Breaking News

নেতাজির চিন্তাই নাকি সংঘের চিন্তা! চরম মিথ্যাচার বিজেপি-আরএসএসের

 

ফাইল চিত্র

নেতাজি জয়ন্তী উপলক্ষে এ বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত যে ভাবে নেতাজি-বন্দনায় মেতে উঠেছিলেন, তা দেখলে হঠাৎ যে-কারও মনে হতে পারে, এঁরা বোধহয় নেতাজির আদর্শের প্রতি একান্ত অনুগত এবং নেতাজির অপূরিত কাজকে সম্পূর্ণ করাই তাঁদের লক্ষ্য।

সত্যিই কি তাই? প্রথমে দেখে নেওয়া যাক তাঁরা কী বলেছেন। ২৩ জানুয়ারি দিল্লিতে সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর সরকার নেতাজিকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার জন্য সব রকম পদক্ষেপ করেছে। ভাগবত সে দিন কলকাতার এক সভায় বলেছেন, সুভাষচন্দে্রর চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্ঘের চিন্তাধারার কোনও পার্থক্য নেই। সঙ্ঘ নেতাজির প্রেরণায় কাজ করছে। তিনি নেতাজির অধরা স্বপ্ন পূরণ করার ডাক দেন। এই দুই নেতার বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবের মিল কতটুকু? দেখা যাক ইতিহাস কী বলে।

সাম্প্রদায়িক বিজেপি বনাম অসাম্প্রদায়িক নেতাজি

নেতাজির জীবন ও সংগ্রামের কথা যাঁদের কিছুটাও জানা আছে তাঁদের বুঝতে কোনও অসুবিধা হবে না যে, প্রধানমন্ত্রী কিংবা ভাগবতের চিন্তাধারার সঙ্গে নেতাজির চিন্তাধারার কোনও মিলই নেই। দুই চিন্তাধারার পার্থক্য বাস্তবে দুস্তর এবং সম্পূর্ণ বিপরীত।

প্রধানমন্ত্রী এবং ভাগবতরা যে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চিন্তার দ্বারা চালিত হন, সুভাষচন্দ্রের চিন্তাধারার মধ্যে তার চিহ্নমাত্র ছিল না। তিনি শুধু অসাম্প্রদায়িকই ছিলেন না, সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ জাতির পক্ষে যে কত ক্ষতিকর তা তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বারবার তুলে ধরেছেন এবং কী ভাবে তা দূর করা যায় তার জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁর এই প্রচেষ্টারই ফল আমরা দেখতে পাই আজাদ হিন্দ ফৌজে। সেখানে হিন্দু মুসলমান শিখ সব ভারতীয় একসঙ্গে বসে যেমন খেয়েছেন থেকেছেন তেমনই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। অন্য দিকে ভাগবতদের চিন্তাধারা সমাজে সম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দীর্ঘ ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে চলেছে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী ছিল আরএসএস

সুভাষচন্দ্র ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ আপসহীন নেতা। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অনুগামী সেই সংঘ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন বলতেই রাজি হয়নি। আরএসএস-এর তাত্ত্বিক নেতা গোলওয়ালকার তাঁর বই ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’-এ মুসলমান বিদ্বেষের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ব্র্রিটিশ শাসন সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ নীরব। বইটির একটি মাত্র অনুচ্ছেদে ব্র্রিটিশ শাসনের উল্লেখ রয়েছে। এই উল্লেখটির উদ্দেশ্য হল ‘ব্র্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদেরক্স তীব্র সমালোচনা করা। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ ও সর্বজনীন বিপদের তত্ত্ব থেকে আমাদের জাতিত্বের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। তার ফলে আমাদের প্রকৃত হিন্দু জাতিত্বের সদর্থক অনুপ্রেরণা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু আন্দোলনই নিছক ব্র্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধিতার সঙ্গে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদকে সমার্থক করে দেখা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে, তার নেতৃবর্গ এবং সাধারণ মানুষের ওপরে এই প্রতিক্রিয়াশীল মতের প্রভাব সর্বনাশা হয়েছে।”

