ইদানিং মাঝে মাঝেই রোজগার মেলার প্যান্ডেল খাটিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিংবা অন্য কোনও মন্ত্রী কিছু কিছু নিয়োগপত্র বিলির চমক দিচ্ছেন। কিন্তু দেশে বেকারত্বের ভয়াবহতা এবং চাকরির অনিশ্চয়তা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা রাখতে বিজেপির শ্রমিক সংগঠন বিএমএস কিংবা বিজেপির আদর্শগত অভিভাবক আরএসএসকেও মাঝে মাঝে দারিদ্র, বেকারত্ব প্রসঙ্গে দু’চারটে মন্তব্য করতে হয়।
কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার সমীক্ষাই জানিয়েছিল, ২০১৭-১৮ সালেই ভারতে বেকার সমস্যা গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক এবং তা ক্রমবর্ধমান। ২০১৪-তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেওয়া বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতির কথা দেশের মানুষ মনে রাখলেও তিনি এবং তাঁর সরকার তা এখন ভোলাতেই ব্যগ্র। এখন ২০২৪-এর ভোটকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী আগামী দেড় বছরে ১০ লক্ষ নতুন চাকরির ঢাক বাজাচ্ছেন। তাঁর চেষ্টা আগের প্রতিশ্রুতি ভুলিয়ে দেশের যুবসমাজকে নতুন করে প্রতারণা করা। যদিও এবারের প্রতারণা আরও মর্মান্তিক, আরও নিষ্ঠুর। করোনার মৃত্যুমিছিলের মধ্যেই মানুষের অসহায়তার সুযোগে পার্লামেন্টে কার্যত কোনও আলোচনা ছাড়াই পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে চারটি শ্রমকোড, বিদায় জানানো হয়েছে ৪৪টি শ্রম আইনকে। এই শ্রমকোডের মাধ্যমে কবর রচিত হল বহু রক্তক্ষয়ী লড়াই-সংগ্রামে অর্জিত শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের। মালিকী অত্যাচার থেকে বাঁচতে শ্রম আইনের যতটুকু সুরাহা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তাকে বাতিল করতে চালাকি ও ধূর্তামির আশ্রয় নিল সরকার।
পুঁজিপতিদের প্রয়োজনে সস্তা, অধিকারহীন শ্রমিকের জোগান সুনিশ্চিত করাই লক্ষ্য
বিজেপি সরকারের সুচতুর পরিকল্পনা সারা দেশ জুড়ে এমন শ্রমিক বাহিনী তৈরি করা, যারা চাকরির স্থায়িত্ব, বেতনের নিরাপত্তা ও সমস্ত সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার থেকে বঞ্চিত, শ্রম-দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি। কর্মসংস্থানের নামে উবের, ওলা-র চালক, জোম্যাটো, সুইগি, অ্যামাজনের ডেলিভারি এি’কিউটিভ, পার্ট টাইম সফটওয়্যার কর্মী অথবা পার্ট টাইম ইলেকট্রিশিয়ান-এর মতো সর্বক্ষেত্রে সকল অধিকারহীন নির্দিষ্ট বেতন কাঠামোহীন এক নতুন শ্রমিক বাহিনী তৈরি করাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘ভিশন ফর ২০৪৭’-এর মূল লক্ষ্য। এই সর্বাত্মক নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রকে রূপায়িত করতে বৃহৎ পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেট শিল্পগোষ্ঠী বেশিরভাগ নিয়মিত কর্মীকে ক্রমাগত ‘গিগ’-কর্মীতে অর্থাৎ অস্থায়ী অথবা আংশিক সময়ের ভাড়া করা শ্রমিকে পরিণত করতে চাইছে। অনেক ক্ষেত্রে কর্মীর বদলে তাদের ‘ওয়ার্কিং পার্টনার’ নাম দিয়ে সামান্য কমিশনের বিনিময়ে দিনরাত খাটানো হচ্ছে। ফলে কর্মী হিসাবে নূ্যনতম প্রাপ্যটুকু দেওয়ার দায়ও মালিকদের থাকছে না। চরম বেকারত্বের কারণে দেশের যুব সমাজ বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হচ্ছে এই ধরনের কাজে যোগ দিতে।
