আমাদের দেশের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে পশ্চিমবাংলার একটা বিশিষ্ট স্থান আছে। আমরা সকলেই তার উত্তরসূরী। এ দেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন বিপ্লবী ধারার পীঠস্থান ছিল অবিভক্ত বাংলা। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট এ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় কংগ্রেসের সরকার। পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লববাদের ঐতিহ্যবাহী এই পশ্চিমবাংলা সামিল হয়েছিল প্রতিবাদে-প্রতিরোধে। গড়ে উঠেছিল ঐতিহাসিক বামপন্থী গণআন্দোলন। সাধারণ মানুষের ছিল মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ এবং লাল ঝান্ডার প্রতি তীব্র আকর্ষণ। একটার পর একটা গণআন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বাংলার বুকে। লড়াইয়ের সামনের সারিতে বুক চিতিয়ে দাঁড়াত প্রাণোচ্ছল ছাত্র-যুব সমাজ, গ্রামের কৃষক, শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক। সামিল হতেন কৃষক রমণীরাও। সেই আন্দোলনের উপর নির্বিচারে লাঠি-গুলি চালিয়ে কংগ্রেস সরকার নামিয়ে এনেছিল নির্মম পুলিশি অত্যাচার। শুধু কর্মীরা নয়, জনসাধারণও তেজ, সাহস ও আত্মত্যাগের মানসিকতা নিয়ে পুলিশের অত্যাচার সত্ত্বেও সংগ্রামে ছিল অবিচল। সে দিন তাদের রক্তে ভেসে গিয়েছিল কলকাতার রাজপথ, গ্রামাঞ্চলের মাটি। রক্তঝরা সেই আন্দোলন শাসকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কাছে তাই প্রতিবাদ মুখর কলকাতা ছিল ‘মিছিল নগরী’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’। ’৫৩ সালের ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন, ’৫৪ সালের ঐতিহাসিক শিক্ষক আন্দোলন, মেডিকেল আন্দোলন, শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও পাট্টার দাবিতে আন্দোলন, ’৫৬ সালের বঙ্গ-বিহার সংযুক্তি বিরোধী আন্দোলন, গোয়া মুক্তি আন্দোলন, ’৫৯ ও ’৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলন–সব মিলিয়ে এই পশ্চিমবাংলা পরিচিতি লাভ করেছিল বামপন্থী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে। কত ছাত্র যুবক মহিলা, কত শ্রমিক কৃষক আন্দোলনের সেই গতিধারায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে–তার ইয়ত্তা নেই। সেই সমস্ত শহিদের পরিচয় হিন্দু কিংবা মুসলমান ছিল না। তাদের একমাত্র পরিচয় ছিল, তারা বামপন্থী গণআন্দোলনের শহিদ। সেই স্মৃতি আজও অনির্বচনীয় প্রেরণায় পরিপূর্ণ। বামপন্থী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা নিজেদের গুণাবলির জন্য জনগণের কাছে শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু বেদনার হলেও এ কথা সত্য, ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের পর সিপিএম-সিপিআইয়ের মতো দলগুলি গণআন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একদিকে আপসমুখী, সুবিধাবাদী মানসিকতা সৃষ্টি করেছিল অপর দিকে অন্য দলগুলির উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল। পরিণামে সংগ্রামী বামপন্থী আন্দোলনের গৌরব ক্রমশ ক্ষুণ্ন হতে থাকে। জনগণের মধ্যে বামপন্থী দলগুলির শ্রদ্ধার আসনও নষ্ট হয়। গণআন্দোলনের পরিবর্তে যে কোনও প্রকারে সরকারি ক্ষমতা দখল করার লিপ্সায়, শক্তির আস্ফালনে বামপন্থী ঐক্যকে নষ্ট করার ফলেই বামপন্থী আন্দোলনের গৌরব মসীলিপ্ত হতে থাকে। বিস্তৃত সে ইতিহাস। এরই সুযোগ নিয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া কংগ্রেসের অভ্যুত্থান ঘটে নতুন রূপে। তৈরি হয় নব কংগ্রেস বা ইন্দিরা কংগ্রেস। সেই ইন্দিরা কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭২ সালের নির্বাচনে পুলিশ প্রশাসন আর দুষ্কৃতীদের দিয়ে ব্যালট বাক্স নদীতে ফেলে, একের পর এক বুথ দখল করে, ছাপ্পা ভোট দিয়ে নির্বাচনকে পরিপূর্ণ প্রহসনে পরিণত করে সরকারি ক্ষমতায় আসীন হয়। বামপন্থী কর্মীদের উপর নামিয়ে আনে পুলিশি নির্যাতন। পুলিশের সহযোগিতায় চালানো হয় একের পর এক হত্যাকাণ্ড। মানুষের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার পদদলিত করে ইন্দিরা কংগ্রেস জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
এরপর ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) থাকলে পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন হবে এবং সরকার অসুবিধায় পড়বে–এই অজুহাতে এস ইউ সি আই (সি)-কে বাদ দিয়ে সিপিআই(এম) তাদের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গঠন করে। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবাংলায় তারা সরকার চালায় এবং তাদের শাসনকালে একের পর এক জনবিরোধী ও অবাম নীতি গ্রহণ করার ফলে মানুষের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে ২০১৪ সালে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের পরিণতিতে নানা প্রতিশ্রুতি এবং ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন হয়। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর কলকাতায় সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রকাশ কারাটের সাথে এস ইউ সি আই (সি)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের আলোচনা হয়। তার পূর্ণ বিবরণ একটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৫ সালে দিল্লিতে ৬টি বামপন্থী দলের বৈঠকে যুক্ত কর্মসূচির বিষয়ে কথা হয়। সর্বভারতীয় স্তরে ৬ দলের একটি জোট তৈরি হয়। বেশ কয়েকটি রাজ্যে এই জোটের পক্ষ থেকে কিছু যৌথ কর্মসূচিও সংগঠিত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী দলগুলির সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী যৌথ কর্মসূচি পালিত হয় এবং তাতে আমরা আজও সামিল।