এই ভ্রান্ত চিন্তার ভিত্তিতে আরএসএস স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেনি শুধু নয়, নানা সময়ে ব্রিটিশের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। আরএসএস-বিজেপির আইকন হিন্দু মহাসভার নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর প্রথম জীবনে ব্র্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করলেও অল্পদিনের মধ্যেই সে পথ ছেড়ে দেন। ১৯২০-র দশকের সমসাময়িককাল থেকে তিনি ‘হিন্দুত্বের’ তাত্ত্বিক নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং ব্র্রিটিশ বিরোধিতা ত্যাগ করেন। এই সময় তিনি ব্র্রিটিশের কাছে মুচলেকাও দেন। যুদ্ধের সময়ে তাঁর স্লোগান ছিল, ‘রাজনীতির হিন্দুকরণ এবং হিন্দুধর্মের সামরিকীকরণ।’ যখন সারা দেশের জনগণ ব্র্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়ে আন্দোলনে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত, আজাদ হিন্দ বাহিনী নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে জীবনপণ করে লড়ছে, সেই সময় সাভারকর ১৯৪১-এ হিন্দু মহাসভার ভাগলপুর অধিবেশনে বলেছেন, ‘‘ভারত সরকারের সমস্ত যুদ্ধ প্রস্তুতিকে হিন্দুদের অবশ্যই দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্থন করতে হবে” (সাভারকর সমগ্র, খণ্ড ৬, মহারাষ্ট্র প্রান্তিক হিন্দুসভা প্রকাশিত, পৃঃ ৪৬০)। তিনি ডাক দেন, ‘‘হিন্দু বন্ধুরা আসুন, হাজারে হাজারে লাখে লাখে যোগ দিন সামরিকবাহিনীতে, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীতে।” (বিনায়ক দামোদর সাভারকরস হোয়ার্লউইন্ড প্রোপাগান্ডা– এএস ভিডে, পৃঃ ২৬)। এই গোলামির পুরস্কার হিসাবে ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে সাভারকরের পছন্দমতো লোক মনোনীত করা হয়েছিল। তিনিও ভাইসরয়কে টেলিগ্রাম করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন (ওই, পৃঃ ৪৫১)। ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে হিন্দু মহাসভার নেতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলেছিলেন, ‘‘আমি মনে করি না যে, গত তিন মাসের মধ্যে যেসব অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা এবং নাশকতামূলক কাজ করা হয়েছে তার দ্বারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভে সহায়তা হবে।” আরও একধাপ এগিয়ে তিনি মিত্রশক্তিকে অর্থাৎ ব্র্রিটিশকে সহযোগিতা করার কথাও বলেছিলেন, ‘‘এখন যুদ্ধকালীন অবস্থায় ভারতবর্ষের জাতীয় গভর্নমেন্ট এমনভাবে গঠিত হবে, যাতে মিত্রপক্ষের সঙ্গে নিবিড় সহযোগিতার সঙ্গে যুদ্ধ করা সম্ভব হবে।” (রাষ্ট্র সংগ্রামের এক অধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী)। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর একটি চিঠি সংযুক্ত করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে শ্যামাপ্রসাদ লিখেছেন, ব্র্রিটিশের বিপদ তাঁদেরও বিপদ। প্রসঙ্গত, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী প্রতিষ্ঠিত জনসংঘ থেকেই জন্ম বিজেপির।

ভোটে ধর্মকে ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন নেতাজি

সংঘ কিংবা বিজেপি ভারতে যে হিন্দুরাজের কথা বলেন সুভাষচন্দ্র তাকে সম্পূর্ণ অলস চিন্তা বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘হিন্দুরা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়া ‘হিন্দুরাজের’ ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা। শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলির সম্মুখীন– বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র তার কোনওটিরই সমাধান এই চিন্তার মধ্যে নেই” (কুমিল্লার ভাষণ, ১৪ জুন ১৯৩৮)।

সেই সময়ে একদিকে সংঘ, হিন্দু মহাসভা অন্য দিকে মুসলিম লিগের সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপে তিনি এতই বিরক্ত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন যে এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির কোনও সদস্য কংগ্রেসের নির্বাচিত কমিটির সদস্য হতে পারবে না বলে দলীয় সংবিধানে নতুন ধারা যুক্ত করেছিলেন। আরএসএস-বিজেপির রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু এর সম্পূর্ণ বিপরীত এবং পুরোপুরি সংখ্যালঘু বিদ্বেষের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের লক্ষ্য মুসলিম বিদ্বেষকে উস্কে তুলে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি। তার জন্যই বাবরি মসজিদ ধ্বংস, তার জন্যই মহা সমারোহে রামমন্দির তৈরি। অন্য দিকে নেতাজির বক্তব্য ছিল, ‘‘ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি হইতে বাদ দেওয়া উচিত। ধর্ম ব্যক্তি বিশেষের বিষয় হওয়া উচিত, ব্যক্তি হিসেবে মানুষ যে ধর্ম পছন্দ করে তাহা অনুসরণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিবে। কিন্তু ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়, পরিচালিত হওয়া উচিত শুধু অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধি দ্বারা”– ২২ জুন, ১৯৩৯, বোম্বাইতে ফরওয়ার্ড ব্লকের অধিবেশনে ভাষণ।

