সংগঠন বিস্তারের কাজেও কমরেড মানিক মুখার্জী সৃষ্টিশীল ভূমিকা রেখেছেন– স্মরণসভায় কমরেড অসিত ভট্টাচার্য

মূল বক্তব্য প্রিয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ আপনাদের কাছে রেখেছেন। আমি খুব বেশি কিছু বলব না। কিন্তু স্মরণসভায় কয়েকটা কথা না বললে মনে হয় এটা সম্পূর্ণ হবে না। আমি ছাত্র আন্দোলনের দিনে যখন কলেজে গিয়েছি বা যাচ্ছি অথবা স্কুল জীবনের শেষপর্যায়ে আছি সেই সময় আমাদের প্রিয় ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও তৈরি হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি কমরেড প্রভাস ঘোষ যা বলেছেন, দু-একটা ক্ষেত্রে তার সঙ্গে আমার ঘটনার সামান্য তারতম্য থাকলেও, ওটা নিয়ে ভাবার কোনও কারণ নেই, কারণ ওটা ফ্যাকচুয়াল। স্মৃতি থেকে আমার যতটুকু মনে পড়ছে তার থেকে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই। আমি যখন ডিএসও করা শুরু করি সেই সময় পার্টি অফিসে কমরেড মানিক মুখার্জীকে প্রথম দেখি। ওনার কথাবার্তা আমার মধ্যে খুবই প্রভাব সৃষ্টি করেছিল।

এখানে যে প্রস্তাব পড়া হয়েছে তা থেকে আমরা জানতে পারলাম কৈশোরেই কমরেড শিবদাস ঘোষের সংস্পর্শে আসেন তিনি। এরপরে কলকাতায় আসার পর থেকেই টানা সাহচর্য পেয়েছেন তিনি। কমরেড শিবদাস ঘোষের থেকে নেওয়ার সংগ্রামটা তিনি আমৃত্যু চালিয়ে গেছেন। কৈশোর থেকে ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত এই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াটা মুখের কথা নয়। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা আয়ত্ত করতে গিয়ে তিনি নিজেকে সর্বাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত করেছেন। সেটা আমি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি যখন আমি আসাম থেকে এখানে কমরেড শিবদাস ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে আসতাম। এর পরবর্তী পর্যায়ে আমরা তাঁকে সংগঠনের মধ্যেই বিভিন্ন সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে দেখেছি।

এখানে কমরেড প্রভাস ঘোষ উল্লেখ করে গেছেন, তিনি পার্টির ক্ষেত্রে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি রাজ্য নেতৃত্বের পক্ষ থেকে মুর্শিদাবাদ জেলা দেখভাল করতেন। সেখানে ছাত্রযুবদের দেখা, পরিণত বয়সের কর্মীদের নানা সমস্যা দেখা ও সমাধান করার কাজ তিনি করেছেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন করতে গিয়েও যাঁরা যুক্ত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে পার্টির চিন্তা ও কমরেড শিবদাস ঘোষের বিপ্লবী চিন্তার ভিত্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। এই সংগঠনে যে সব কর্মীরা যুক্ত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে সুদৃঢ় পার্টি চিন্তা গড়ে তোলা, কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট করার কাজটি তিনি সুনিপুণ ভাবে করেছেন।

তাঁকে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে আমার দেখার সুযোগ হয় পার্টির সল্টলেক সেন্টারে। আমরা একত্রে সেখানে ৪-৫ বছর থেকেছি। তাঁর চরিত্রের বাঁধুনিটা বিপ্লবী ভাবনার সুরে বাঁধা। বিপ্লবী রাজনীতিকে বোঝার ক্ষেত্রে, তার উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনও ধরনের শিথিলতা আমি দেখতে পাইনি। কলকাতা জেলায় কমসোমল প্রথম গড়ে তোলার সময় কমরেড মানিক মুখার্জী কমরেড প্রতিভা মুখার্জীর সাথে একত্রে ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী পর্যায়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের সংস্পর্শে থেকে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছেন। বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদদের সঙ্গে তিনি যেভাবে কাজ করলেন এবং তার ফলে আমরা যা পেলাম, তা এক কথায় অভাবনীয়।

কমরেড মানিক মুখার্জী অতি স্বল্প সময়ে দেশের বাইরে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছেন তা অনবদ্য। বিদেশের বিভিন্ন সংগঠনের যে বার্তা আপনারা এখানে শুনলেন, তাতে তাঁকে নেতা বলে মেনে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে কেউ কেউ তাঁকে মানিক বলেই সম্বোধন করেছেন। তাঁর চরিত্র যে কী রকম প্রভাব ফেলত তার পরিচয় আমরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পেলাম। অন্য বহু দেশেও তাঁর কিছু গুণগ্রাহী তৈরি হয়েছিল। এর পরে অসুস্থতা সহ বিভিন্ন কারণে তাঁর আর বিদেশ যাওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে নতুন একটা ইন্টারন্যাশনাল গড়ে তোলা, যে প্রস্তাবটা পূর্বতন সাধারণ সম্পাদক কমরেড নীহার মুখার্জী অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে রেখেছিলেন, তাঁর সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে কমরেড মানিক মুখার্জী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক্সপ্লোরেশন শুরু করেছিলেন। এখানে আমি আরও একটা কথা বলতে চাই। কমরেড শিবদাস ঘোষও তাঁকে দিয়ে সংগঠন বিস্তারের যে কাজ শুরু করিয়েছিলেন, মনে করেছিলেন তিনি পারবেন– কমরেড মানিক মুখার্জী সেই ক্ষেত্রে অত্যন্ত সৃষ্টিশীল ভূমিকা রেখেছেন। এখানে কমরেড শিবদাস ঘোষের চরিত্র তৈরি করার দিকটা, কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার প্রকাশ ঘটছে কতটা, কমরেড মানিক মুখার্জীর মধ্য দিয়ে সেটা আমরা লক্ষ না করে পারি না।

এখানে আরও একটি কথা আমার বলা প্রয়োজন। কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, দোষ-গুণ আপেক্ষিক, সমস্ত সত্যই আপেক্ষিক। তাই কোনও মানুষের দোষ বুঝতে হলে, তাঁর গুণের দিকটা ভাল করে বোঝা দরকার। মানুষের মধ্যে দোষ-গুণ সবই আছে। কিন্তু কাউকে মূল্যায়ন করতে গেলে তাঁর গুণের দিকটা ধরেই তার দোষের মূল্যায়ন করতে হবে। কমরেড মানিক মুখার্জী এমন এক চরিত্র অর্জন করেছিলেন, যে চরিত্রকে আগামী দিনে ভোলা যাবে না। ভুলে যাওয়ার মতো চরিত্র তাঁর নয়। তাঁকে হারিয়ে আমরা যথার্থই শোকার্ত। এ ক্ষেত্রে কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী স্মরণে কমরেড শিবদাস ঘোষ যা বলেছেন তা স্মরণীয়। কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের শিখিয়েছেন– শোক আমরা কেন পেলাম, সেই শোক আমাদের কী করতে বলে, বিপ্লবীদের কাছে সেটাই হল মূল, বাকি কথা সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেছেন। আমার পুনরায় সে সব কথা বলার প্রয়োজন নেই। তাঁর বিপ্লবী স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি এখানেই শেষ করছি।