Breaking News

৫ আগস্ট ব্রিগেড সমাবেশের প্রস্তুতি সারা দেশে

দিন বদলের স্বপ্নকথা, সারি সারি লাল পতাকা/ আঁধার বেয়ে নতুন ভোরের আলো/ প্রতি রাতে একটু করে উঠছে ফুটে স্বপন জুড়ে…/ শোষণ পীড়ন দীর্ণ বুকে, জাগছে আশা দিকে দিকে/ খুঁজছে মানুষ নতুন পথের দিশা…/ রাত জাগা ওই গানের সুরে/ হচ্ছে লেখা দেওয়াল জুড়ে/ ৫ আগস্ট চলো ব্রিগেড চলো

রবিবারের বৃষ্টিভেজা সকালে কলকাতার ইস্টার্ন বাইপাসের হরেক শব্দ ঠেলে মাথা তুলছিল গানটার সুর। একদল ছেলেমেয়ে সাইকেলে মাইক বেঁধে ডাক দিয়ে যাচ্ছে বাজারে আসা লোকজনকে– যেতে হবে ভাই ব্রিগেড। তাঁরাও কান পেতে শুনছেন, হাত নাড়ছেন, এগিয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের হাত।

কিন্তু কী আছে এই ডাকে, কেন তা এত সাড়া জাগাচ্ছে! ‘ব্রিগেড চলো’র আহ্বান তো কিছু কম শোনেনি বাংলা! কী সেই বৈশিষ্ট্য, যা নতুন এক সুর হয়ে বাজছে মানুষের কানে? খোঁজ মিলল একটু দূরে এসে, বেলেঘাটার এক দীর্ঘ দিনের বামপন্থী সমর্থকের কথায়। তাঁর দলও ওই রবিবারেই মিছিল করেছে এলাকায়। কিন্তু বামপন্থার ঝান্ডাকে তারা ভোট রাজনীতির চোরাগলিতে আটকে ফেলেছে। সেই মানুষটি ডেকে বললেন, আমরা আজ মিছিলে হাঁটি মাথা নিচু করে, আর আপনারা লাল ঝান্ডা হাতে পথ হাঁটেন মাথা উঁচিয়ে। ঠিক তাই, গানের সুরও তো বলছিল– ‘খুঁজছে মানুষ নতুন পথের দিশা’। জেলায় জেলায় অন্য বামপন্থী দলের সৎ কর্মীরা খোঁজ নিচ্ছেন– আমাদের যখন অনেক এমএলএ এমপি ছিল আমরা ফ্রন্টের সব দল মিলে ব্রিগেড সমাবেশ ডাকতাম। আপনাদের এমএলএ-এমপি কিছুই নেই, একার শক্তিতে কী করে ভরাবেন ব্রিগেডের মাঠ? উত্তর আসছে, বিপ্লবী রাজনীতির শক্তির বিচার এমএলএ-এমপি-র নিরিখে হয় না, হয় গণআন্দোলনের নিরিখে। এ ক্ষেত্রে জনগণের কাছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পরীক্ষিত এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দল। প্রতিটি আন্দোলনে জনগণের যে বিপুল সমর্থন আমরা পাই, তার উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। সেই সমর্থনই প্রতিদিন আমরা ব্রিগেডের প্রচারে পাচ্ছি। এ ব্রিগেড তো শুধু লোক ভরানোর, শক্তি দেখানোর ব্রিগেড নয়। এ সমাবেশ সংগ্রামী জনতার। তাই প্রহর গুনতে শুরু করেছে কলকাতা– আসছে ৫ আগস্ট, যেতে হবে ব্রিগেড।

বাংলার উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত, ভারতের নানা রাজ্যে খোঁজ নিতে বোঝা গেল সত্যিই এক ঘুম ভাঙানিয়া আহ্বান আজ পৌঁছেছে দেশের নানা প্রান্তে। রাত জেগে ছাত্র যুবকরা দেশের প্রান্তে প্রত্যন্তে দেওয়াল লিখনে ফুটিয়ে তুলছেন সেই ডাক– ৫ আগস্ট ব্রিগেড চলো। শুধু দেওয়াল লিখনে নয়,অনেক রাজ্যেই ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে সেই আহ্বান জানানো লিফলেট। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার থেকে সুন্দরবনের কোলে জটার দেউল সর্বত্রই চলছে অসংখ্য ছোট ছোট গ্রুপ বৈঠক। কোথাও কুড়িজন, কোথাও পঞ্চাশজন, কোথাও বা শতাধিক মানুষ পাড়া বৈঠকে শপথ নিচ্ছেন– এ দেশের খেটেখাওয়া মানুষের মুক্তি আকাঙক্ষাকে রূপ দিতে নতুন পথের দিশা দেখিয়েছেন যে মানুষটি, সেই মহান নেতা শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষের সমাপনী সমাবেশ উপলক্ষে যেতেই হবে কলকাতা। শত শত বাজার, হাট, জনবহুল মোড়, পাড়া ধরে ধরে মাইক দিয়ে প্রচার মানুষের নজর কেড়েছে ইতিমধ্যেই। কয়েক লক্ষ মানুষের সমাবেশের এতবড় প্রস্তুতি, কিন্তু বড় বড় সংবাদমাধ্যমে যে তার খোঁজ মিলবে না। কথাটা জানেন পাড়ায় পাড়ায় বৈঠকে যোগ দেওয়া সাধারণ মানুষও। তবে কি প্রচারের ঢেউ উঠবে না, পৌঁছবে না ঘরে ঘরে এই ডাক! খবরের কাগজ, টিভি, রেডিও-র বিকল্পর সন্ধানও জানেন তাঁরা– নিবিড় প্রচার। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ শিবদাস ঘোষের আদর্শে গড়া রাজনীতি শেখায় মানুষের জীবনের সাথে নিবিড় হয়ে মিশে থাকার পথেই পরাস্ত করা যাবে শোষকশ্রেণির সকল আক্রমণকে।

