Breaking News

গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ছাত্রদের উপর আক্রমণ বিদ্বেষের রাজনীতিরই ফল

এতদিন পর্যন্ত যে আক্রমণ দেশীয় নাগরিকদের উপরেই সীমাবদ্ধ ছিল, এ বার তার শিকার হলেন বিদেশি তথা অতিথি নাগরিকরাও। ঘটনাটি গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের। সম্প্রতি কিছু সংখ্যক বিদেশি ছাত্র যখন সেখানে রমজান উপলক্ষে নমাজ পড়ছিলেন, একদল হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতী– কেন তাঁরা ছাত্রাবাসের মধ্যে নমাজ পড়ছেন, এই প্রশ্ন তুলে তাঁদের আক্রমণ করে, ঘরে ভাঙচুর চালায় এবং ল্যাপটপ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নষ্ট করে দেয়। দুষ্কৃতীরা তাঁদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করে। আহত তিন ছাত্রকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।

এই ছাত্ররা শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, তাজাকিস্তান ও আফ্রিকা থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে নানা মহল থেকে প্রতিবাদ আসে। প্রশাসন নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। সংশ্লিষ্ট বিদেশি দূতাবাসগুলি থেকে ছাত্রদের উপর এই হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এই চাপের মধ্যে পুলিশ অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজন দুষ্কৃতীকে আটক করে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, বিদেশি ছাত্রদের উপর দুষ্কৃতীরা এই আক্রমণ চালাতে সাহস পেল কী করে? এর উত্তরটি বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সাফাইয়ের মধ্যেই রয়েছে। তিনি বলেছেন, শুধু নমাজ বিদেশি ছাত্রদের উপর হামলার কারণ হতে পারে না। স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে ছাত্রদের অজ্ঞানতা, ছাত্রদের আমিষ খাওয়া ও উচ্ছিষ্ট ফেলে রাখা, এই সবই হামলাকারীদের উস্কে থাকবে। বিদেশি ছাত্রদের স্থানীয় সংস্কৃতির স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে শেখানোর প্রয়োজন আছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, দুষ্কৃতীরা ইতিমধ্যেই উপাচার্যকে তাঁদের অপছন্দ সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন এবং উপাচার্য নিজেও দুষ্কৃতীদের সঙ্গে সহমত। সব মিলিয়ে এই আক্রমণ পূর্ব পরিকল্পিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

গণতান্ত্রিক একটি দেশে ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের অধিকার সকলেরই রয়েছে।ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মাচরণ সমর্থনযোগ্য না হলেও ভারতের রাষ্ট্র পরিচালকরা সেই নীতিকে কখনওই গ্রাহ্যের মধ্যে আনেননি। ফলে সরকারি দফতর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলিতেও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান যথেষ্ট সংখ্যায় চোখে পড়ে। কিন্তু বিষয়টি তো তা নয়, দুষ্কৃতীরা তো এই দাবি নিয়ে সেদিন উপস্থিত হননি যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় আচরণ চলবে না, তাঁরা একটি বিশেষ ধর্মাচরণেরই বিরোধিতা করেছিল। না হলে জোর করে সেই ছাত্রদের ‘জয় শ্রীরাম’ তারা বলতে বাধ্য করত না। কর্তৃপক্ষ বিদেশি ছাত্রদের আলাদা ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা করবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু যে মানসিকতা থেকে দুষ্কৃতীরা এই আক্রমণ চালাল তার পরিবর্তন হবে কী করে? তা যদি না হয় তবে এমন আক্রমণ ভবিষ্যতে আবারও ঘটবে।

বাস্তবে এই দুষ্কৃতীদের পিছনে প্রশাসনের সমর্থন থাকায় এবং সংখ্যালঘু ও তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের উপর নানা অছিলায় আক্রমণ চালাতে চালাতে তাদের দুঃসাহস এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, আজ তারা বিদেশি ছাত্রদের আক্রমণ করতেও দ্বিধা করল না। এদের অন্ধতা, অজ্ঞানতা এতই গভীর যে এই আক্রমণের ফলাফল বোঝার ক্ষমতাও তাদের নেই। এর দ্বারা বিশ্ব জুড়ে যে ভারত নামক দেশটির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এবং এক ধর্মান্ধ, পশ্চাৎপদ চিন্তার দেশ বলে পরিচিতি বাড়ে, তা বোঝার মতো শিক্ষাও তাদের নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্ণধার সম্পর্কেও যদি একই কথা বলতে হয়, তা হলে তা অত্যন্ত লজ্জার। প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ভারতের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায়ই ‘বসুধৈব কুটম্বকম’ (গোটা পৃথিবীই আত্মীয়) কথাটির উল্লেখ করেন। অথচ দেশের মধ্যে বিদ্বেষের শিক্ষাই তাঁর দল অনুগামীদের প্রতিনিয়ত দিয়ে চলেছে। তারই ফল বিদেশি ছাত্রদের উপর এই আক্রমণ। এই ছাত্ররা এ দেশে কোনও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন–রীতিমতো দেশগুলির সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুসারেই তাঁরা এ দেশে পড়তে এসেছেন, ঠিক যেমন এ দেশের বহু ছাত্রছাত্রীই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যান। সেই দেশগুলির কোথাও যখন আমরা ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের ধর্ম বা জাতি বিদ্বেষের শিকার হতে শুনি তখন আমাদের মধ্যে তা গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। ঠিক তেমনই এই আক্রমণের ঘটনা সংশ্লিষ্ট দেশগুলির নাগরিকদের মধ্যেও একই রকম উদ্বেগের জন্ম দেবে। সেই অর্থে এই আক্রমণের দায় শেষ পর্যন্ত সরকারেরই।

ইতিমধ্যেই দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে বিদেশি ছাত্ররা রয়েছেন এই আক্রমণ তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে দিয়েছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, দেশের ঐতিহ্য, বৈচিত্র্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আজ শাসক বিজেপির হাতে বিপন্ন। একে রক্ষা করতে পারে একমাত্র জাতিধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের ঐক্য, মানবিক সম্পর্কের বাঁধন।