Breaking News

রামলালা মূর্তিতে সূর্যতিলক বিজ্ঞানের কৌশলকে অলৌকিক বলে চালানোর অপচেষ্টা বিজেপির

প্রতি বছর রামনবমীতে অস্ত্র হাতে মিছিল করা, মসজিদ বা গির্জার সামনে হল্লা করা, পাথর ছোঁড়া, অথবা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের ‘সৌজন্যে’ ইদানীং রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এইবার তার সঙ্গে যুক্ত হল নতুন চমকঃ অযোধ্যার রামমন্দিরের ‘গর্ভগৃহে’ রামলালার কপালে ‘সূর্যতিলক’ দান।

বিজ্ঞানের সরল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই কাজটি করা হয়েছে। একটি দর্পণে সৌরকিরণ প্রতিফলিত করে তাকে লেন্সের সাহায্যে সরু রশ্মিতে পরিণত করে পেরিস্কোপ সিস্টেমের সাহায্যে রামলালার বিগ্রহের কপালের মধ্যস্থানে (সঙ্গের চিত্রের ব্যবস্থানুযায়ী) ৫.৮ সেমি দৈর্ঘ্যের আলোক-রশ্মিফেলা হয়েছে। এর পরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই সূর্যতিলক একই রকম স্বর্গীয় শক্তির সঙ্গে বিকশিত ভারতের প্রতিটি সঙ্কল্পকে প্রোজ্জ্বল করবে।

প্রধানমন্ত্রী এই সূর্য তিলককে একটা স্বগ¹য় বিষয় বলছেন কীসের ভিত্তিতে? বিজ্ঞানের ন্যূনতম ধারণা যাঁদের আছে তাঁরা বুঝবেন এটি মোটেই ‘অলৌকিক’ বা ‘স্বর্গীয়’ কিছু নয়। বিজ্ঞানের বর্তমান উন্নতির যুগে যখন মহাকাশে একটি কৃত্রিম উপগ্রহকে দূর-নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তখন সূর্যের আলো দর্পণে প্রতিফলিত করে লেন্সের সাহায্যে কোনও বস্তুর উপর এনে ফেলা অতি তুচ্ছ ঘটনা। এটি উৎসাহী স্কুল ছাত্ররাও করে দেখাতে পারে। আর এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য ‘সেন্ট্রাল বিল্ডিং রিসার্চ ইন্সটিটিউট, রুরকি’ (সিবিআরআই) এবং ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ব্যাঙ্গালোর’ (আইআইএপি)-এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে। ‘সূর্যতিলক’ বরণের এই প্রকল্পে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেই বিজ্ঞানের জয়গানের পরিবর্তে অধ্যাত্মবাদের জয়গান করা হয়েছে, বিজ্ঞানকে ভাববাদের কাছে খাটো করা হয়েছে। বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে দেশের অগ্রগণ্য বিজ্ঞান সংস্থাগুলিকে যে কার্যত সরকারের ‘গোলাম’ বানিয়ে তাদের বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি খুবই উদ্বেগজনক ঘটনা।