আরএসএস-বিজেপির এই জঘন্য ভূমিকা দেখেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘‘সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোটভিক্ষায় পাঠিয়েছে। ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলে হিন্দুমাত্রেই শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। হিন্দু মাত্রেরই এর নিন্দা করা কর্তব্য। এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন। তাদের কথা কেউ শুনবেন না।” (১৯৪০ ঝাড়গ্রামের ভাষণ)

শিক্ষা বা শ্রম কোনও নীতিতেই বিজেপি নেতাজির পথ অনুসরণ করে না

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর সরকার নেতাজিকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার জন্য সব রকম পদক্ষেপ করেছে। কোনও ব্যক্তি বা মনীষীকে সম্মান দেওয়ার যথার্থ এবং একমাত্র উপায় হল তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করা। সেই কাজটি বাদ দিয়ে শুধু মূর্তি প্রতিষ্ঠা, তাঁর নামে পুরস্কার ঘোষণা, মিউজিয়াম তৈরি সব কিছুই বাস্তবে লোকদেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। দেশের শ্রমিক-কৃষকদের সম্পর্কে নেতাজির চিন্তার সঙ্গে মোদি সরকারের নীতির কি কোনও মিল আছে?

নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘আজ ভারতের শ্রমিকগণ যাহা সর্বাপেক্ষা বেশি কামনা করেন তাহা হইল ঐক্য। তাহারা যেমন দুর্বল ও নিরক্ষর তাহাতে ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঐক্যই তাহাদের একমাত্র অস্ত্র। শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা সর্বত্রই চলিতেছে। ইহা সহজও বটে। কেন না ভারতের জনগণ ভুখা অবস্থায় আছেন। ধনিক শ্রেণির হাতে প্রচুর টাকা থাকায় তাহারা যে কোনও উদ্দেশ্যে তাহা কাজে লাগাইতে পারেন। শ্রমিকদের মনে রাখা উচিত যে, যাহারা গণ্ডগোল ও বিভেদ সৃষ্টি করিতে চায় তাহারা তাহাদের শত্রু এবং তাহারা ধনিক শ্রেণির দালাল হিসাবে কাজ করে”– (জগদ্দল চটকল শ্রমিক সম্মেলনে ভাষণ, ১০ অক্টোবর, ১৯৩১)। নরেন্দ্র মোদিরা তাঁদের শাসনে শ্রমিকদের ঐক্য ভাঙার জঘন্য কাজটাই করে চলেছেন। একদিকে শ্রমআইন বদলে দিয়ে মালিকদের অবাধে শ্রমিক শোষণের অধিকার দিয়ে দিয়েছেন। অন্য দিকে ধর্মের ভিত্তিতে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামের ঐক্যকেই দুর্বল করে দিচ্ছেন। কেউ বিশ্বাস করবে, নেতাজিকে প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছে বিজেপি!

নেতাজি চেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে চলবে। বলেছিলেন, ‘‘ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার আর এক দিক দিয়া উপযোগিতা রহিয়াছে– ইহা অর্থনৈতিক চেতনা জাগ্রত করিতে সহায়তা করে। অর্থনৈতিক চেতনার প্রভাব গোঁড়ামির মৃত্যু ঘোষণা করে। একটা মুসলমান কৃষকের সহিত মুসলমান জমিদারের যে মিল, তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি মিল রহিয়াছে একটি হিন্দু কৃষকের সহিত একটি মুসলমান কৃষকের। জনসাধারণের অর্থনৈতিক স্বার্থ কোথায় নিহিত রহিয়াছে, তাহা তাহাদের শিখাইতে হইবে এবং একবার তাহা উপলব্ধি করিতে পারিলে তাহারা কখনও সাম্প্রদায়িক বিরোধে দাবার ছক হইতে সম্মত হইবে না” (পুনায় মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক সম্মেলনের ভাষণ, ৩ মে, ১৯২৮)। নেতাজির আদর্শের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীরা যে জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি করেছেন তা যেমন ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার বিরোধী, তেমনই বিজ্ঞানবিরোধী। তা হলে কোথায় তাঁরা নেতাজির আদর্শকে অনুসরণ করছেন? বাস্তবে ধরে ধরে দেখানো যায়, কৃষিসমস্যা, নারীসমস্যা, শিল্পনীতি, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা সহ প্রতিটি প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপির নীতি নেতাজির চিন্তাধারার সম্পূণ বিরোধী।

