দলের পলিটবুরো সদস্য ও কেরালা রাজ্য কমিটির পূর্বতন সম্পাদক কমরেড ভি ভেনুগোপাল স্মরণে সভা অনুষ্ঠিত হয় ১২ এপ্রিল কলকাতার মৌলালি যুবকেন্দ্র অডিটোরিয়ামে। সভাপতিত্ব করেন দলের প্রবীণ পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য। প্রধান বক্তা ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, কেরালা রাজ্য সম্পাদক কমরেড জয়সন জোসেফ। কমরেড ভেনুগোপালের সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রদ্ধার্ঘ্য পাঠ করেন পলিটবুরো সদস্য কমরেড অমিতাভ চ্যাটার্জী। অনুষ্ঠানটি সারা দেশে অনলাইনে সম্প্রচারিত হয়। শ্রদ্ধার্ঘ্যটি প্রকাশ করা হল।
এস ইউ সি আই (সি)-র পলিটবুরো সদস্য এবং কেরালা রাজ্য কমিটির পূর্বতন সম্পাদক কমরেড ভি ভেনুগোপাল ৩০ মার্চ রাত্রি সাড়ে ন’টায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। বিগত ৯ বছর ধরে তিনি পার্কিনসনস রোগে ভুগছিলেন। শেষ দুই বছর নয় মাস তিনি আম্বালাপুঝার সূর্য হাসপাতালে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলেন। সেই সময় চিকিৎসক-পার্টিকর্মীদের একটি টিম সর্বক্ষণ তাঁর দেখাশোনা করেছেন। রোগের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর তাঁকে আমরা হারালাম।
১৯৭৫ সালে তিরুবনন্তপুরমের গভর্নমেন্ট মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় কমরেড ভি ভেনুগোপাল এ যুগের অগ্রগণ্য মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক এবং এস ইউ সি আই (সি)-র প্রতিষ্ঠাতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন। খুব অল্প দিনের মধ্যেই তিনি দলের সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে ওঠেন। তখন থেকে একেবারে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগের মুহূর্তটি পর্যন্ত বিপ্লবী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য দায়িত্ব পালনে অটল থেকেছেন। দল গড়ে তোলার দিনগুলিতে যাঁরা এর সাথে যুক্ত হয়েছেন তাঁদের যে ধরনের তীব্র সংকট, অর্থাভাব এবং সর্বদিক থেকে প্রবল প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা যে কোনও মানুষকেই লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে। কিন্তু তাঁর চরিত্রের গঠন ছিল বিরল ধাঁচের।
কমরেড ভেনুগোপালের জন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবা, মা দুজনেই ছিলেন স্কুল-শিক্ষক। সচ্ছল পরিবার থেকে এলেও পার্টি জীবনের প্রতিকূলতা, এমনকি অনাহারও তাঁকে হতোদ্যম করতে পারেনি।
কেরালায় সংগঠন গড়ে ওঠার প্রথম দিকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্বতন সদস্য কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তীকে পাঠানো হয় সংগঠন বিস্তারে সাহায্য করার জন্য। তিনি এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেদিন কেরালার মাটিতে যাঁরা পার্টি গঠনের কাজে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কিছুজন কষ্টসাধ্য বিপ্লবী জীবনসংগ্রাম পরিচালিত করতে না পেরে পিছিয়ে গেছেন। কিন্তু প্রয়াত কমরেড সি কে লুকোস, কমরেড এ জালালুদ্দিন, কমরেড জি এস পদ্মকুমার সহ অন্যান্যদের সাথে মিলে কমরেড ভেনুগোপাল দলের পতাকাকে দৃঢ়মুষ্টিতে উর্ধ্বে তুলে রেখেছেন। জরুরি অবস্থার সময় পুলিশ তাঁকে দু’বার গ্রেফতার করে হেফাজতে রাখে। ছাত্র-নেতা হিসাবে তিনি বারবার সিপিএম-আশ্রিত গুণ্ডাদের হতে আক্রান্ত হলেও কেরালায় এআইডিএসও-কে দৃঢ়তার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এআইডিএসও-র কেরালা রাজ্য সম্পাদক এবং রাজ্য সভাপতি হিসাবে তিনি দীর্ঘদিন নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেছেন।