কলকাতার বহু জায়গায় ফুটপাথবাসী মানুষও গ্রুপ বৈঠকে অংশগ্রহণ করছেন। বৈঠকে বসছেন পরিচারিকারা, বস্তিবাসীরা। দেখা যাচ্ছে বহু রেল স্টেশনে যাতায়াতের পথে পরিচারিকারা অল্প সময় দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রস্তুতির কথা সেরে নিচ্ছেন। কাজের বাড়িতে তাঁদের অনেকে বলে দিয়েছেন, ৫ আগস্ট আসতে পারবেন না, চেয়েছেন চাঁদা। নতুন মর্যাদায় ভাস্বর হয়ে ওঠা শ্রমক্লিষ্ট মুখগুলোকে শ্রদ্ধা না করে উপায় নেই। অন্য দিকে বৈঠকে বসছেন জাতীয় এবং রাজ্য স্তরের প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, গবেষক ছাত্ররা। গভীর আগ্রহে শুনছেন আলোচনা, বুঝতে চাইছেন মার্ক্সবাদের আলোকে শিবদাস ঘোষ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে দিশা রেখেছেন তার পথকে। আলোচনায় বসছেন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের অধ্যাপক, স্কুল শিক্ষকরা। আলোচনা সভায় মিলিত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রথিতযশা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা। বিশিষ্ট শিল্পী, সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা তাঁরাও নতুন করে চিনতে চাইছেন শিবদাস ঘোষকে। কলকাতা সহ রাজ্য জুড়ে অসংখ্য কর্মী সভা, ঘরোয়া সভায় যোগ দিচ্ছেন দলের কর্মী সমর্থকের বাইরেও বহু মানুষ। পথ খুঁজছেন তাঁরা। উত্তরবঙ্গ থেকে আসবেন হাজার হাজার মানুষ। তার জন্য বিশেষ ট্রেন বুক না করে উপায় নেই। জেলায় জেলায় ঠিক করতে হচ্ছে প্রচুর বাস। শুধু মুর্শিদাবাদ থেকেই ৫৫-৬০টি বাস চাই। এছাড়াও ভাগ করে উঠতে হবে নানা ট্রেনে। একই রকমের প্রস্তুতি চলছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার গোসাবা, বাসন্তী, ক্যানিং, রায়দিঘী, পাথরপ্রতিমা, ডায়মন্ডহারবার, জয়নগর, কুলতলি, বারুইপুরে– বাদ নেই কোনও জায়গা। পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার আদিবাসী, অ-আদিবাসী মানুষ সকলে মিলে ব্রিগেড পৌঁছনোর জন্য প্রস্তুতি সারতে ব্যস্ত। কত বাস ট্রেন, পায়ে হাঁটা পথ যে তাঁদের পেরিয়ে আসতে হবে– যা অন্যসময় কষ্টকর। কিন্তু এমন আহ্বান যেখানে শরীরের কষ্ট পিছনে পড়ে থাকে মনের টানে। একই সঙ্গে এত আয়োজনে চাই প্রচুর টাকা, দরিদ্র মানুষ মুষ্টি মুষ্টি করে চাল জমিয়ে যেমন করে তীর্থযাত্রার পাথেয় সংগ্রহ করতেন অতীতে, ঠিক তেমন করেই টাকা একজোট করছেন তাঁরা। আত্মীয়-স্বজন পরিচিত অপরিচিত সকলকে বলে রাখছেন যেমন পারো সাহায্য দিও বাপু। এ যে সকলের কাজ। এই দল তো টাটা-বিড়লা-আম্বানি-আদানিদের দল নয়, যে চাইলেই কোটি কোটি টাকা এসে যাবে! এর সম্পদ ছড়ানো আছে গরিবের ঘরেই। একটু একটু করে টাকা জমিয়েছেন তাঁরা এক বছর ধরে। কুলুঙ্গিতে গোঁজা বহুবার মোড়া নোটগুলো হাত দিয়ে একটু সোজা করে তাঁরা তুলে দিচ্ছেন দলের হাতে। প্রতিকূলতা অনেক, ঘরে হাঁড়ি চড়তেও অনেকের সমস্যা। তবু এই ডাকে সাড়া না দিলে যে চলে না। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারের চা বাগানের চিত্রও আলাদা কিছু নয়। চা বাগানে কাজ চলছে। প্রবল বর্ষা। গ্রামে গ্রামে শুরু হয়েছে চাষের মরশুম। এর ওপর নির্ভর করে আছে সারা বছরের রোজগার। কিন্তু ৫ আগস্টের ডাক সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। প্রস্তুতি চলছে কৃষক পরিবারে। চাষের মাঠেও চলছে আলোচনা।

