স্কুল শিক্ষার কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিএসই অতি সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে, এনসিইআরটির সুপারিশ মেনে দশম শ্রেণির সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হবে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব। ঘোষণার পরই বিজ্ঞানীমহল এর প্রতিবাদে খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন, যেখানে দু’দিনের মধ্যেই দু’হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানী স্বাক্ষর করেছেন, স্বাক্ষর এখনও চলছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ছাত্রছাত্রীরা বিজ্ঞানের এই মৌলিক আবিষ্কারের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হবে এবং তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চিন্তাপদ্ধতি গড়ে তোলার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হবে। কারণ জীবজগৎ যে নিয়ত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আছে এবং বিবর্তন যে একটি নিয়ম নির্ধারিত প্রক্রিয়া, কোনও ঐশ্বরিক শক্তির ভূমিকা যে এখানে নেই, এই চিন্তা ডারউইনের সময় থেকে যুক্তিবাদী ধ্যান-ধারণার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
সকলেই জানেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় দশম শ্রেণির পরে ছাত্র-ছাত্রীদের একটা অল্প অংশই একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে একটা ছোট অংশ জীববিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর ক্লাসে পড়ে। ফলে দশম শ্রেণির সিলেবাস থেকে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব বাদ দিলে একটা বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে।
মনে পড়ে যায়, কয়েক বছর আগে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী ‘সত্যদ্রষ্টা’ শ্রী সত্যপাল সিং-এর একটি ‘সত্যভাষণে’র কথা। তিনি বলেছিলেন, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভুল’। কারণ, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা কোথাও উল্লেখ করেননি যে, তারাও কখনও কোনও বাঁদরকে মানুষ হতে দেখেছেন। কেউই বলে বা লিখে যাননি যে, তারা কেউ এ ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের পূর্বপুরুষদের লেখা কোনও বই বা গল্পগাথায় এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ নেই। তাই বিজ্ঞানের বই থেকে এই তত্ত্বকে বাদ দিতে হবে।’
সেদিন অনেকেই মন্ত্রীর এই চরম অবৈজ্ঞানিক মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় তিনটি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি ‘দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি-নিউ দিল্লি, দি ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-ব্যাঙ্গালোর এবং দি ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এলাহাবাদ’ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছিল, ‘আমরা এ কথা বলতে চাই যে, মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বিবর্তনবাদের তত্ত্ব, যাতে ডারউইনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, তা দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত। বিবর্তনের তত্ত্বের বাস্তবতা নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে কোনও বিতর্ক নেই। এটা একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং এমন একটা তত্ত্ব যার ভিত্তিতে এমন বহু অনুমান বা ভবিষ্যৎবাণী (প্রেডিকশন) করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এই তত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হল, এই গ্রহে অবস্থিত মানুষ ও অন্যান্য বানর জাতীয় প্রাণী সহ সমস্ত জীবই কোনও না কোনও পূর্বতন জীব (প্রোজেনিটর) থেকে বিবর্তিত হয়েছে।’
মন্ত্রীর কথা নিয়ে সেদিন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও কম হয়নি। অনেকে একে পাগলের প্রলাপ বা মন্ত্রীর ব্যক্তিগত অজ্ঞতার বিষয় বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু বিষয়টা যে তা ছিল না, মন্ত্রী যে কেন্দ্রের শাসক গোষ্ঠীর মতকেই প্রতিধ্বনিত করেছিলেন, তা সিবিএসই-র ঘোষণার মধ্য দিয়ে আজ আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু, কেন এই পদক্ষেপ? এ কি নিতান্তই খামখেয়ালিপনার ফল, না কি এর পিছনে রয়েছে একটি সুপরিকল্পিত অভিসন্ধি? এই প্রশ্নগুলো স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে আমাদের একটু পিছনে ফিরে দেখতে হবে– কী আছে এই বিবর্তনবাদের তত্ত্বে এবং গত দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে কারা এর বিরোধিতা করে এসেছে?