বর্তমানে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অবস্থা হল, এক দিকে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা-মন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে বন্দি। কয়লা পাচার, গরু পাচার, শিক্ষক সহ সমস্ত নিয়োগে দুর্নীতি এবং আমফানের ত্রাণের টাকা নিয়ে দুর্নীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সাধারণ মানুষের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি নির্বাচনে বাজিমাত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। অথচ এই বিজেপি একদিকে পিএম কেয়ারস ফান্ড, ব্যাপম কেলেঙ্কারি, হাজার হাজার কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড সহ অসংখ্য রকম দুর্নীতির পাঁকে পুরোপুরি ডুবে রয়েছে এবং অন্য দিকে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে আদানি-আম্বানিদের নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিয়ে, মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। নির্বাচনের আগে দেওয়া নিজেদের সকল প্রতিশ্রুতিকে জুমলা বলে উড়িয়ে দিয়ে তারা সমগ্র দেশবাসীর প্রতি প্রতারণা করেছে। বাস্তবে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে কংগ্রেসের পথে তারা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে ধর্ম-বর্ণ নিয়ে চূড়ান্ত বিভেদ সৃষ্টি করছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটাচ্ছে, বিরোধী কণ্ঠস্বর বন্ধ করতে ফ্যাসিবাদের ভিত্তি দৃঢ়তর করছে।
এই অবস্থায় জনসাধারণের সত্যিকারের বিকল্প ছিল বামপন্থী দলগুলির সংগ্রামী ঐক্যের ভিত্তিতে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন সংগঠিত করা এবং নির্বাচনে সেই গণআন্দোলনের লাইন নিয়েই অংশগ্রহণ করা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সিপিআই(এম) নেতৃত্ব তা করলেন না। বরং ২০১৫ সালে তৈরি হওয়া ৬ পার্টির বামপন্থী জোটকে আমাদের সাথে কোনও রকম আলোচনা ছাড়াই ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট একতরফা ভেঙে দিলেন। বামপন্থী জোটের পরিবর্তে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলেন। সবচেয়ে বেশি দিনের শাসনে যে কংগ্রেস অর্থনৈতিক বৈষম্যকে চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে, যাকে বিজেপি আরও ভয়াবহ করে তুলেছে– যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করেই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের গৌরবগাথা, যে কংগ্রেস জরুরি অবস্থা জারি করেছে, ভাগলপুরে দাঙ্গা ঘটিয়েছে, নেলির গণহত্যা সংঘটিত করেছে, শিখ নিধন যজ্ঞের হোতা এবং যে কংগ্রেস বাবরি মসজিদের তালা খুলে সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে ভোটের স্বার্থে উস্কে দিয়েছে– নির্বাচনে দু-একটি আসন লাভের আশায় সিপিএম সেই কংগ্রেসের সাথে জোট গঠন করে পশ্চিমবাংলার বামপন্থী ঐতিহ্যকে চূড়ান্তভাবে জনসাধারণের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। এর দ্বারা মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের মহান আদর্শ, বামপন্থা এবং লাল ঝান্ডার মর্যাদা প্রবলভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
আপনারা সকলেই জানেন, আমাদের দল এস ইউ সি আই (সি) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তার ভিত্তিতে কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন সমস্ত সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে একটার পর একটা গণআন্দোলন পরিচালনা করে চলেছে। যতদিন বামপন্থী আদর্শ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন চলেছে, যতদিন না সেই ঐক্য ভেঙে দেওয়া হয়েছে–সেই আন্দোলনে আমরা সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেছি। সাথে সাথে নির্বাচন যখন এসেছে, গণআন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গিতেই আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। এটাই যথার্থ মার্ক্সবাদী, বামপন্থী শিক্ষা।
এ বারের নির্বাচনে একক বামপন্থী দল হিসেবে গোটা দেশে ১৯টি রাজ্যে এবং ৩টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মোট ১৫১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। পশ্চিমবাংলার ৪২টি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। একক বামপন্থী দল হিসাবে এস ইউ সি আই (সি) দলই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসনে এবং সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রাজ্যে নির্বাচনী সংগ্রামে সামিল হয়েছে পশ্চিমবাংলা সহ সারা দেশে বিপ্লবী বামপন্থার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবার উদ্দেশ্যে। এ কথা ঠিক, পশ্চিমবাংলা সহ অনেক রাজ্যে এমন বহু লোকসভা কেন্দ্র আছে যেখানে বামপন্থী দল হিসাবে একমাত্র এস ইউ সি আই (সি)-ই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন পশ্চিমবাংলার সমস্ত মানুষকে অতীতের বামপন্থী আন্দোলনের গৌরবের প্রতি মর্যাদা দিয়ে বিপ্লবী বামপন্থার প্রতিনিধি হিসাবে আমাদের দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) প্রার্থীদের বিজয়ী করবেন–যাতে তারা লোকসভার অভ্যন্তরে জনসাধারণের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরতে পারে এবং বামপন্থী আন্দোলনের মর্যাদাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আজ দিন এসেছে সংগ্রামী বামপন্থার শক্তিকে আরও সংহত ও সুদৃঢ় করার। বামমনস্ক মানুষের কাছে এই আমাদের আন্তরিক আবেদন।
অভিনন্দন সহ
চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, রাজ্য সম্পাদক, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)