এই অবাধ শ্রমিক শোষণের সুযোগই হল পুঁজিবাদী বিশ্বয়ানের কান্ডারি বিশ্বব্যাঙ্কের ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’ বা ব্যবসার সহজ পরিবেশের মাপকাঠি। আর বিজেপি সরকার এই শোষণের সারিতে এগিয়ে থাকতে সস্তা-অধিকারহীন-দাবিহীন শ্রমিক জোগানোকে সুনিশ্চিত করছে। জনগণের টাকায় গড়ে ওঠা, সরকারি সংস্থাকে জলের দরে বৃহৎ পুঁজিকে বিক্রি করে ও তাদের কোটি কোটি টাকা কর ছাড় দিয়ে এ দেশে গড়ে উঠছে দেশি-বিদেশি পুঁজির মুনাফার স্বর্গরাজ্য। বিজেপি সরকার বৃহৎ পুঁজির মুনাফার লালসাকে চরিতার্থ করছেন বলেই অর্থ, পেশি, প্রশাসন, প্রচার প্রভৃতির সমস্ত শক্তি নিয়ে পুঁজিপতিরা সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াচ্ছে বিজেপি সরকারের পিছনে। আর ক্ষমতার মসনদের বিনিময়ে বিজেপি সরকার বৃহৎ মালিকদের মুনাফার ঝুলি ভরিয়ে দিতে যে-কোনও রকম শ্রমিক মারা পদক্ষেপ নিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছে না।
আরএসএস-এর আসল আদর্শ পুঁজিপতিদের মুনাফা নিশ্চিত করা
মালিকের সর্বোচ্চ মুনাফাকে যে কোনও মূল্যে সুনিশ্চিত করতে বিজেপির আদর্শগত অনুপ্রেরণা আরএসএস-এর মন্ত্র। নরেন্দ্র মোদির পরম পূজ্য গুরু গোলওয়ালকর বলেছেন – ‘নিজের জন্য মুনাফাকে সুনিশ্চিত করতে না পারলে মানুষ তার ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতাকে বাস্তবায়িত করতে পারবে না’। আর মুনাফা তো শ্রমিক করে না, করে মালিক, অতএব আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মালিকের মুনাফার স্বার্থে শ্রমিকস্বার্থকে বলি দিতে বিজেপির অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। এরই সাথে শ্রমিকদের সব ধরনের কষ্টার্জিত অধিকার হরণ করে যখন খুশি ছাঁটাই, লকআউটের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিজেপির সহায় গোলওয়ালকরের প্রদর্শিত পথই। তিনি বলেছেন ‘আজ আমরা সর্বত্র অধিকারের দাবি শুনতে পাই। আমাদের সব রাজনৈতিক দলগুলিও সব সময় জনগণের অধিকারের কথা বলে তাদের মধ্যে অহমিকা জাগিয়ে তুলছে’। অধিকার চাওয়া হল শ্রমিকের অহমিকা! তাকে মুখ বুজে কর্তব্য পালনের উপদেশ দিয়েছেন গুরুজি।
তাই সারা দেশে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার হরণের আয়োজনে আজ গোলওয়ালকরের মন্ত্রই সংকটগ্রস্ত পুঁজির সেবাদাসদের হাতিয়ার। এই হাতিয়ারকে শাণিত করেই শ্রমিকদের ক্রমাগত মজুরি কমিয়ে ও সামাজিক সুরক্ষাকে ধ্বংস করে প্রতি বছর বৃহৎ মালিকদের পাঁচ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি কর ছাড় দেওয়াকে বিজেপি নেতারা ‘দেশ ভক্তি’ই মনে করেন। পুঁজিপতিদের কর ছাড়ের জন্য সওয়াল করে প্রধানমন্ত্রীর গুরুজি বলেছেন, কর বাড়লে উৎপাদনকারীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। তাদের গুরুজির কথা বিজেপি এ ক্ষেত্রেও অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। শুধু তাই নয়, শ্রমিকরা শোষণের স্টিম রোলারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে, অধিকার দাবি করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মঞ্চে বিন্দুমাত্র আওয়াজ তুললে, লড়াই গড়ে তুললে, গোলওয়ালকরের মতে তা হবে ‘রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংঘাত … যেমন শ্রমিক ও শিল্পপতির মধ্যে সংঘাত।’ তাই গোলওয়ালকর খুবই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন ‘শ্রেণি সংগ্রামের ধ্বংসাত্মক ধারণাকে … সফলভাবে ভারতীয় মতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।’ অর্থাৎ মালিকি জুলুম যত নিষ্ঠুরই হোক, মালিক-শ্রমিক সহযোগিতার জয়গানই গাইতে হবে। এই জয়গান শুধু মালিকেরই জয়গান– এ কথা বুঝতে কারওরই অসুবিধা হয় না। আরএসএস গুরুজি গোলওয়ালকর মালিকদের পরামর্শ দিয়ে বলেছেন ‘প্রতিটি কারখানা অথবা শ্রমিক কলোনিতে একটি করে মন্দির তৈরি করে সাপ্তাহিক ভজন, পূজার্চনা, ধর্মীয় আলোচনা ও হরি-কথার আয়োজন করতে হবে।’ যাতে শ্রমিকরা শোষণের জন্য মালিকের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে নিজের কপাল চাপড়ে, ভাগ্যকে দোষ দিয়ে দেবতার পায়ে মাথা খুঁড়েই শান্ত হয়ে থাকে, তার ব্যবস্থা তিনি করতে বলেছেন। গুরুজির এই পরামর্শকে বেশিরভাগ শিল্পপতিই মেনে চলেন। ফলে বাড়ছে শ্রমিকদের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ। হিন্দু শ্রমিক, মুসলমান-খ্রিস্টান শ্রমিককে মালিকরা ধর্মের ভিত্তিতে লড়িয়ে দিতে পারছে।
