পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকরী করা শুরু করল। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে ‘কারিকুলাম অ্যান্ডক্রেডিট ফ্রেমওয়ার্ক ফর আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম’ অনুযায়ী চার বছরের ডিগ্রি কোর্সের যে কথা বলা আছে তা কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। গত ১৭ মার্চ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর থেকে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে চিঠি দিয়ে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও শিক্ষাবিদ ও ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদ করায় রাজ্য সরকার আপাতত ‘ধীরে চলো’ নীতি নেওয়ার কথা বলেছে।
কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৯-এ খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি প্রকাশ করার পর থেকেই এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। দেশের প্রথম সারির শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিক্ষক-অভিভাবক-ছাত্ররা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার কোনও প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে অতি দ্রুত তা কার্যকরী করতে ২০২০-র জুলাই মাসে এই নীতিকে চূড়ান্ত রূপদান করে এবং মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত হিসাবে ঘোষণা করে।
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষানুরাগী মানুষ দাবি তুলেছেন, রাজ্য সরকার এই শিক্ষানীতি এ রাজ্যে চালু করবে না বলে ঘোষণা করুক। শিক্ষা যেহেতু যুগ্ম তালিকায় আছে, রাজ্য সরকার চাইলে তা চালু না করতেও পারে। তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার বিকল্প শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য দুটি কমিটি তৈরি করে। ভাবখানা এমন, যেন তাঁরা জাতীয় শিক্ষানীতি মানেন না, তাই বিকল্প নীতির খোঁজ। পার্থ চ্যাটার্জী শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। তার রিপোর্ট কেউ দেখেনি। ব্রাত্য বসু মন্ত্রী হয়ে দ্বিতীয় একটি কমিটি করলেন। দেশ-বিদেশের অনেক নামডাকওয়ালা লোকজনকে তার সদস্য করা হল। কিন্তু কোনও বিকল্প নীতির সন্ধান তাঁরা পেলেন কি না, তা জানা গেল না। বারবার দাবি উঠলেও তাঁরা জনসাধারণকে তা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। অবশেষে ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল রাজ্যে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করার ঘোষণায়। এই প্রথম স্পষ্ট হল, মুখে যাই বলুক, তৃণমূল সরকার আসলে জনবিরোধী জাতীয় শিক্ষানীতিরই পক্ষে এবং তা তাঁরা চালু করবেন। প্রসঙ্গক্রমে একটি কথার উল্লেখ প্রয়োজন– কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই চার বছরের ডিগ্রি কোর্সের তত্ত্বটি মার্কিন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা থেকে নকল করেছে। অথচ এই শিক্ষানীতির ছত্রে ছত্রে তাঁরা ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্য ও তার শিক্ষাপদ্ধতির পক্ষে সওয়াল করেছেন। অর্থাৎ একদিকে তাঁরা বিদেশ থেকে সুবিধামতো ‘কপি-পেস্ট’ করছেন, অন্যদিকে ‘মেক-ইন-ইন্ডিয়া’, ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ ইত্যাদি বাণী হামেশাই আউড়ে যাচ্ছেন।
এই চার বছরের ডিগ্রি কোর্সে কী আছে তা বলার আগে আরও দুয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। জাতীয় শিক্ষানীতির ছত্রে ছত্রে এত ভালো ভালো কথা আছে যে, কেউ যদি খুঁটিয়ে না পড়েন তাহলে তাঁর মনে করার যথেষ্ট সুযোগ আছে যে এই শিক্ষানীতির মতো ভালো শিক্ষানীতি অতীতে কখনও আসেনি। যেমন চার বছরের ডিগ্রি কোর্সের উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছে– প্রতিটি শিক্ষার্থীর অনন্য ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দেওয়া ও তাকে উৎসাহিত করা, যাতে তারা তাদের প্রতিভা এবং আগ্রহ অনুসারে জীবনের নিজস্ব পথ বেছে নেয় তার ব্যবস্থা করা, যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা, বহুবিভাগ সমৃদ্ধ বিশ্বের জন্য একটি সামগ্রিক শিক্ষা দেওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি।জাতীয় শিক্ষানীতির উপর বিভিন্ন আলোচনায় আমরা বারবার দেখিয়েছি এ সমস্ত কথা খুব বিভ্রান্তিকর, চালাকিতে ভরা এবং এগুলির ঠিক উল্টো কাজ করাই এই শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য।
