অচেতন মানুষগুলো পড়ে আছে মাটিতে। পা ফেলার জায়গা নেই। এর মধ্যেই কোনও রকমে পা মাটিতে ফেলে চলা। অসাবধানতাবশত কখনও কখনও পা লেগে যাচ্ছে কারও হাতে, কারও পায়ে, কারও বুক ঘেঁষে পা পড়ছে, আবার কখনও কানের ঠিক পাশ দিয়ে পা চলে যাচ্ছে। তবুও যাঁদের গায়ে পা পড়ছে তাঁরা নির্বিকার। কোনও চিৎকার চেঁচামেচি তো দূরের কথা, মুখে শব্দটি পর্যন্ত করছেন না, যে ভাবে মাটিতে পড়ে ছিলেন, সে ভাবেই পড়ে থাকছেন। শক্ত কিছুর উপর পা পড়লে তবেই একমাত্র নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে, না কোনও মানুষের উপর পা পড়েনি।
এ চিত্র কোনও যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের না। কোনও মহামারিরও না। এ চিত্র পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেনে করে কাজে যাওয়ার, বাড়ি ফেরার।
মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের সপ্তম সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষে বাঙ্গালোরে গিয়েছিলাম। টিকিট ছিল হাওড়া এমএসভিটি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে। রিজার্ভেশন টিকিট। এই রুটে প্রতিদিন হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক যাতায়াত করেন। অথচ ট্রেন মাত্র দু’টি। তাতে জেনারেল কামরার অবস্থাগুলো আর বলছি না। সহযাত্রীদের সাথে কথা বলে জানলাম রিজার্ভেশন কামরার এ হেন চিত্র নিত্য-নৈমিত্তিক।
মানুষগুলোর মুখ দেখে কষ্ট হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ আমার বাবার বয়সী, কেউ আমার ভাই, কেউ বা বোনের মতো। তাঁরা যখন মাটিতে পড়ে আছেন, তখন আমার নরম গদি আঁটা বিছানা যেন গায়ে কাঁটার মতো বেঁধে। আর একবার মানুষগুলোর মুখের পানে চাই। চোখের সামনে এক হকার একজন যাত্রীর মাথায় পা দিয়ে চলে গেল অথচ দুজনেরই ভাবখানা এমন, যেন কিছুই হয়নি। ভাবলে অবাক লাগে, এই সেই মাথা যা লক্ষ লক্ষ বছর বিবর্তনের পথে মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ জীবের আসনে বসিয়েছে। গড়েছে মানব সভ্যতা। সেই সভ্যতার মূল কারিগররাই আজ তাঁদের হাতে তৈরি সভ্যতার মাটিতে পড়ে। কত বড় অসভ্যতা!
এর সাথে রয়েছে টিকিট চেকারদের দাপট, তোলাবাজি। সরকারি পোশাকে টিকিট চেকাররা জেনারেল টিকিটের যাত্রী এবং টিকিট না থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে নিয়ে তাঁদের যথেচ্ছভাবে রিজার্ভেশন কোচে থাকতে দিচ্ছে। কী উদ্দেশ্যে, কীসের ভিত্তিতে তাঁরা টাকা তুলছেন সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তাঁরা তো কোনও উত্তর দিতে পারছেনই না, উল্টেতাড়াহুড়ো করে কোচ ছেড়ে পালাচ্ছেন। এ ভাবে কার্যত সরকারি মদতে অসহায় মানুষদের থেকে তোলা আদায় করছে রেল। অন্য দিকে টয়লেটের সমস্যা, মহিলাদের নিরাপত্তাহীনতা, চার্জার প্লাগ কাজ না করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে বারবার টিকিট চেকার সহ বিভিন্ন স্তরের আধিকারিকদের অভিযোগ জানালেও তাঁরা কোনও সমাধানই করেননি। মনুষ্যেতর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাত্রা করতে বাধ্য করা হচ্ছে যাত্রীদের।
একদিকে বন্দে ভারত নিয়ে প্রচারের ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, যেন মনে হয় ভারতের রেল ব্যবস্থার কী অসামান্য অগ্রগতি! কিন্তু উল্টোদিকের এই চিত্র ফুটিয়ে তোলে আর এক অবস্থা। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও রেল ব্যবস্থার এ হাল কেন? রেল বাজেট কমছে কেন? কেন রেলকে বেসরকারিকরণ করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার– এ সব নিয়ে এই মানুষগুলোর কি কোনও ভাবনা আছে? মানুষগুলো বেঁচে থাকে জীবজন্তুর মতোই, যেন খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা ভিন্ন এ মহান জীবনের আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। এর মধ্যেই কেউ যদি বা একটু ভাবনা-চিন্তা করে তাঁকে চারপাশ থেকে এই ভাবনায় জড়িয়ে ধরে যে, তুমি তো একা, তুমি আর কী করবে? সভ্যতার স্রষ্টাদেরই ভুলিয়ে রাখা হয় তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে।
তবে এ ভাবেই চিরকাল চলতে পারে না। রাতের শেষে ভোর আসবেই, দিনের আলো ফুটবেই। মাটিতে পড়ে থাকা মানুষগুলো চোখ মেলে উঠে দাঁড়াবেই। এটাই যে ইতিহাস নির্ধারিত একমাত্র পথ।
অর্ণব তালুকদার
কলকাতা মেডিকেল কলেজ