বিজেপি-র উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি শ্রমিক শোষণের হাতিয়ার
গোলওয়ালকরজির অনুগত ভক্ত আরএসএস-এর প্রচারক নরেন্দ্র মোদি ২০০৭-এ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সেখানকার বাল্মিকী সম্প্রদায়, যাঁরা পুরুষানুক্রমে নিজের হাতে জঞ্জাল পরিষ্কারের কাজ করেন, তাঁদের সম্পর্কে আইএএস অফিসারদের একটি সভায় বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না শুধু জীবিকা অর্জনের জন্যই তারা এ কাজ করে যাচ্ছেন। … কোনও এক সময় তারা কেউ (বাল্মিকী সম্প্রদায়) এই মর্মে আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিল যে ভগবান ও সমগ্র সমাজের সুখ প্রদানের জন্য এটা তাদের কর্তব্য। ভগবানের দেওয়া জঞ্জাল পরিষ্কারের কাজ অন্তরের আধ্যাত্মিক কাজ হিসেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী তাদের চালিয়ে যেতে হবে।’ অর্থাৎ শিক্ষাগ্রহণ করে বহু ধরনের কাজের যোগ্য হয়ে উঠলেও নরেন্দ্র মোদি সাহেব তাঁদের জঞ্জাল পরিষ্কারেই আটকে রাখতে চান।
বাল্মিকী সম্প্রদায়ের কেউ ভগবানের দ্বারা এমন করে আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিলেন কি না, এটা জানা না থাকলেও মোদিজি যে আরএসএস গুরুদের দ্বারা আলোকপ্রাপ্ত হয়েই এই ধারণা লালন-পালন করছেন তা আজ সুষ্পষ্ট। এই হল তথাকথিত নিম্নবর্ণ সম্পর্কে আরএসএসের আসল মনোভাব। ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির স্বার্থে হিন্দু ভোটকে করায়ত্ত করতে বিজেপি যেমন হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে উস্কে দিচ্ছে, অন্য দিকে উদার সাজতে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ স্লোগান দিচ্ছে, ‘সবকা সাথ-সবকা বিকাশ’ আওয়াজ তুলছে। আবার বিজেপি রাজস্থানে সরকারে থাকার সময় ‘৯০-এর দশকের শুরুতে জয়পুর হাইকোর্টের সামনে মনুর মূর্তি স্থাপন করেছে। যে মনুর দর্শন নারীকে নরকের দ্বার বলেছে, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষকে উচ্চবর্ণের সেবাদাস রাখতে চেয়েছে, গোলওয়ালকরদের মন্ত্রে দীক্ষালাভ করে আরএসএস-বিজেপি ভারতকে মনুস্মৃতির বিধানে শাসন করতে চাইছে।
মনুস্মৃতির ভাবধারাতে বিজেপি-আরএসএস নেতারা এ দেশের মেহনতি মানুষকে যে গড়ে তুলতে চান, তার প্রমাণ মেলে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে নারী শ্রমিকদের দুরবস্থায় এবং নারী ও দলিত সম্প্রদায়ের উপর অমানবিক ব্যবহারে, প্রমাণ মেলে বিজেপি সরকার কর্তৃক দেশজুড়ে শ্রমিক শাসনের ব্লু-প্রিন্ট রচনা ও তার দ্রুত রূপায়ণে। এই সর্বাত্মক ষড়যন্ত্র কার্যকরি হলে জ্ঞান-বিজ্ঞান মনুষ্যত্বের ওপর নেমে আসবে ভয়াবহ আক্রমণ।
কিন্তু আশার কথা, ভারতের মেহনতি মানুষ শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত করছেন। ভরসার কথা, লাগাতার কৃষক আন্দোলনে সারা দেশ উত্তাল হয়েছে। বিজেপি সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে দিকে দিকে প্রতিরোধ। এই আন্দোলনগুলোকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে অসংখ্য গণসংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে হবে। এই গণসংগ্রাম কমিটিগুলোর নেতৃত্বে দীর্ঘস্থায়ী দৃঢ়পণ লড়াইয়ের মাধ্যমে বিজেপি সরকারের শ্রমিক শোষণের নীল নকশাকে পরাস্ত করা সম্ভব।