সারা বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ১৬১ নম্বরে। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ নামে একটি সংস্থার সূচকে সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের মধ্যে ২০২০তে ভারত ছিল ১৪২ নম্বরে, ২০২২-এ ছিল ১৫০ নম্বরে এবং ২০২৩-এ এগারো ধাপ নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ১৬১ নম্বরে। এতে অন্য দেশের কাছে তথাকথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রের আসল চেহারাটা পরিষ্কার হলেও এ দেশের মানুষের কাছে এটা নতুন কোনও বিষয় নয়। ২০১৪ সালে মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সর্বত্র স্বাধীন চিন্তার ওপর আক্রমণের অঙ্গ হিসেবেই সংবাদমাধ্যমের উপর আক্রমণও বেড়েছে। সংবাদমাধ্যমে কর্পোরেট পুঁজির মালিকানা বেড়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমে শাসক শ্রেণির দুর্নীতি, অনৈতিকতা, অগণতান্ত্রিক কাজকর্মের বিরোধিতা, সমালোচনা প্রায় নেই বললেই চলে, আছে মোদি ভজনার রমরমা। শাসকের কোলে বসে থাকা সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে ‘গোদি মিডিয়া’ কথাটি এখন খুবই চালু যেখানে প্রায় বাদ চলে গিয়েছে জনস্বার্থের বিষয়টি। অথচ গণতন্তে্রর চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে আইনসভা, সরকার এবং বিচারবিভাগের ভূমিকার মূল্যায়ন ও ত্রুটি চিহ্নিত করা সংবাদমাধ্যমের অন্যতম কাজ। ফলত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের স্থান দ্রুত নামছে।
১৯৭৫-৭৬ সালে জরুরি অবস্থার সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সমালোচক সাংবাদিকদের ‘মিসা’ আইনে বিনা বিচারে বন্দি করেছিলেন। বিজেপি আমলে এই সাংবাদিক নিপীড়ন আরও বহুগুণ বেড়েছে। একদিকে সরকার ঘনিষ্ঠ একচেটিয়া পুঁজিমালিকরা দেশের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমকে কিনে নিয়ে তাদের মোদি ভজনায় বাধ্য করছে এবং অপরদিকে যারা নিজেদের বিক্রি করতে রাজি হচ্ছেন না তাদের নানা ভাবে প্রশাসনিক হয়রানি, গ্রেপ্তার এমনকি ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে খুন পর্যন্ত করে দেওয়া হচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০২০ এই ছ’বছরের মধ্যেই প্রখ্যাত সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ, রাজদেব রঞ্জন সহ মোট কুড়ি জন সাংবাদিক বিজেপি প্রভাবিত কিছু ধর্মান্ধ এবং মাফিয়াদের আক্রমণে নিহত হয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সিদ্দিক কাপ্পান সহ বহু সাংবাদিককে বিনা বিচারে মিথ্যা মামলায় দিনের পর দিন আটক থাকতে হয়েছে এবং হচ্ছে। বস্তুত বর্তমানে পৃথিবীর সর্বাধিক জনবহুল দেশ ভারতের বিশাল আর্থিক বাজারকে দেশি-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির অবাধ মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করতে বিজেপি সরকার এতটাই বদ্ধপরিকর যে, এর পথে কোনও রকম প্রতিবাদ-প্রতিরোধই যাতে জনসাধারণ করতে না পারে সে জন্য গোটা দেশে এক অলিখিত প্রশাসনিক সন্ত্রাসের রাজত্ব তারা কায়েম করতে চাইছে। বুঝিয়ে দিতে চাইছে, বিজেপি সরকারের বিরোধিতা কোনও মতেই বরদাস্ত করা হবে না। সমাজে কারও যত পরিচিতি বা প্রতিষ্ঠাই থাক না কেন, সরকারের বিরোধিতা করলেই যে কোনও অজুহাতে তাঁকে কারারুদ্ধ বা হত্যা করা হবে। এই আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যই তারা প্রতিনিয়ত নানা অজুহাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, দলিত, সাধারণ নাগরিকের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার ভিত্তিতে দেশে চরম স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করতে চাইছে। সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা তারই অঙ্গমাত্র। সংবাদমাধ্যমের তথ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি সত্যনিষ্ঠ হলে দেশের জনসাধারণকে তা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে। জনসমাজের মধ্যে যুক্তি-বুদ্ধি-বিচার-বিবেচনার শক্তিকে ধ্বংস করে যুক্তিহীন উন্মাদনা সৃষ্টি করতে স্বৈরাচারী শাসকরা তাই এই সংবাদমাধ্যমকে কিনে নিতে চায় অথবা তার কণ্ঠরোধ করতে চায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়় জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট হিটলারও একইভাবে সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ এবং হত্যা করেছিলেন।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদ করা যেমন যে কোনও গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কর্তব্য, আবার সাংবাদিক সমাজকেও মনে রাখতে হবে, গোটা সমাজ জুড়ে স্বাধীন চিন্তা, যুক্তিনিষ্ঠ মনন যখন আক্রান্ত, তার সোচ্চার বিরোধিতা না করে আলাদা করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। এ কথা ঠিক, অনেক সংবাদমাধ্যমেই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ধর্মীয় উন্মাদনা এবং প্রশাসনিক সন্ত্রাসের সমালোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু শুধু নিবন্ধ লিখে বা টিভিতে বিতর্ক করে এই আক্রমণকে প্রতিরোধ করা যাবে না।
এ দেশে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা শুরু কংগ্রেসি আমলে এবং আজ যদি বিজেপি হেরে গিয়ে কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় আসে তবে তারাও পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষার জন্য একই পথে চলবে। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার বিরুদ্ধে চাই সর্বস্তরের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী আন্দোলন।
ন্যায্য দাবিতে মিছিল বা ধর্মঘট হলে আন্দোলনের দাবিগুলো ন্যায়সঙ্গত কি না, জনগণের সমর্থন আছে কি না– সে সব তুলে ধরার পরিবর্তে একাংশের সংবাদমাধ্যম ব্যস্ত হয়ে পড়ে এর ফলে কত যানজট হল বা কত উৎপাদন নষ্ট হল তার প্রচারে। মনে রাখা দরকার, এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক প্রচার সমাজে আন্দোলনবিরোধী, প্রতিবাদবিমুখ মানসিকতার প্রসারেই সাহায্য করে। আর তাতেই স্বৈরাচারী শাসকের সুবিধে। সংবাদমাধ্যম নিজেদের স্বাধীনতা চাইলে সমস্তরকম ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সাংবাদিকদের নিজেদের একাত্মবোধও অত্যন্ত জরুরি।