নির্বাচনের দামামা বেজে উঠতেই দেশের নির্বাচনসর্বস্ব জাতীয়-আঞ্চলিক সংসদীয় দলগুলো ভোটে কীভাবে জিতে ক্ষমতায় আসীন হতে পারে, সমস্ত নীতি বিসর্জন দিয়ে হলেও কার সঙ্গে জোট করলে দুটো আসন জুটতে পারে বা বাড়তে পারে সেই অঙ্ক কষতে শুরু করে দিয়েছে। দল বদলের হীনতম খেলাও শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রচারমাধ্যমও জনসাধারণকে সেই চক্রে মাতিয়ে রাখতে চাইছে।
কিন্তু লোকসভা বা বিধানসভায় জয়ী বা বিরোধী দলের সদস্যদের দেশের হতদরিদ্র মানুষের দাবি কখনও তুলে ধরতে দেখা যায় না। তাই প্রশ্ন হল, নির্বাচনে হারজিতের সাথে সাধারণ মানুষের স্বার্থের কোনও সম্পর্ক আছে কি? স্বাধীনতার পর ৭৭টা বছর কেটে গেল। কেন্দ্রের গত দশ বছরের বিজেপির শাসন, তার আগে দীর্ঘ দিনের কংগ্রেসী শাসন আর এ রাজ্যে কংগ্রেসের পর বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ১৩ বছরের শাসন কী দিয়েছে জনসাধারণকে? আজও দারিদ্র, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, অর্ধাহার, অনাহার, অপুষ্টির চাপে জনজীবন ক্রমাগত দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। মদের প্রসার বাড়ছে, নারী নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা। ধর্ম-বর্ণ নিয়ে রক্ত ঝরছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা, খনিজ সম্পদ সহ জনগণের টাকায় তৈরি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি জলের দরে আদানি-আম্বানি সহ পুঁজিপতিদের বিপুল মুনাফার স্বার্থে তাদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। সংসদে অগণতান্ত্রিকভাবে একের পর এক জনবিরোধী আইন পাশ করানো হচ্ছে। সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসী মানুষের উপর চলছে লাগাতার আক্রমণ। জল-জঙ্গলের চিরাচরিত অধিকার থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
এই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যাতে রুখে দাঁড়াতে না পারে সেই জন্য ধর্মীয় অন্ধতায় গোটা দেশকে নিমজ্জিত রাখতে বারবার ধর্ম, বর্ণ, জাতপাতের বিভেদকে উসকে দিচ্ছে আরএসএস-বিজেপি। রামমন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে গোটা দেশকে ধর্মীয় উন্মাদনায় মাতিয়ে তুলতে চাইছে। শুরু করেছে জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে শোরগোল। অপরদিকে শিক্ষার মর্মবস্তু ও যুক্তিবাদকে ধ্বংস করতে এবং গোটা শিক্ষাব্যবস্থার সর্বাঙ্গীন বেসরকারিকরণ করতে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ প্রণয়ন করেছে তারা।
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও একই পথের পথিক। পূর্বতন সিপিএম সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারাও এ রাজ্যে পুঁজিপতিদের তোষণ করে চলেছে। কেন্দ্রের এবং অন্যান্য রাজ্যের ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের মতো এ রাজ্যের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। মুখে কেন্দ্রের বিরোধিতা করলেও তারা একইভাবে বাস্তবে কেন্দে্রর নীতিগুলিকেই কার্যকর করে চলেছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাদের পরিচালনাধীন এজেন্সি দিয়ে তদন্ত করানোয় চূড়ান্ত দুর্নীতিতে অভিযুক্ত তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরা অনেকেই জেলে বন্দি। যদিও কেন্দ্রের বা বিজেপি শাসিত রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে এইসব এজেন্সিকে কাজে লাগাচ্ছে না বিজেপি সরকার। এ রাজ্যে রেশন, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ, চিটফান্ড, কয়লা পাচার, গরু পাচার সহ একের পর এক দুর্নীতি প্রতিদিন সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে। গোটা রাজ্য জুড়ে চলছে সিন্ডিকেট রাজ, কাটমানির খেলা। জনগণকে দমিয়ে রাখতে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে তারা সন্ত্রাসের ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের দুটি সরকারই পুঁজিবাদের স্বার্থকে রক্ষা করে চলেছে। কারণ পুঁজিপতিরাই তাদের ফান্ডে অজস্র টাকা ঢালে নিজেদের স্বার্থরক্ষার শর্ত হিসাবে।
এই অবস্থায় সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে, পুঁজিপতিদের টাকায় চলা এই দলগুলো তাদের ভাষণে যতই পরস্পর বিরোধিতার ভান করুক, আসলে সকলেই একই পথের পথিক। যতদিন এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হবে ততদিন জনগণের দুরবস্থার কোনও মৌলিক পরিবর্তন হবে না। তাই সাধারণ মানুষকে দলমত নির্বিশেষে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে দাবি আদায়ের লড়াইয়ে নামতে হবে। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এটাই মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের শিক্ষা। একদিন বামপন্থী আন্দোলনের ঐতিহ্যমণ্ডিত এই বাংলায় বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনের মধ্যে সংগ্রামী বামপন্থার নীতি না থাকার ফলে তারা গণআন্দোলনের পথকে পরিত্যাগ করেছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে কিছু আসনের আশায় সংগ্রামী বামপন্থার পথ থেকে সরে গিয়েছে। এটা দুঃখের এবং বেদনার। বাম মনোভাবাপন্ন সকল মানুষকে গভীর ভাবে এটা ভেবে দেখতে হবে।
এই লক্ষ্য থেকেই এসইউসিআই(সি) কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে লাগাতার দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলন গড়ে তুলেছে। এ পথেই বহু দাবি আদায় হয়েছে। সেই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও তীব্র করে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে ১৩ দফা দাবির ভিত্তিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহের ডাক দিয়েছে এস ইউ সি আই (সি)। দলের পক্ষ থেকে আগামী ৬ মার্চ রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভের আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই দিন রাজ্যের সর্বত্র জেলাস্তরে বা মহকুমা এবং ব্লকস্তরে প্রশাসনিক দপ্তরে বিক্ষোভ হবে।