লেনিন স্মরণ সমাবেশে মর্যাদাময় জীবনের সন্ধানে এসেছিলেন ওঁরা

 

২১ জানুয়ারি, দুপুর সাড়ে বারোটা। এসপ্ল্যানেড মেট্রোর শহিদ মিনার গেট দিয়ে বেরোতেই কানে এল সমবেত কণ্ঠের গান–

‘মেঘের ওপার থেকে বজ্রনিনাদ ধ্বনি বাজে

তরঙ্গ উত্তাল প্রশান্ত সাগরের মাঝে,

দৃঢ় কদম, বুকে বল

ওই সৈন্যদল অবিচল,

আছে সবার সামনে দাঁড়িয়ে কমরেড লেনিন

আছে রক্তপতাকা হাতে দাঁড়িয়ে কমরেড লেনিন।’

ঘুম ভাঙানো গান, রক্তে শিহরণ জাগানো সুর। শহিদ মিনার ময়দান থেকে সেই দৃপ্ত সুরের ঢেউ ছড়িয়ে যাচ্ছে ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড চত্বর ছুঁয়ে আরও দূরে, যতদূর মাইকের আওয়াজ শোনা যায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রান্ত প্রত্যন্ত থেকে হাজারে হাজারে মানুষ হাড় কাঁপানো শীত ঠেলে ঢুকে পড়ছেন ময়দানের প্রাঙ্গণে, যেখানে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের আহ্বানে পালিত হচ্ছে কমরেড লেনিনের প্রয়াণ শতবর্ষ।

এ দিনের শহিদ মিনার ময়দান যেন শীতের কলকাতার বুকে এক টুকরো রেড স্কোয়ার। লাল কাপড়ে মোড়া বিশাল মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা, বিশ্বের প্রথম শোষণহীন সমাজ গড়ার কারিগর ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি। গণসঙ্গীতের সুর, দৃপ্ত স্লোগান আর বিপুল জনসমাগমের আবহে সে ছবি আরও জীবন্ত, আরও দ্যুতিময় হয়ে উঠেছে। ডান হাত তুলে কমরেড লেনিন যেন আসন্ন বিপ্লবের পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন এ দেশের কোটি কোটি মুক্তিকামী মেহনতি মানুষকে। লেনিনের প্রতিকৃতির ওপরে একপাশে উজ্জ্বল হলুদে খোদাই করা কাস্তে হাতুড়ি তারা– শ্রমিক শ্রেণির অনিবার্য জয় ঘোষণা করছে। মঞ্চের দুপাশে, ময়দানের মাঝ বরাবর উড়ছে অজস্র লাল পতাকা। মাঠের এক প্রান্তে সুসজ্জিত বুকস্টলে লেনিনের ছবি, লেনিনের ছবি দেওয়া ব্যাজ আর নানা মার্ক্সবাদী বইপত্র। ভিড় উপচে পড়ছে সেখানেও।

বই কিনছিল বছর কুড়ির একটি ছেলে। নাম প্রিয়ব্রত আদক, এসেছে পূর্ব মেদিনীপুর থেকে। একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশে যোগ দিতে আসার কারণ কী? পড়াশুনার ক্ষতি হয় না? আত্মীয়-বন্ধুরা বারণ করেন না? প্রিয়ব্রত বলল, ‘এখানে আসি জানব, শিখব বলে। এখানে যা পাব, কোনও বইতে সে সব লেখা থাকে না। সাত বছর বয়স থেকে এই দলের কিশোর সংগঠন ‘কমসোমল’ করতাম, এখন ছাত্র সংগঠন করি। যারা বারণ করত, তাদের অনেককে আমি বোঝাতে পেরেছি কেন এখানে আসা দরকার। আজ একা আসিনি, আমার পাঁচ জন বন্ধুকেও নিয়ে এসেছি।’ প্রত্যয়ী শোনায় তাকে।

