Breaking News

বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষে আচ্ছন্ন উত্তরপ্রদেশের শিক্ষিকাও

সময়টা নাকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বর্ণিত ‘অমৃতকাল’। আর এই সময়টাতেই দেশে একটার পর একটা অভূতপূর্ব দৃশ্যের জন্ম হয়ে চলেছে। সমাজমাধ্যমের দৌলতে সম্প্রতি এমনই একটি দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে দেশের মানুষের। ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওয় দেখা গেছে, এক শিক্ষিকার আদেশে ক্লাসের ছাত্ররা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৭ বছর বয়সী একটি ছাত্রের গালে এক এক করে এসে চড় মেরে যাচ্ছে। আরও জোরে মারার নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে ওই বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ সম্পর্কে ঘৃণা উগরে দিচ্ছেন শিক্ষিকা।

পরে জানা যায় এই কুৎসিত ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর জেলায় খুব্বাপুরের এক বেসরকারি স্কুলে। ছাত্রটির বাবা, পেশায় কৃষক মানুষটি প্রথমদিকে পুলিশে অভিযোগ করতে চাননি। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানাবার বিজেপি-আরএসএস-এর ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে উৎসাহী ও উদ্যোগী রূপকার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে একজন সংখ্যালঘুর এমন অভিযোগ কোনও গুরুত্বই পাবে না। পরে দেশ জুড়ে এই ঘটনার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠায়, হয়তো কিছুটা সাহস পেয়েই তিনি পুলিশে অভিযোগ করেন। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশ পুলিশ শিক্ষক-সমাজের কলঙ্ক ওই শিক্ষিকা তৃপ্তা ত্যাগীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে বটে, কিন্তু তা করেছে এমন কৌশলে যে, কোনও ওয়ারেন্ট ছাড়া অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা যাবে না। শুধু তাই নয়, ঘটনার তদন্ত শুরু করতে হলেও আদালতের অনুমতি লাগবে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। এমন জঘন্য ঘটনার পরে বেশ কিছুদিন কেটে গেলেও বহাল তবিয়তে দিন কাটিয়ে যাচ্ছেন তৃপ্তা ত্যাগী।

তা বলে কিন্তু বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশের পুলিশ-প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় বলতে পারবেন না আপনি। শ্রেণিকক্ষে তার ধর্ম নিয়ে কটুকাটব্য করে সহপাঠীদের হাতে মার খাইয়ে একটি বালকের নিষ্পাপ মনে চিরদিনের জন্য অন্য ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণার বীজ বুনে দেওয়ার মতো চরম অপরাধ করলেন যে শিক্ষিকা, তাঁর বিরুদ্ধে আঙুলটি না তুললেও, যাঁরা এই ঘটনার ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক তরুণ মহম্মদ জুবেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে ভুল হয়নি তাদের।

 এই মহম্মদ জুবের অবশ্য বহুদিন ধরেই হিন্দুত্ববাদী শাসকদের বিষনজরে। তথ্যসন্ধানী ওয়েবসাইট ‘অল্ট নিউজ’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা এই তরুণকে গত বছরই উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল। শেষে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি পান। এবার নির্যাতনের এই ভিডিও ‘এ” (আগেকার ‘টুইটার’)-এ পোস্ট করার পরে জাতীয় শিশু অধিকার রক্ষা সংস্থার আপত্তিতে সাড়া দিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জুবের সেটি তুলেও নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশ পুলিশ রেহাই দেয়নি তাঁকে।

ছাত্র নির্যাতনের এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন– এমন ভাবলে ভুল হবে। সরকারি ক্ষমতায় বসার পর থেকে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ যেভাবে উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনার বিষধোঁয়া ছড়িয়ে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যটির সাধারণ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের শ্বাসরোধ করার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন, তৃপ্তা ত্যাগীর এই বর্বরোচিত কার্যকলাপ তার সঙ্গে ঠিকঠাক খাপ খেয়ে যায়। স্কুলের মতো শিশুদের কাছে অত্যন্ত নিরাপদ একটি জায়গাতেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরীহ ছাত্রটিকে যেভাবে চূড়ান্ত অবমাননার শিকার হতে হল, তা আরও একবার স্পষ্ট করে তুলে ধরে ক্ষমতাদর্পী বিজেপির নোংরা সাম্প্রদায়িক আধিপত্যবাদী চেহারা। গলার জোরে ঘোষণা করে যায়, বিজেপি-শাসিত রাজ্যে সংখ্যালঘুকে নত হয়েই থাকতে হবে সংখ্যাগুরুর অত্যাচারী বুটের নিচে। সেখানে গোরক্ষার নামে নির্বিচারে চলবে নির্মম হত্যা। দাঙ্গাকারীকে রেহাই দিয়ে জেল দেওয়া হবে অত্যাচারিতকে। প্রতিবাদ করলে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু। প্রয়োজনে পুড়িয়ে মারার বিধানও রয়েছে। গণতন্ত্র তো দূর, দেশের মাটিতে স্বাধীন মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকারকেও মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে কখনও নীরবে পরোক্ষভাবে, কখনও সোচ্চারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়ে সেইসব অপকর্ম সুচারু রূপে সম্পন্ন করাবেন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী। দেশ জুড়ে ধিক্কারের বন্যা বয়ে গেলেও মুখটি খুলবেন না প্রধানমন্ত্রী। সেই ভরসাতেই শিক্ষাদানের সমস্ত রীতিনীতি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, এমনকি মানবিকতার রেশটুকুও বিসর্জন দিয়ে নিতান্ত বর্বরের মতো একটি কচি চারাগাছের বেড়ে ওঠাকে থেঁতলে দিতে দ্বিধা করেননি শিক্ষককুলের কলঙ্ক তৃপ্তা ত্যাগী। আর এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে সরকারের কোপে পড়তে হয়েছে মহম্মদ জুবেরকে।

নির্যাতিত শিশুটির জীবনে এই কদর্য ঘটনা হয়তো গভীর ছাপ রেখে যাবে। সুস্থ স্বাভাবিক মানসিকতা নিয়ে তার বেড়ে ওঠাটাই হয়তো খানিকটা বিপর্যস্ত হবে অত্যাচারী এই শিক্ষিকার জঘন্য আচরণে। কিন্তু আশার কথা, উত্তরপ্রদেশের অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকার তথা কেন্দে্রর উগ্র হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যকামী নরেন্দ্র মোদি সরকারের এই সমস্ত অপকর্মকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ আজ সোচ্চারে ধিক্কার জানাচ্ছেন। ছাত্র নির্যাতনের এই ঘটনার বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে ওঠা ঝড় এবং দেশ জুড়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এ কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই সুস্থ প্রতিবাদকেই আরও জোরালো, আরও শক্তিশালী করতে হবে গোটা দেশে। সরকারকে বাধ্য করতে হবে দোষী শিক্ষিকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বিধানে। যাতে আগামী দিনে আর কোনও তৃপ্তা ত্যাগী অন্য কোনও নিরীহ ছাত্রকে নিজের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ধর্ষকামী বিকৃত মানসিকতার শিকার বানাবার সাহস না পায়।