প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার আগে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে নেতাজি সংক্রান্ত সমস্ত গোপন ফাইল প্রকাশ করবেন। বাস্তবে একবারই কয়েকটি মামুলি ফাইল প্রকাশ করা ছাড়া নরেন্দ্র মোদি সরকার ফাইলগুলি নিয়ে নীরবতাই পালন করে চলেছেন। নেতাজির অন্তর্ধানের পর আশি বছর পার হয়ে গেছে। কংগ্রেস এবং ব্রিটিশের যোগসাজশে সেদিন নেতাজির বিরুদ্ধে এমন কী মারাত্মক ভূমিকা পালিত হয়েছিল যে এমনকি বিজেপিও সেই সব ফাইল প্রকাশ্যে আনতে ভয় পাচ্ছে। দেশের মানুষের তো অধিকার রয়েছে তাঁদের প্রিয় নেতার সঙ্গে ব্রিটিশ এবং কংগ্রেস কী ব্যবহার করেছিল তা জানার। তা গোপন করা কি নেতাজিকে সম্মান দেওয়া? দেশের সাধারণ মানুষ, কংগ্রেস কিংবা বিজেপির কাছে যাঁদের টিকি বাঁধা নেই, তাঁরা অন্তত তা মনে করেন না।

প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নির্দেশে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে ইতিহাস বিভাগ আজাদ হিন্দ বাহিনী ও নেতাজির স্বাধীনতা সংগ্রামের তথ্য সংবলিত একটি বই তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিল প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রতুল চন্দ্র গুপ্তের নেতৃত্বে একদল ইতিহাসবিদকে। সেই বই আলোর মুখ দেখেনি। ২০১১ সালে দিল্লি হাইকোর্ট বইটি প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার সেই নির্দেশ মানেনি। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর নানা মহল থেকে বইটি প্রকাশের দাবি জানানো হয়। মোদিও তা প্রকাশ্যে আনলেন না। নেতাজি প্রশ্নে কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বিজেপি সরকারের কোনও পার্থক্যই দেশের মানুষ পায়নি।

ভোট-রাজনীতির স্বার্থেই নেতাজি-বন্দনা

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-মোহন ভাগবত তথা বিজেপি-আরএসএসের চিন্তার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের চিন্তাধারার মিল কোনও দিক থেকেই নেই। তা হলে সুভাষচন্দ্রের আদর্শকে তারা মানেন, এ কথা বলছেন কেন? এর মধ্যে একটা গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। তা হল, একদিকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁদের কলঙ্কজনক ভূমিকাটিকে আড়াল করা, অন্য দিকে জাত ধর্ম প্রদেশ নির্বিশেষে সুভাষচন্দ্রের বিপুল জনপ্রিয়তা এবং ধর্মনিরপেক্ষ, আপসহীন জাতীয় নেতা হিসাবে দেশজোড়া তাঁর যে গ্রহণযোগ্যতা তাকে আত্মসাৎ করা। তাঁদের আদর্শের সঙ্গে নেতাজির চিন্তা যে বিপরীত মেরুতে, তা গোপন করে তাঁরা আজ সুভাষপ্রেমী সাজছেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএস এবং বিজেপির পূর্বসূরী তৎকালীন হিন্দু মহাসভার কলঙ্কজনক ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানেই না, আর প্রবীণরা চর্চার অভাবে বিস্মৃত। সেই ভূমিকাকে নেতাজি-প্রীতি দেখিয়ে মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টাও এই নেতাজি-বন্দনার অন্যতম কারণ। আজ যখন দেশীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সেবায় নিবেদিত বিজেপি সরকারের ব্যর্থতা– মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, বেসরকারিকরণ, মহিলাদের উপর অত্যাচার, শিক্ষা-চিকিৎসার বেসরকারিকরণ প্রভৃতি প্রতিটি প্রশ্নে প্রকট হয়ে উঠছে, তখন ‘নেতাজির আদর্শ আমাদের আদর্শ’ এই কথা বলার দ্বারা দেশের মানুষের নেতাজির প্রতি আবেগকে কাজে লাগিয়ে সরকারের জনবিরোধী ভূমিকাটিকে আড়াল করার হীন চেষ্টাই রয়েছে এর মধ্যে। ফলে প্রধানমন্ত্রী ও ভাগবতের নেতাজি-বন্দনা যে নিছক ভোট-রাজনীতির হিসাব কষে তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।