একই রকম প্রত্যয় ঝরে পড়ে প্রৌঢ় শিবনাথ দে’র গলায়। উত্তর চব্বিশ পরগণার দত্তপুকুরের বাসিন্দা শিবনাথ বাবু দৃষ্টিহীন, ট্রেনে হকারি করেন। নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা পরোয়া না করে গড়ে তুলেছেন দৃষ্টিহীন হকারদের একটি সংগঠন। একুশের সমাবেশে এসেছেন কেন জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘আসতে তো হবেই। এটা আমার দায়িত্ব। লেনিন যা শিখিয়ে গেছেন, সেগুলো আমাদের বারবার জানতে হবে, বুঝতে হবে।’ পাশে দাঁড়ানো বাস কর্মচারী বুদ্ধদেববাবু হেসে বললেনঃ ‘শিবনাথ দা’র স্ত্রীও আসেন। আজ আসতে পারেননি।’ এই পথে কি সমাজে বদল আসবে বলে মনে হয়? কথা শেষ করতে দেন না শিবনাথ বাবু। ‘আসবেই, আমি নিশ্চিত। আমি যদি নাও পারি, এই আদর্শ আমার পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যাব। বিপ্লব অনিবার্য।’ নীরব সমর্থনে মাথা নাড়েন পাশে দাঁড়ানো আরও দুই দৃষ্টিহীন শিক্ষক। পৃথিবীর রং-রূপ সৌন্দর্য ওঁরা দেখতে পান না, কিন্তু অন্তরের আলোয় চিনে নিয়েছেন এ যুগের মহত্তম মানবমুক্তির আদর্শকে, শরিক হয়েছেন বিপ্লবী সংগ্রামে। কথা হল দার্জিলিং থেকে আসা নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্রের সাথে। ওঁরা রওনা দিয়েছেন আগের দিন রাতে। ট্রেনযাত্রার ধকল, শীতের কষ্ট ছাপ ফেলতে পারেনি চোখেমুখে। সকলেই গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য শোনার জন্য। এত দূরের পথ পেরিয়ে লেনিন স্মরণ অনুষ্ঠানে এসেছেন। কিন্তু রোজকার জীবনের যে সমস্যা সেগুলোর কী হবে? চাকরি নেই, খাদ্য নেই এ সবের সমাধান কোথায়? রীতেশ পরিয়ারি, কৌশিক ভৌমিক হেসে বললেন, সেই সমাধানের একমাত্র পথ তো সমাজতন্ত্র, যেটা লেনিন করে দেখিয়েছিলেন। এখানেও কীভাবে তা আনা সম্ভব, সেটাই শুনব আজ। আজকের সমাজকে পাল্টাতে হলে লেনিনকে জানা দরকার।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস কমিউনিকেশনের ছাত্রী নিবেদিতা মণ্ডলের বাড়ি সুন্দরবনে। মিটিংয়ে এসেছেন এক বান্ধবীর সাথে। বললেনঃ ‘এখানে এলে বুঝতে পারি, টিভিতে কাগজে সর্বক্ষণ যে ভোটের হিসেব, কাদা ছোড়াছুড়ি দেখি ওটা রাজনীতি নয়। আসল রাজনীতি এটা। আমি আগেও এখানে বই কিনেছি, আজও কিনব। আমার পড়াশুনার বিষয়কে আরও ভালো করে জানার ক্ষেত্রেও সুবিধা হয়।’

একই সুর শোনা গেল হাবড়া থেকে আসা পারমিতা কর্মকারের কথায়। বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখের তরুণী গোটা মাঠ ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করছিলেন। ওঁরা কজন মিলে লেনিন সম্পর্কে কিছু মনীষীর লেখা নিয়ে বের করেছেন একটি সংকলন। বললেন, কলেজ পাশ করে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে নিতে এক শিক্ষকের অনুপ্রেরণাতেই এ পথে এসেছেন, ভালোলাগার টানে। সত্যিই এ রাজনীতিতে মানুষ আসে ভালোলাগার টানেই। পাওনাগণ্ডার হিসাব নয়। সত্যের প্রতি অনুরাগ, ভালোলাগাই এর চালিকাশক্তি।

মঞ্চে তখন ঘোষণা চলছে, মূল সভার কাজ এখনি শুরু হবে, সবাই যেন বসে পড়েন। দক্ষিণ ২৪ পরগণার সুন্দরবন গোসাবা থেকে আসা মিছিলটি সভাস্থলে ঢুকছে। কৃষক, শ্রমিক, বৃদ্ধ, মহিলা, যুবক কে নেই সেখানে! একরত্তি সন্তানকে কোলে নিয়েও এসেছেন অনেকে, কেউ বসে আছেন ঘুমন্ত সন্তানকে নিয়ে। কিন্তু কোথাও কোনও বিরক্তি, অসন্তোষ নেই। মঞ্চের সামনের চেয়ার ভরে গেছে, পরে যারা আসছেন কাগজ পেতে বসে পড়ছেন মাঠে।কাগজ না থাকলে ঠান্ডা মাঠেও বসে আছেন শ’য়ে শ’য়ে মানুষ।বুকস্টলের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজের ছাত্র বিক্রম মণ্ডল।বললেন, ‘দেখুন কিছুদিন আগে সিপিএমের সভা হল ব্রিগেডে, আমি সেই বত্তৃতাও শুনেছি। তৃণমূল দুর্নীতি করছে, ওদের সরিয়ে আমাদের ক্ষমতায় আনো এই ছিল ওদের বক্তব্য। আর এই সমাবেশে শুনছি মার্ক্সবাদের কথা, বিপ্লবের কথা, সমাজতন্ত্রের কথা। এ জিনিস আজ অন্য কোনও দলে নেই।’