স্কিম ওয়ার্কার, চটকল শ্রমিক, হকার, সংগঠিত-অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মধ্যেও চলছে প্রস্তুতি। হুগলি নদীর দুই পারের শিল্পাঞ্চলও বাদ যায়নি। বহু কারখানার গেটে, শ্রমিক মহল্লায় চলছে সভা। ট্রান্সপোর্ট শ্রমিকরা পালা ঠিক করছেন কে কখন কাজ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন ব্রিগেড সমাবেশের প্রস্তুতির কাজে। ছাত্ররা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে, ক্লাস রুমে আলোচনায় বসছে। পাড়ায় পাড়ায় হচ্ছে যুব সংগঠনের বৈঠক। নারী আন্দোলনের কর্মীরাও এলাকায় এলাকায় করছেন বৈঠক।

শুধু বাংলা নয়, সারা ভারতেই চলছে এই প্রস্তুতির কর্মযজ্ঞ। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকে এসইউসিআই(সি) আজ সর্ববৃহৎ বামদল। রাজ্যকে একাধিক জোন ভাগ করে হয়েছে শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষ পালনের তাৎপর্য সংক্রান্ত আলোচনা। চলছে দেওয়াল লিখন। কেরালা, তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানার নানা শহরের নানা মহল্লায় দেওয়াল সেজে উঠেছে ৫ আগস্টের আহ্বানে। দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন এমন বহু মানুষ আসবেন দক্ষিণ ভারত থেকে ব্রিগেড সমাবেশে। দেওয়াল জুড়ে ব্রিগেড চলোর আহ্বান আর মহান নেতা শিবদাস ঘোষের উদ্ধৃতি ফুটে উঠেছে উত্তরপ্রদেশের বেনারস, এলাহাবাদ, জৌনপুর, প্রতাপগড়, লক্ষ্নৌ সহ নানা শহরের দেওয়ালে। মধ্যপ্রদেশে ভোপাল, জব্বলপুর, গুনা, গোয়ালিয়র, অশোকনগর সহ ৪০ জেলায় হয়েছে প্রচার। দেওয়াল লিখন তো আছেই, তার সাথে ছোট বড় সভা হচ্ছে প্রায় সব শহরে। গুনা গোয়ালিয়রে শিশু কিশোরদের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং আজকের মুক্তি সংগ্রামে শিবদাস ঘোষের শিক্ষা নিয়ে নানা আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান চলছে। ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থানেও নানা শহরে নানা ভাষায় দেওয়ালে ফুটেছে কলকাতা চলো লেখা। উত্তর ভারতে সাম্প্রতিক বন্যার মধ্যেও সাধ্যমতো ত্রাণকার্যের পাশাপাশি কর্মীরা প্রচার করছেন শিবদাস ঘোষ জন্মশতবর্ষে কলকাতার ব্রিগেডের সভার কথা। এতদূর আসতে গেলে শুধু টিকিট নয় আছে পথ খরচ, সংগ্রহ চলছে সেই তহবিলও। আহ্বান পৌঁছেছে উত্তরাখণ্ডে। গাড়ওয়াল জেলার শ্রীনগরে ছাত্র-যুবরা জোট বেঁধেছেল কলকাতা আসার। হিমাচল প্রদেশের মাটিতেও হয়েছে আলোচনা সভা। বিহার থেকে আসবেন বহু মানুষ, রিজার্ভ করতে হচ্ছে বিশেষ ট্রেন।

ঝাড়খণ্ডের কয়েক হাজার মানুষ আসবেন চলতি ট্রেনগুলিতে অথবা বাসভাড়া করে। বিপুল জমায়েত হবে ওড়িশা থেকে। এই রাজ্যে তাঁরা দুটি ট্রেন ইতিমধ্যে রিজার্ভ করার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। এ ছাড়াও বেশ কিছু বাস লাগবে তাঁদের। আসাম জুড়ে চলছে অসংখ্য সভা। বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেও তাঁরা প্রচারের কাজ থামাননি। পিছিয়ে নেই ত্রিপুরা, অনেক দূরের রাস্তা ঠেলে কলকাতা পৌঁছানো সহজ নয়, কিন্তু তাতে কি পিছিয়ে যাওয়া চলে?

হ্যাঁ, প্রহর গুনছে কলকাতা, প্রহর গুনছে দেশের বামপন্থী মানুষ, প্রহর গুনছেন কৃষক শ্রমিকরা– বাঁচার পথ খুঁজতে, শোষণের অবসান চাইতে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের সঠিক উপলব্ধি শিবদাস ঘোষের আদর্শকে আজ বুঝে নিতে হবেই। শোষিত শ্রমজীবী মানুষ বুঝবে এটাই রাস্তা।