‘এ পার্টির মূল শক্তি সঠিক আদর্শ ও সঠিক রাস্তা’

২৪ এপ্রিল পার্টি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম স্মরণ করুন

‘‘আমরা যখন দল গঠন করি, তখন আমরা কারা? আমাদের তখন কিছুই ছিল না। আমাদের নাম করা কোনও নেতা ছিল না, টাকাপয়সা ছিল না, আমরাই একমাত্র পার্টি যার সোসাল ব্যাকিং (সামাজিক সমর্থন) বা সোসাল হাইআপ সোর্স (উঁচুতলার থেকে প্রাপ্তিযোগ) যাকে বলে তা ছিল না। একটা পয়সাওয়ালা লোক বা এ ধরনের কোনও সিমপ্যাথাইজারও (দরদি) তখন আমাদের গড়ে ওঠেনি। পাঁচ-দশটা লোক যারা পার্টিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে পারে এরকম কাউকে তখন আমরা পাইনি। অত্যন্ত কমন ম্যান এবং সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে আর মজুর চাষি ঘরের ছেলেপুলে, বা ওরই মধ্যে কেউ একটু চাকরি করে মোটামুটি জীবনযাপন করে– এই হচ্ছে তখন আমাদের পার্টির কর্মীদের, এমনকি সাপোর্টারদের ক্যাটিগরি (অবস্থা)। এই নিয়ে আমাদের পার্টির কাজকর্ম শুরু। তখন দিন আনা দিন খাওয়ার মতো অবস্থা আমাদের। ফলে একদম শুরু থেকে আমাদের কর্মীরা– এমনকি এমএ, বিএ পাশ করা গুটিকয়েক শিক্ষিত কর্মী, শিক্ষক, অধ্যাপক– যাঁরা তখন পার্টির আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে এসেছিল, এমন সব কর্মীদেরও রাস্তায় বা’ নিয়ে সারাদিন ঘুরে মুখে রক্ত তুলে পাবলিকের থেকে অর্থসংগ্রহ করে আমাদের খরচ চালাতে হয়েছে। সকল রাজনৈতিক দল আমাদের কোণঠাসা করতে চেয়েছে। ঠাট্টা টিটকারি করে বলত, চামচিকাও পাখি আর এস ইউ সি-ও পার্টি। কাজেই আমাদের সাথে আবার কথাবার্তা বলার কী আছে? তারা ইউনাইটেড ফ্রন্টেও আমাদের রাখতে চায়নি। আজ যদি দলের মধ্যে কিছু নেতা সৃষ্টি হয়ে থাকে, যদি নাম কিছু হয়ে থাকে, কিছু ইজ্জত হয়ে থাকে, তবে সেটা বুর্জোয়া প্রেস তৈরি করে দেয়নি। বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে জনতার আন্দোলন, কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম, দেশে কিছু ভাবগত আন্দোলন এবং সংগ্রামের কন্ট্রিবিউশনের মারফত তা সৃষ্টি হয়েছে। বুর্জোয়ারা তা করে দেয়নি, প্রেস তা করে দেয়নি। কোনও প্ল্যাটফর্ম কেউ দেয়নি। যেমন করে অন্য সব ছোট পার্টিগুলো ঐ সিপিআই, না হয় সিপিএম-এর লেজুড়বৃত্তি করে, না হয় ওদের তোষামোদি করে এই প্ল্যাটফর্ম, সেই প্ল্যাটফর্ম থেকে নেতা হচ্ছে– এ দলের কোনও নেতা তেমন করে সৃষ্টি হয়নি। তাদের দয়াদাক্ষিণ্যে এ দলে কেউ নেতা হয়নি। এই দলের কর্মীরা এক সঙ্গে লড়াই করেছে কিন্তু তোষামোদ করেনি, তাদের দাসত্ব স্বীকার করেনি বলেই সকল দলেরই ক্ষোভ। তাদের ভাবখানা ছিল, ছোট একটা পার্টি তার এত তেজ! তা সত্ত্বেও যদি কিছু নেতা সৃষ্টি হয়ে থাকে এ দলে, সেটা হয়েছে নিজেদের কর্মপ্রচেষ্টায় এবং রক্ত ঢেলে।

