Breaking News

পাঠকের মতামতঃ সংকটে বন্য প্রাণ, প্রকৃতি, সাধারণ মানুষ

বছর ষাটেকের শীলা ঘোড়াই, রোজকার মতো কাঠ কুড়োতে সকালে মুড়াকাটার জঙ্গলে গেছিলেন। আচমকা সামনে হাতি। হাতিটি সটান শুঁড়ে তুলে আছাড় মারে। গুরুতর আহত ওই বৃদ্ধাকে স্থানীয়রা মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করেন। তিনি মারা যান।

খড়গপুর গ্রামীণ এলাকার খেমাশুলি। সদ্য আবাস যোজনায় বানানো বাড়ির জানালার পাশে ঘুমিয়ে ছিল ললিতা মাহাত। পাশে সেদ্ধ ধান। যা ভানিয়ে পেটের খাবার জোগাড় হবে। পেট বড় বালাই। কী মানুষ, কী বন্য প্রাণীর। তার উপর সে যদি হাতি হয়। মস্ত দেহ, মস্ত তার উদর। সেই উদরের টানে, সে ললিতার লোহার দরজা জানালা ভেঙে সামনে পায় ললিতাকে। তার খাবারের অংশীদার, প্রতিপক্ষ। তাকে শুঁড় দিয়ে টেনে বের করে আছডে, পা দিয়ে থেঁতলে, নিজের খাবার খায়।

না, এ কোনও আদিম যুগের, আদিম কাহিনি নয়। চলতি আর্থিক বর্ষ, ২০২৩-এর মাত্র তিন মাসের মধ্যে, পশ্চিম মেদিনীপুর-ঝাড়গ্রাম জঙ্গলমহল এলাকায় এভাবে হাতির হানায় প্রাণ গিয়েছে ৩৬ জনের, আহত হয়েছে অনেকে, গবাদি পশু, ক্ষেতের ফসল, ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে অনেক। বিস্তীর্ণ এই জঙ্গলমহল এলাকায় মূলত গরিব, আদিবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের বাস। স্বাধীনতার আগে এবং পরে একটার পর একটা সরকারি আইন হয়েছে আর এই সমস্ত গরিব মানুষ হারিয়েছে তাদের জল, জঙ্গল, জমির উপর অধিকার। বহু লড়াই, বিদ্রোহ হয়েছে। সে সব ইতিহাস। কিন্তু আজও, এই আধুনিক ডিজিটাল দুনিয়ায় এইসব মানুষের জীবন যাত্রার মৌলিক কোনও পরিবর্তন হয়নি। আজও বেঁচে থাকার তাগিদে জঙ্গলে তাদের যেতে হয় কাঠ কুড়োতে, ফুল-ফল-পাতা সংগ্রহ করতে। সেখানে হাতির সামনে পড়তে হয়। এ ভাবেই খেতের ফসলকে বন্য প্রাণীর হানা থেকে রক্ষা করতে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়। জঙ্গলের পথ ধরে স্কুল যাওয়ার পথে ছাত্রের প্রাণ যায়। অসহায় পিতার শূন্যদৃষ্টি রেখে যায় বহু প্রশ্ন।

হাতির দল জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে কেন? জঙ্গলে খাদ্যাভাব, পানীয় জলের অভাব, সর্বোপরি নিরাপত্তার অভাবে তারাও বেপরোয়া হয়ে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। এটা যদি প্রত্যক্ষ কারণ হয়, এর পরোক্ষে বা আড়ালে আছে সেই অমোঘ কথা। এক শ্রেণির মানুষের সীমাহীন লোভ। যে কারণে কাঠের নিয়ত চোরাচালান, চোরাশিকার ঘটে, বনদপ্তরের চোখের সামনে। অসদুপায়ে পকেট ভরে ওঠে। কাটমানি, ঘুষ, নীতিহীনতার রমরমা গোটা দেশের মুখ্য সংস্কৃতি হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় কথা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এই সবকিছু মদত পায়। রাষ্ট্রও আইন পাল্টে জল, জঙ্গল, জমি হাতিয়ে নিয়ে তলে তলে বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দেয় একচেটিয়া ব্যবসা করার জন্য। আর এই সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ বা ষড়যন্ত্রে সাধারণ মানুষ কিংবা অবলা জীব কেউই রেহাই পায় না।

সমস্যা মোকাবিলায় নামমাত্র বনসুরক্ষা কমিটি গঠিত হয়। প্রকল্পের সুন্দর বাছাই করা, চমকপ্রদ নামকরণ হয়। ‘ময়ূরঝর্ণা’! আহা, নাম শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুললিত জল ধারা! যে জলধারার একদিকে যেন ময়ূর আনন্দে পেখম মেলে রিমিঝিমি নাচছে আর একদিকে হাতি সহ সকল তৃষিত বন্য প্রাণ, তৃষ্ণা নিবারণ শেষে মুগ্ধ হয়ে অপলকে ময়ূরের দিকে তাকিয়ে আছে। এই দৃশ্য শিশুদের কার্টুনে ঠাঁই পেলে শিশুমনে আনন্দের খোরাক জোগাতে পারে। কিন্তু বিস্তীর্ণ জঙ্গল মহল জুড়ে গ্রীষ্ম মরশুমে কেবল খরা। আগুনলাগা ন্যাড়া জঙ্গল বিবস্ত্র দাঁড়িয়ে থাকে। হাতির মতো মস্ত বন্য প্রাণীর খাদ্য সঙ্কুলান হয় না, তৃষ্ণা নিবারণ হয় না, তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এই সঙ্কটের সমাধান কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের সচেতনতার পাঠ দানে মিলবে, না কি বনকর্মীদের আরো আরো …. সচেতন হতে হবে, বললেই হবে? দুঃখের বিষয় মন্ত্রী থেকে, অবসর প্রাপ্ত বনকর্তা, তথা ডিএফও, বর্তমান বনকর্তা সকলের মুখে একই বাণী। সচেতনতা, সচেতনতা এবং পুনরায় সচেতনতা! তারা চোখ বুজে রামনাম জপের মতো এই বাণী আউড়ে যান। কিন্তু কিসের সচেতনতা, কার সচেতনতা, কার সম্পর্কে সচেতনতা তা নিয়ে কিছুই বলা হয় না।

দৈনন্দিন সাঁড়াশি আক্রমণে পিষ্ট মানুষদের সত্যিই সচেতন করতে হলে তো ধনীর আগ্রাসী ধনলোভের কথা বলতে হয়। বলতে হয় সরকারের নির্লজ্জ উমেদারির কথা। এ যেন সিরিয়াস মস্তিষ্কের রোগে যন্ত্রণাকাতরকে মামনি মলম লাগানোর পরামর্শ! আসল রোগ নিরাময়ের কোনও উদ্যোগের কথা কেউ বলেন না। কারণ সকল কর্তার ঝুঁটি বাঁধা আছে তো একটি জায়গাতেই। যার নির্মম পরিণতিতে মরছে গরিব আদিবাসী, খেটে খাওয়া নিরন্ন মানুষ। মরছে অবলা বন্য প্রাণ! দুপক্ষই পরস্পরকে প্রতিপক্ষ করছে। আসল মজা নিচ্ছে অন্য জন। দুই অসহায়কে এ ভাবে লড়িয়ে দিয়ে আখের গোছাচ্ছে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই মস্ত ষড়যন্ত্রকে রুখতে চাই নতুন বিদ্রোহ। আজকের সিধু, কানহু, বিরসাদের নতুন করে জেগে ওঠার পালা।

অনিন্দিতা জানা, মেদিনীপুর