যারা সংস্কৃতিগত, আদর্শগত আন্দোলনকে অবহেলা করে শুধু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, তাতে কাজ হবে না৷ এক্ষেত্রে বাড়তি বিপত্তিটা হচ্ছে, যদি মানুষের আকাঙক্ষা আমরা মেটাতে ব্যর্থ হই, তাহলে যে হতাশা আসবে, সেই পথ বেয়ে চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, স্বৈরতন্ত্র, ধর্মান্ধতা প্রবল বেগে ঢুকে পড়বে৷ তাই সংস্কৃতিগত মানকে কোনও মতেই অবহেলা করা যায় না বলেই আমরা এর উপর বিশেষ জোর দিচ্ছি৷ তা নাহলে বুঝতে পারা যাবে না, কেন আমরা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, রেনেসাঁস, মানবতাবাদ, তার সঙ্গে কমিউনিজমের নীতি–নৈতিকতা, দর্শন নিয়ে এত চর্চা করছি৷ আমরা চাইছি, একদিকে রাজনৈতিক কর্মীদের সাংস্কৃতিক মানটাকে তোলা, আরেকটা হচ্ছে, গোটা দেশে প্রগতিশীল শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের মধ্যেও এই চর্চাকে প্রসারিত করা৷ আপনারা লক্ষ করে দেখবেন, নেতাজির মূর্তিতে মালা দিয়ে এসেই শ্যামবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে নেতাজির সমর্থকরা মেয়েদের উত্যক্ত করতে শুরু করে৷ লালঝান্ডা পার্টির লোকেরা লালঝান্ডা তুলে স্লোগান দিয়ে এসেই, লালঝান্ডা হাতে নিয়ে অন্যদের বোমা মারতে শুরু করে৷ … এই যে লক্ষ্যহীন বেপরোয়াভাব, যেটা ইউরোপের সমাজে ব্যাপক আকার নিয়েছে, আমাদের দেশে এখনও এত ব্যাপক আকার নেয়নি – এটা একটা মারাত্মক বিপদ হিসাবেই আসছে৷ আমাদের দেশেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত পরিবারগুলোর যুবক–যুবতীদের মধ্যে, ছাত্রদের মধ্যে এটা ক্রমাগত বাড়ছে৷ এটা হচ্ছে কীসের জন্য? এর পিছনে সামাজিক–র্থনৈতিক– সাংস্কৃতিক কারণ কী? মানসিক–নৈতিক–আচরণবিধি সংক্রান্ত কারণ কী? তাঁরা এর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি৷
ইউরোপের সামনের সারির নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্টরা বলছেন, এটা হল ‘প্রজন্মের সঙ্কট’৷ এঁদের মনোভাবটা হল এটাই দেখানো যে, এতে তাঁদের দায়িত্ব নেই৷ তাঁরা বলে থাকেন, তাঁদের প্রচুর উন্নতি হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে৷ এই বলে তাঁরা যে বড়াই করছেন, এটা তাঁরা করতে পারবেন না, যদি বলা যায়, বাস্তবে এটা সংস্কৃতির সঙ্কট৷ কিন্তু আমি বলব, আদতে এটা সংস্কৃতিরই সংকট, যার দায়িত্ব অবশ্যই নেতৃত্বের উপর বর্তায়৷ এটা দূর করা তাঁদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য৷ তাঁদের এই বিরাট দায়িত্ব তাঁরা পালন করছেন না৷ ফলে, এটা যে আদর্শগত ক্ষেত্রে, নীতি–নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সঙ্কট, তা না বলে তাঁরা বলছেন, এটা প্রজন্মের সঙ্কট৷ তাঁরা অতীন্দ্রিয়বাদে ডুবে রয়েছেন৷
আসলে এটা হল, আদর্শগত–সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তারই ফল৷ মানবতাবাদী মূল্যবোধ নিঃশেষিত হয়ে গেছে৷ অথচ নতুন সর্বহারা মূল্যবোধ ও চেতনা – এক, দুই, তিন, চার করে একটা নির্দিষ্ট ধারণায় আসেনি৷ তারই পরিণামে একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে৷ একটা উন্নত নৈতিকতার ধারণাই একমাত্র এই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে পারে৷ সেটা করবে কে? কারণ, এটা যাঁদের করার কথা, তাঁরা নিজেরাই বিপ্লবের দর্শনগত, আদর্শগত, সংস্কৃতিগত দিকগুলিকে প্রতিফলিত করেন না৷ এই হল ইউরোপের সঙ্কট৷ আমাদের দেশেও এবং অন্যত্র কমিউনিস্ট প্রগতিবাদী বলে যাঁরা এই সমস্যার মধ্যে পড়েছেন, তাঁদেরও মূল সমস্যাটা এখানে৷
নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষায় ভারতের পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লব
শিবদাস ঘোষ নির্বাচিত রচনাবলি, পঞ্চম খণ্ড