সম্প্রতি জাম্বিয়ার চিঙ্গোলাতে এক খোলা-মুখ তামা-খনিতে কাজ করার সময় প্রবল বৃষ্টি এবং ধসে মারা গেছেন ৭ জন শ্রমিক, নিখোঁজ আরও ২০ জন। আশঙ্কা, নিখোঁজ শ্রমিকরাও মারা গেছেন। কার্যত প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ছাড়াই শ্রমিকদের কাজে নামতে হয়েছিল বলে জানা গেছে।
আফ্রিকার দক্ষিণে ছোট দেশ জাম্বিয়াতে মাত্র ২০ কোটি মানুষের বাস। বিশ্বের মানচিত্রে দেশটি এক ক্ষুদ্র জায়গা নিয়ে রয়েছে। তা সত্ত্বেও এই দেশ বড় বড় পুঁজিপতি এবং সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে অত্যন্ত লোভনীয়। কারণ, বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তামা উৎপাদনকারী দেশ জাম্বিয়া। বিশ্বের ৬ শতাংশ তামার উৎসস্থল এটি। ২০২২-এ বিশ্বে অষ্টম তামা-উৎপাদনকারী দেশ ছিল জাম্বিয়া। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তামা উৎপাদক কোম্পানিটি রয়েছে জাম্বিয়াতে। আরও বহু কোম্পানি রয়েছে সেখানে। ভারত, কানাডা ও চিনের বহুজাতিক কোম্পানিগুলির অংশীদারিত্ব বেশ ভাল পরিমাণ রয়েছে সেখানে। জাম্বিয়ায় তামা উৎপাদনে তালিকার শীর্ষে রয়েছে চিনের সিএনএমসি কোম্পানি।
খনিজ তামার সম্ভারে সমৃদ্ধ দেশ জাম্বিয়া। অথচ সেখানে অন্য শিল্প-কারখানা খুবই কম। দারিদ্র, অনাহার, বেকারি অত্যন্ত বেশি। অভাবের তাড়নায় ছাত্রদের স্কুলছুট স্বাভাবিক ঘটনা। শিশুমৃত্যু দেশের প্রধান সমস্যা। শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্র ধুঁকছে, ড্রাগে আসক্ত যুবসমাজ। ফলে যে কোনও মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া সহজলভ্য। সে জন্য, এই তামার গায়ে লেগে আছে শ্রমিকের তাজা রক্ত। বর্তমানে বহু ক্ষেত্রে তামার ব্যবহার বাড়ছে ব্যাপক হারে। নির্মাণ শিল্প, ভোগ্যদ্রব্য, পরিবহন এবং শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্রে তামা ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও সোলার প্যানেল, বিদ্যুৎ চালিত গাড়িতে তামা ব্যবহৃত হয়, যেগুলি বর্তমানে বহুল প্রচলিত। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারতে তামা ব্যবহারের প্রয়োজন বেড়েছে ১৬ শতাংশ, ক্লিন এনার্জিতে বেড়েছে ৩২ শতাংশ। ওই সময়ে তামা উৎপাদনের মূল উপাদান কপার ক্যাথোডের আমদানি বেড়েছে ১৮০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারের খনিমন্ত্রক সম্প্রতি তামা-সমৃদ্ধ জাম্বিয়াতে ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশে এক প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতীয় বহুজাতিক কোম্পানি অনিল আগরওয়ালের বেদান্ত গোষ্ঠী তার সহায়ক গোষ্ঠী হিন্দুস্তান জিঙ্ক ও ওলা ইলেকট্রিকের সাথে যৌথভাবে জাম্বিয়াতে নতুন করে খননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উল্লেখ্য, বেদান্তের ব্যবসায় কেন্দ্রীয় সরকারেরও কিছু অংশীদারিত্ব রয়েছে এবং আদানির মতো বেদান্তের ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে ওঠার পেছনে মোদি সরকারের আর্শীবাদ রয়েছে। এ হেন বেদান্ত গোষ্ঠী কবজা করেছে জাম্বিয়ার কঙ্কোলা কপার খনি। জাম্বিয়ার তামার খনিতে চিনের সিএনএমসি এবং কানাডার ফার্স্ট কোয়ান্টাম মিনারেলস কোম্পানির বিপুল বিনিয়োগের সাথে পাল্লা দিয়ে ২০২৩-এ ভারতীয় বেদান্ত গোষ্ঠী ১.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
কোম্পানিগুলির এত বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও শ্রমিক নিরাপত্তার বেহাল অবস্থা কেন? কারণ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির নিয়মেই একদিকে উৎপাদনের কারিগর শ্রমিকের শ্রমকে সম্পূর্ণ শুষে নিয়ে, তার প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে, অন্যদিকে সরকারকে নামমাত্র রয়ালটি দিয়ে তামা তুলে দেশীয় ও বিশ্ববাজারে বিক্রি করে মুনাফার পাহাড় বানায় মালিকরা। পুঁজিমালিকদের স্বার্থ আর শ্রমিকদের স্বার্থ তাই সম্পূর্ণ বিপরীত। ফলে শ্রমিক-উন্নয়ন নিয়ে মাথাব্যথা নেই পুঁজিপতি শ্রেণির। সেজন্য বিশ্বের প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশেই শ্রমিকদের একই অবস্থা—সে ভারতই হোক বা জাম্বিয়া।
লুটেরা সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে শ্রমিকদের প্রাপ্য এবং কাজের নিরাপত্তা আদায় করতে দরকার শ্রমিক আন্দোলনের জোয়ার। আন্দোলনের চাপে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কোম্পানিগুলিকে বাধ্য করা। বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিকরা পথে নেমে বুর্জোয়া সরকারগুলির মালিকতোষণ নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। কিন্তু সঠিক তথা বিপ্লবী নেতৃত্ব ছাড়া সেই বিক্ষোভ বারেবারেই দিগভ্রষ্ট হবে। জাম্বিয়ার তামা-খনি শ্রমিকদেরও পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে যেমন ঐক্যবদ্ধ ভাবে আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে, তেমনই তাতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিপ্লবী নেতৃত্ব।