদের সঙ্গে মোদিজি ও তাঁর সহচরদের গলায় গলায় বন্ধুত্ব তাঁরা দেখেছেন ও তার ফল ভোগ করে চলেছেন। কংগ্রেস হোক বা বিজেপি, ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলি সরকারে বসার সুযোগ পেলে যে পুঁজিপতি শ্রেণির তাঁবেদারিকেই পাখির চোখ করে কাজ করে, ১৯৫২ সাল থেকে একের পর এক নির্বাচিত সরকারগুলির কার্যকলাপ তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। ফলে আদানিদের মতো কর্পোরেট পুঁজিমালিকদের এই নির্মম লুঠ এবং পেটোয়া সরকারগুলির পুঁজিপতি শ্রেণির এই নির্লজ্জ পদসেবার বিরুদ্ধে সঠিক নেতৃত্বে জোট বেঁধে আন্দোলনে সামিল হওয়া ছাড়া পথ নেই সর্বস্বহারা খেটে-খাওয়া মানুষের।(তথ্যসূত্রঃ ফিনান্সিয়াল টাইমস, নিউজলন্ড্রি ও দ্য ওয়্যার, ২২ মে ‘২৪)