১৯৮৩-তে তিনি মেডিকেল ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু সচ্ছল জীবনের হাতছানিকে তিনি আনন্দ ও পরিপূর্ণ তৃপ্তির সঙ্গে উপেক্ষা করেছিলেন। এ জন্য কোনও ত্যাগ-মাহাত্মে্যর ভাব তাঁর ছিল না। বিপ্লবী জীবনই হল সর্বাপেক্ষা মর্যাদাময় জীবন, কমরেড শিবদাস ঘোষের এই শিক্ষাকে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর অতি প্রিয় বাবা-মা, শিক্ষক এবং সহপাঠীদের কাছে তুলে ধরেছেন। যে কারণে কমরেড ভেনুগোপালের অসুস্থতার খবর পেয়েই তাঁর সহপাঠী ও শিক্ষকরা কারও কোনও অনুরোধ ছাড়াই নিজেদের উদ্যোগে বিরাটপরিমাণ আর্থিক সাহায্য সংগ্রহ করে অশ্রুসজল চোখে দলের হাতে তুলে দেন। অন্যদের ওপর কমরেড ভেনুগোপালের বিপ্লবী জীবনের গভীর প্রভাবের সাক্ষ্য বহনকারী এমন অনেক ঘটনা আছে।
তাঁর জীবন ছিল পার্টি ও বিপ্লবের স্বার্থে পুরোপুরি নিবেদিত। ব্যক্তিগত স্বার্থকে শ্রেণি, দল ও বিপ্লবের স্বার্থের সাথে বিলীন করে দেওয়ার মতো উন্নত চরিত্রের স্তর অর্জন করতে গেলে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে যে কঠোর সংগ্রাম প্রয়োজন কমরেড ভেনুগোপাল সেই সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সেই স্তর অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং দল তাঁকে ‘স্টাফ সদস্যপদ’ প্রদান করে। ‘আমি’ শব্দটা তাঁর মনোজগতে অনুপস্থিত ছিল, তাই কেউ তাঁকে এই শব্দটা ব্যবহার করতে কখনও শোনেনি। নিজেকে ব্যক্তিবাদ থেকে মুক্ত রাখার যে সচেতন সংগ্রামে তিনি লিপ্ত ছিলেন এ ছিল তারই প্রতিফলন।
কেরালা রাজ্য জুড়ে দলের সংগঠন বিস্তারে কমরেড ভেনুগোপাল সর্বদাই কমরেড সি কে লুকোসের পাশে ছিলেন। কর্মীদের গড়ে তোলা এবং বহু মানুষকে দলের সাথে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রাজ্যে কিশোর কমিউনিস্ট বাহিনী কমসোমল গড়ে তোলার কাজেও তিনি যোগ্যতার পরিচয় দেন। কেরালা রাজ্য কমিটির মালয়ালম ভাষায় প্রকাশিত মুখপত্র ‘ইউনিটি’-র সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসাবে দীর্ঘ চার দশক এবং প্রধান সম্পাদক হিসাবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৯৫-তে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব যুব সম্মেলনে’ তিনি এআইডিওয়াইও-র প্রতিনিধিত্ব করেন।
জনগণের আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে কমরেড ভেনুগোপালের দক্ষতা ছিল অসাধারণ। ২০০২-তে ত্রিকুন্নাপুঝা ও আলাপ্পুঝায় কালো বালি উত্তোলন (ব্ল্যাক স্যান্ড মাইনিং) বিরোধী আন্দোলন, ছাড়াও চেঙ্গারার জমি আন্দোলন, ভিলাপ্পিসালায় বর্জ্য ফেলার জমি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, মুলামপিল্লিতে এবং অন্যত্র হাইওয়ে নির্মাণের অজুহাতে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উচ্ছেদ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন, আলাপ্পুঝা উপকূলে চিংড়ির খোলা ছাড়ানোর শ্রমিকদের নিয়ে ‘কেএমএসটিইউ’ (কেরালা মালসিয়া সংস্করণ থোজিয়ালি ইউনিয়ন)-এর আন্দোলন ইত্যাদি নানা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন।
তিনি ছিলেন ‘কেরালা জনকিয়া প্রতিরোধ সমিতি’-র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। কেরালার নিপীড়িত জনসাধারণের বহু ধরনের দাবি নিয়ে এই সমিতি সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আইয়ার, লক্ষ্মী এন মেনন, ডাঃ এন এ করিম সহ রাজ্যের বহু বিশিষ্ট মানুষ এই আন্দোলনে যুক্ত হন। এই সমিতির গড়ে তোলা শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নেন। পরবর্তীকালে সরকার গঠিত পাঠক্রম সংস্কার কমিটিতে তিনি সদস্য নির্বাচিত হন। আম্বালাপুঝায় সূর্য হাসপাতালের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। বিগত চল্লিশ বছর ধরে এলাকার দরিদ্র মৎস্যজীবী মানুষ ও কৃষি শ্রমিকদের কম খরচে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার কাজ করে চলেছে এই হাসপাতাল।
গুরুতর রোগের সঙ্গে লড়াই করার সময়েও তাঁর মন ভরে থাকত দলের অগ্রগতি সংক্রান্ত চিন্তায়। কমরেড ভেনুগোপালের মতো আমৃত্যু বিপ্লবীকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য প্রয়োজন তাঁর বিপ্লবী জীবনসংগ্রাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং যে বিপ্লবী সংগ্রামের পদ্ধতি তাঁকে এই পর্যায়ের নেতায় উন্নীত করেছিল, তার অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করা।
কমরেড ভি ভেনুগোপাল লাল সেলাম