স্বাধীনতার পরে একদিকে কংগ্রেস, আর একদিকে কমিউনিস্ট পার্টি। তা ছাড়া সোসালিস্ট পার্টি, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক– সেগুলোও তখন অনেক বড় পার্টি। অত বড় সোসালিস্ট পার্টি ভাঙতে শুরু করল। কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙতে ভাঙতে আজ তিন টুকরো। আবার তারাও আরও টুকরো হতে যাচ্ছে। সোসালিস্ট পার্টি ছাড়াও আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক এইসব পার্টিগুলো ভাঙতে ভাঙতে ক্ষয় হতে হতে এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। আর সেই সময়ে আমাদের পার্টি কয়েকটা হাতে গোনা আনকোরা কর্মী নিয়ে একটা পার্টি গঠন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সে সময় আমাদের তো ঝড়ে উড়ে যাওয়ার কথা ছিল। যার আন্তর্জাতিক ব্যাকিং নেই, বরং যারা প্রকৃত কমিউনিস্ট নয় বলে আলাদা দল গড়ে তুলছি, তারা সেই ব্যাকিং পাচ্ছে। অন্য দিকে অভিজ্ঞ কর্মী নেই, নামকরা সর্বভারতীয় নেতা নেই, প্রেস পাবলিসিটি নেই, সমস্ত দলের সম্মিলিত আক্রোশ এবং বিরুদ্ধতা– তার মধ্যে ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করে আজ এই জায়গায় এসে এই পার্টিটা দাঁড়িয়েছে। এ কি সোজা শক্তি? এ শক্তি কিসের শক্তি? এ আসতে পেরেছে এই কারণে যে, এর আদর্শ এবং রাস্তা সঠিক ছিল। এর কি কোনও ভুলভ্রান্তি নেই, এর সবই কি ঠিক, এর প্রতিটি নেতা কি সবসময় সঠিক আচরণ করেন, প্রতিটি কর্মী কি সবসময় সঠিক আচরণ করে? না, এ সব দাবি আমরা করতে পারি না, আমরা এ সবের বিরুদ্ধে সজাগ এবং এগুলো দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাই। তবে এ কথাটা খেয়াল রাখবেন, এই সব কথার দ্বারা মূল কথাটা আপনাদের যেন গোলমাল না হয়। মূল কথাটা হল– সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ পরিবেশে, প্রবল অ্যান্টি কারেন্টের বিরুদ্ধে কী সেই প্রবল শক্তি যার ওপর ভিত্তি করে পার্টিটা আজ এই জায়গায় এসেছে। সে শক্তিটা হল, এই পার্টিটা একটা মূল আধারের উপর, সঠিক আদর্শ আর কতকগুলো দৃঢ়চেতা কর্মী, যাদের বিপ্লবী চরিত্রের একটা মান আছে, যে কোনও অবস্থাতে সে ফাইট করে, তারা মাথা নিচু করে না, কুসংস্কার মুক্ত, আর যে-কোনও অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য সব সময় তৈরি হয়ে আছে।

… মানুষের সামনে এই সত্যটা সঠিকভাবে উপস্থাপনা কর– একদিকে যত বড় বড় পার্টি, সব ক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে, আর সেখানে এই একটি মাত্র পার্টি স্লোলি বাট স্টেডিলি (ধীরে কিন্তু দৃঢ়ভাবে) ইনস্পাইট অফ মেনি ডিফিকাল্টিজ গ্রোইং। ট্রাই টু লার্ন ফ্রম ইট– তবে তুমি বুঝতে পারবে এই আদর্শের সঠিকতা কতখানি দৃঢ় ভিত্তিমূলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এ পয়সা দিয়ে তৈরি করা পার্টি নয়, এ কতকগুলো নেতার মিথ্যা মোহ সৃষ্টি করা পার্টি নয়, এ পার্টি নেতা-কর্মীদের বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে। ফলে এর শক্তি যদি দেখতে না পাও এবং দেশের মানুষ যদি দেখতে না শেখে, আমি বলব ঠকবে তারাই।’’

বিপ্লবী জীবনই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাময়

শিবদাস ঘোষ