‘সূর্যতিলক’ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সরকার যতই বড়াই করুক না কেন এই প্রকৌশল ভারতের কোনও মন্দিরে নতুন নয়। বহু শতাব্দী পূর্ব থেকেই নানা কৌশল ব্যবহার করে বিগ্রহে অথবা মন্দিরে সৌররশ্মিএনে ফেলা হয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শতকে নির্মিত তামিলনাড়ুর সূর্যনার মন্দিরে, ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত ওড়িশার কোনারক মন্দিরে, পঞ্চদশ শতকে নির্মিত অন্ধ্রপ্রদেশের নারায়ণস্বামী মন্দিরে, কিংবা সমকালীন সময়ে নির্মিত গুজরাটের কোবা জৈন মন্দিরে সৌরকিরণ বিগ্রহের মুখে বা পায়ে আপতিত করা হয়েছে। সেদিনের প্রেক্ষিতে সেটি অবশ্যই বিরাট সাফল্য ছিল। কিন্তু আজ বিদ্যালয়ের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে বা ‘প্রোজেক্ট’-এ যখন পেরিস্কোপ, সূচিছিদ্র ক্যামেরা নির্মাণ, কিংবা প্রতিফলন বা প্রতিসরণের সূত্রের ব্যবহারিক প্রমাণ শেখানো হয়, টেলিস্কোপ বা মাইক্রোস্কোপ যখন ছাত্রছাত্রীরা অনায়াসেই ব্যবহার করছে, তখন ‘সূর্যতিলক’ বরং নেহাতই ‘সামান্য ঘটনা’। কিন্তু তাকেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ‘বিরাট’, ‘অভূতপূর্ব’, ‘স্বর্গীয়’ বলে বিজেপি এবং তার অনুচর ‘গোদি মিডিয়া’ প্রচার করছে।

মানুষের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে আমাদের দেশে বাবাজি, মাতাজি, ভণ্ডদের কারবার নতুন নয়। সাঁইবাবার বিভূতি বিতরণের কৌশল ফাঁস করে দিয়েছিলেন পি সি সরকার (জুনিয়র)। হাইড্রলিক লিফটের সাহায্যে কালো চাঁদোয়াকে কাজে লাগিয়ে হরিয়ানার এক ‘গডফাদার’ স্বর্গ থেকে নামতেন। বর্তমানে তিনি নানা অপরাধে জেলবন্দি। পরশুরামের (রাজশেখর বসু) লেখায় ‘বিরিঞ্চিবাবা’ এমন বাস্তব দেখেই সৃষ্টি। একবিংশ শতকে বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির যুগেও তাদের দাপট একটুও কমেনি। জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, ‘ভৃগু’, প্রমুখদের বিজ্ঞাপন ট্রেনে-বাসে-শহরে-নগরে সর্বত্র।

ভারতের সংবিধানের ৫১(ক) ধারাকে প্রয়োগ করে এই সব ঠগবাজ, ভণ্ড, প্রতারকদের বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। কিন্তু তার পরিবর্তে সরকারি নেতারা এদের ডেরায় ছুটছেন। তাই নির্মলানন্দ থেকে আসারাম বাপু, রামপাল থেকে রামরহিম, ‘যোগগুরু’ রামদেব থেকে ফুরফুরা শরিফের ভাইজান – এঁদের রমরমা। যে দেশ বিদ্যাসাগর, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সি ভি রামনের মতো মানুষের জন্ম দিয়েছে, সেই দেশে পৃষ্ঠটানকে কাজে লাগিয়ে ‘গণেশের দুধপানের’ মতো গণপ্রতারণার ফাঁদ পাতা যায়। জবাফুলের রস ছুরিতে মাখিয়ে তা দিয়ে লেবু কেটে শত্রুর রক্ত আনার খেল দেখানো হয়। বামনহাটি গাছের টুকরো এবং ‘সিফার্স নট’ নামক বিশেষ গিঁটের যুগলবন্দিতে জন্ডিসের মালা বড় হয়। বিজ্ঞানের এই কৌশলগুলি না জানা থাকলে তাকে ‘অলৌকিক’ বলে রটানো যায় এবং গ্রহ-রত্ন, তাবিজ, মাদুলি, ‘দেবদত্ত’ অষ্টধাতুর আংটি, প্রসাদ, বিভূতি নগদ মূল্যে বিক্রি করা হয়।

অনেকদিন আগে ১৯৪৮ সালে মহান মার্ক্সবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে বিজ্ঞানেরপ্রকৌশলের-প্রযুক্তির সংমিশ্রণ হল ফ্যাসিবাদের আদর্শগত ভিত্তি। কংগ্রেস এই কাজ শুরু করেছিল। বিজেপি তাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। ভোটের বাজারে এই সব চমক দিয়েই গদি রক্ষার আশায় বিজেপি।