ডারউইনের বিবর্তনবাদ সৃষ্টির পিছনে কোনও এক অজানা-অচেনা অথচ শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তার ভূমিকাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দিয়েছে। বিবর্তনবাদের এই তত্ত্ব প্রমাণ করেছে যে, এক প্রজাতি থেকে আর এক প্রজাতির সৃষ্টি একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। কোনও ঐশ্বরিক শক্তির ভূমিকা ছাড়াই প্রাকৃতিক নিয়মে তা ঘটে। ফলে সেদিনের ধর্মতাত্ত্বিকরা ভীষণ বিপদে পড়ে গিয়েছিল। কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বতত্ত্বের পরে ধর্মতাত্ত্বিকদের আশ্রয় ছিল, জীবজগৎ সৃষ্টির তত্ত্ব, বিশেষ করে মানুষের সৃষ্টি সংক্রান্ত ঈশ্বর কেন্দ্রিক ধারণা। কোনও ঐশ্বরিক শক্তির ভূমিকা ছাড়া এটা সম্ভব নয়– এই বিশ্বাসই ছিল তাদের শক্তির শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু ডারউইনের বিবর্তনবাদ মানুষ সহ জীবজগৎ সৃষ্টির পিছনে প্রাকৃতিক নিয়মের কথা প্রমাণ করে দেওয়ায় তা ধর্মতাত্ত্বিকদের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিল। ডারউইন তাঁর ‘অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস’ (১৮৫৯) বইয়ের শুরুতে লিখেছিলেন, ‘এতদিন আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা যা জেনে এসেছি তা-ই কেবল চরম সত্য নয়। ঈশ্বর নামে কেউ মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদকুলকে হঠাৎ সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠাননি, বরং কোটি কোটি বছরের প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবজগতের এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে।’ সরাসরি ঈশ্বর তত্ত্বের উপর এমন আঘাত এর আগে কেউ করেননি। সে যুগে তখন পুরনো সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ভেঙে নতুন বুর্জোয়া সমাজ প্রতিষ্ঠার বিপ্লবের প্রক্রিয়া চলছে। আসছে বিজ্ঞান ও যুক্তির নিরিখে সবকিছু বিচার করার এক নতুন বিপ্লবাত্মক জোয়ার। সে যুগের শাসক সামন্তপ্রভুরা এই যুক্তি এবং বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাকে ভয় পাচ্ছিল। তাই তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ডারউইনের জীবদ্দশাতেই ধর্মতাত্ত্বিকদের তরফ থেকে তীব্র আক্রমণ শুরু হয়েছিল ডারউইনবাদের বিরুদ্ধে।
আজকের দিনে ভারতে সেই ধর্মতাত্ত্বিকদের উত্তরসূরী হিসাবে ভূমিকা নিচ্ছে বিজেপির আদর্শগত অভিভাবক আরএসএস। বিজেপি যাদের সেবাদাস এবং পলিটিক্যাল ম্যানেজার হিসাবে গদিতে বসেছে সেই বুর্জোয়া শ্রেণিও আজ যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক মননকে গলা টিপে মারতে চায়। আজকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরম সংকটের দিনে তারা জনগণকে অন্ধ গোঁড়ামি, কূপমণ্ডুকতা, প্রাচীন ঐতিহ্যবাদের চর্বিত চর্বনের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে চায়। এই পথে শাসক শ্রেণি চাইছে মনুষ্যত্বের বিকাশের রাস্তাটাকেই মেরে দিতে। ফ্যাসিবাদী-চিন্তা কাঠামো এনে তারা যুক্তিবাদী চিন্তার মূল উপড়ে ফেলতে সচেষ্ট। পুঁজিপতি শ্রেণির হয়ে বিজেপি এই কার্যক্রমকেই বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব নিয়েছে। তাই আজ এটা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট যে, মন্ত্রীর সুপারিশ এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা পর্ষদ সিবিএসই-এনসিইআরটি-র সিদ্ধান্ত কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ডারউইনের জীবদ্দশায় শোষণ-জুলুম চালু রাখার তাগিদে ধর্মতন্ত্র বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছিল, আজ তাদের উত্তরসূরীরাই বিবর্তনবাদকে সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর ফল হবে মারাত্মক। কারণ বিজ্ঞানীদের মতে বিবর্তনের জীববিজ্ঞান হল বিজ্ঞানচর্চার একটা বুনিয়াদী বিষয়। বস্তুজগত ও সমাজ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ওষুধ আবিষ্কার, মহামারির মোকাবিলা কীভাবে করা হবে, পরিবেশ সংরক্ষণ কীভাবে করা উচিত, এরকম বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা ও সমাধানের সাথে এটা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
বস্তুজগৎ ও সমাজের পরিবর্তনের পথে যে ধারাবাহিকতা ও ছেদ থাকে তার শিক্ষালাভ না করে যে কোনও ব্যক্তিই বিজ্ঞানের সামগ্রিক শিক্ষালাভ করতে পারে না। তাই পাঠ্যক্রম থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার জগতে এক অন্ধকারময় যুগ নিয়ে আসবে। এ জন্য সময় থাকতে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আগামীকালের জন্য অপেক্ষা না করে আজই প্রতিবাদ করা জরুরি। আশার কথা, দেশের প্রথম সারির বিজ্ঞানীরা এর প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি ও ইন্ডিয়ান মার্চ ফর সায়েন্স-এর মতো বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মীদের সংগঠন এর প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছেন। আপামর জনসাধারণকেও প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।