সত্যিই এ এক অন্যরকম সমাবেশ, যেখানে ভোটের কচকচি নেই, ক্ষমতার আস্ফালন নেই, অন্য দলের বিরুদ্ধে রুচিহীন কুৎসা নেই। আছে বিপ্লবের আহ্বান, মহৎ আদর্শকে বরণ করার ডাক। আছে আদর্শগত চর্চা, নিজেদের জীবনে মার্ক্সবাদের প্রয়োগ। আকাশ-বাতাস মুখরিত করে ওঠা স্লোগানেও ছিল সেই অন্য সংস্কৃতির ছাপ– নিছক সরকার বদলের লড়াই নয়, সমাজ বদলের লড়াই চাই। মন্দির-মসজিদ নয়, ভুখা মানুষের খাদ্য চাই। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করো।

মহান লেনিন এই মাটির পৃথিবীর বুকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া নামে এক বাস্তবের স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গোটা বিশ্ব দেখেছিল, মার্ক্সবাদ কোনও পুঁথিতে আবদ্ধ দর্শন নয়, বাস্তবের মাটিতে একে সঠিকভাবে প্রয়োগ করে এমন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে একদল মানুষের শ্রম নিংড়ে কিছু মানুষ মুনাফা করতে পারবে না।

যে সমাজ দারিদ্র বেকারি অসাম্য থেকে মুক্ত হবে, যেখানে মানুষের জীবন হবে সুস্থ, সুন্দর। আর এটা করতে গিয়ে মার্ক্সবাদকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করার সাথে সাথে লেনিন একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য অমূল্য পথনির্দেশ দিয়েছিলেন। লেনিনের দেখানো সেই পদ্ধতি এবং সংগ্রাম অনুসরণ করে ভারতের বুকে একটি যথার্থ কমিউনিস্ট দল গড়ে তোলার কাজটি করেছিলেন কমরেড শিবদাস ঘোষ।

তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, এ দেশে অনেক বড় বড় কমিউনিস্ট নামধারী পার্টি থাকলেও সেগুলো সঠিক লেনিনীয় পদ্ধতি মেনে মতবাদিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেনি, ভারতের বিশেষ রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে মার্ক্সবাদকে বিশেষীকৃত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং দলের ভেতরেও চিন্তার ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আদর্শগত কেন্দ্রিকতার নীতি অনুসরণ করেনি। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় গড়ে ওঠা এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) জন্মলগ্ন থেকেই এগিয়েছে এই কঠিন সংগ্রামের পথ ধরে। এ এক আলাদা জাতের দল, যে দলকে মানুষ চেনে এমএলএ-এমপি’র সংখ্যা দিয়ে নয়, চেনে গণআন্দোলনের শক্তি হিসেবে। এ দিনের সমাবেশ আবারও প্রমাণ করল, সংগ্রামী বামপন্থার পতাকা নিয়ে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সে তুং-শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে বুকে নিয়ে এ দল এগোচ্ছে। তাই আর পাঁচটা দল যখন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে নীতিহীন জোটের খেলায় মেতেছে, চুরি-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে মানুষের রুজিরুটি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, দেশের কোটি কোটি মানুষকে অভুক্ত রেখে ধর্মের নামে নোংরা রাজনীতি চলছে, তখন ভারতের বুকে এই একটি মাত্র দল ২১ জানুয়ারি স্মরণ করল সোভিয়েত বিপ্লবের কাণ্ডারি, বিশ্বের শোষিত মানুষের নেতা মহান লেনিনকে।

প্রবল শীত উপেক্ষা করে লাখো মানুষ জড়ো হল শহিদ মিনার ময়দানে, গভীর মনোযোগে শুনল লেনিনের কথা, সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার ব্যাপক অগ্রগতির কথা, শপথ নিল আগামী সংগ্রামের। যে কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে একুশের প্রচার করেছেন, যারা প্রতিটি গানকে নিখুঁত করার জন্য মহড়া দিয়েছেন দিনের পর দিন, সুদূর গ্রাম থেকে যে কৃষক এসেছেন তার পরিবার নিয়ে, যে স্বেচ্ছাসেবকের দল রাত জেগে সাজিয়েছেন মঞ্চ আর মাঠ, যে রমণী বাড়ির কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন সন্তান কোলে নিয়ে, তাদের প্রত্যেকের চোখেমুখে খেলা করছিল সেই শপথের আলো, আদর্শের প্রত্যয়, স্রোতে গা না ভাসিয়ে এক মর্যাদাময় জীবনের শরিক হতে পারার আনন্দ।

সভার শেষে মাঠ ছাড়ছে ঘরমুখী জনস্রোত। তখনও প্রবল ভিড় বুকস্টলে, মাঠ জুড়ে স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যস্ত হাতে চেয়ার গোছাচ্ছেন। মঞ্চে তখনও সন্ধের আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন কমরেড লেনিন। মাঠ জুড়ে যেন তখনও অনুরণিত হচ্ছে সেই সুর–

‘উদ্বেগ, বিভীষিকা, আতঙ্ক গেছে ছেড়ে

ছেঁড়া পোষাকের মজুর দল,

তবু চোখগুলো জ্বল জ্বল,

দেখ তাদের রয়েছে হাতিয়ার– কমরেড লেনিন’!