নতুন এই ব্যবস্থায় কী আছে? উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর কলেজে স্নাতক স্তরে (ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেলের মতো পেশাগত বিষয় ছাড়া) জেনারেল বা অনার্স পড়তে এতদিন তিন বছর লাগত। এখন থেকে অনার্স পড়তে গেলে চার বছর লাগবে। কিন্তু এছাড়াও অনেক কথা আছে। যেমন, কেউ এক বছর বা দুইসেমিস্টার পাশ করে যদি পড়াশোনা ছেড়ে দেয় তাহলে সে একটি সার্টিফিকেট পাবে, দুই বছর বা চার সেমিস্টার পাশ করে ছেড়ে দিলে তাকে ডিপ্লোমা দেওয়া হবে, তিন বছর বা ছয়সেমিস্টার সম্পূর্ণ করে ছেড়ে দিলে সে স্নাতক ডিগ্রি পাবে। আর যে চার বছর বা আট সেমিস্টার পাশ করবে এবং তার সঙ্গে গবেষণা করবে, তাকে চার বছরের মাল্টিডিসিপ্লিনারি স্নাতকের শংসাপত্র দেওয়া হবে এবং সেটাই পরিপূর্ণ অনার্স স্নাতক ডিগ্রি হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ তার গুরুত্ব সব থেকে বেশি হবে। তাহলে বাকি সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা বা কেবল স্নাতক ডিগ্রিধারীদের ভবিষ্যৎ কী হবে? অর্থাৎ সরকারি ব্যবস্থাপনার হাত ধরে চার ধরনের নাগরিক সৃষ্টির ব্যবস্থা হল।
আবার সব থেকে বেশি কৌলিন্যের শিরোপা নিয়ে যাঁরা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোবেন তাঁদের অবস্থা দেখুন। তাঁদের হাতে থাকবে ‘মাল্টিডিসিপ্লিনার’ নামক গালভরা খেতাব। এর মানে হল, তাঁরা ছাত্রাবস্থায় প্রভূত স্বাধীনতা পেয়েছেন– যার বলে প্রথম বছর পাঠ্য বিষয়গুলির যে সংমিশ্রণ (কম্বিনেশন) তিনি পড়েছেন, দ্বিতীয় বছর আরেকটি কম্বিনেশন পড়েছেন, তৃতীয় বছর অন্য আরেকটি কম্বিনেশন। যেমন, প্রথম বছর হয়ত পদার্থবিদ্যা ও ফ্যাশান ডিজাইন, দ্বিতীয় বছর অর্থনীতি ও রসায়ন, তৃতীয় বছর বাংলা ও মনস্তত্ববিদ্যা, ইত্যাদি। অর্থাৎ পাঠ্য বিষয়গুলির মধ্যে কোনও মিলমিশ নেই– সম্পর্কহীন, সংযোগমুক্ত কিছু বিষয়, যার মাধ্যমে পড়ুয়াদের মধ্যে সুসংবদ্ধ জ্ঞান গড়ে ওঠার কোনও সুযোগ নেই, যা বিদ্যার্থীর মনে যুক্তিবাদী মানসিকতা, মননশীলতার বিকাশে কোনও সাহায্য করবে না। খুব স্বাভাবিকভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে বিষয়ের কম্বিনেশন নিলে নম্বর বেশি উঠবে তাই নেওয়ার প্রবণতা কাজ করবে। তাতে হয়ত নম্বর বেশি উঠবে, কিন্তু জ্ঞান অর্জন হবে কি? এঁরাই হবেন বিজেপি-র দাবি অনুযায়ী তাঁদের পরিকল্পিত উচ্চশিক্ষার সর্বোৎকৃষ্ট ফসল! পড়ুয়াদের পাঠ্য বিষয় নির্বাচনের এমন অদ্ভুত স্বাধীনতা প্রদানকে তাঁরা বিদ্যার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা বলছেন এবং দাবি করছেন এমন ব্যবস্থা নাকি এর আগে কোনওদিন হয়নি। শিক্ষাবিজ্ঞানের ভাষায় বিদ্যার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার যে ধারণা আছে, তার সঙ্গে বিজেপি-আরএসএস-এর মস্তিষ্ক প্রসূত এই পরিকল্পনার কোনও সম্পর্ক নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের বিভ্রান্ত করে তাঁদের অমানুষ করার এটা এক গভীর ষড়যন্ত্র। প্রশ্ন হল, এতগুলো কম্বিনেশনে পড়ে তিনি কোন বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি পাবেন? পরবর্তী সময়ে যখন তিনি গবেষণা করবেন, তখনই বা তিনি কোন বিষয়ে করবেন?
আর একটি বিষয় আছে যা আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও উচ্চশিক্ষায় যতটুকু শৃঙ্খলা আছে তাকে বিপর্যস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। তা হল ‘মাল্টিপল এন্ট্রি’ ও ‘মাল্টিপল এিক্সিট’ এবং ‘অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট’। এর অর্থ হল, একজন ছাত্র এক কলেজে কিছুদিন পড়ে ক্রেডিট সংগ্রহ করে সেই কলেজ ছেড়ে আর এক কলেজে ভর্তি হতে পারবেন। সেখানে কিছুদিন পড়ে ক্রেডিট সংগ্রহ করে আর এক জায়গায় ভর্তি হতে পারবেন। এমন করে যাওয়া-আসা করতে করতেই চার বছরের কোর্স সর্বোচ্চ সাত বছর সময়ে সম্পূর্ণ করতে পারবেন। মাঝের বছরগুলোতে যে ক্রেডিট অর্জন করবেন তা ওই অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিটে জমা হতে থাকবে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্রেডিট সংগ্রহ হলেই তিনি ডিগ্রি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। সারা দেশের যে কোনও কলেজে তিনি ভর্তি হতে পারবেন। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, কোনও ছাত্র নতুন কোনও অনামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বছর পড়ে দ্বিতীয় বছর কলকাতা, যাদবপুরের মতো কোনও সামনের সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবেন। তা নির্ভর করবে আসন খালি থাকা, না-থাকার উপর। প্রশ্ন হল, তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাবেন?
এখানেই শেষ নয়। এই শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য মৌলিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা নয়, পড়ুয়াদের মধ্যে কাজের দক্ষতা বা স্কিল সৃষ্টি করা। তার জন্য ওই শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে স্থানীয় শিল্প ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, বা হাতের কাজ যাঁরা করেন তাঁদের কাছে ইন্টার্নশিপ করতে পাঠানো হবে। তাতে নাকি তাদের শিক্ষান্তে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতার বিকাশ হবে। লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার যেখানে বেকার, সেখানে এই স্কিল দিয়ে চাকরি পাওয়া সুবিধা হবে? রসিকতারও একটা সীমা থাকা উচিত!
পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারের উপর জোর, ভারতীয় ঐতিহ্যের নামে মধ্যযুগীয় ভাবধারার জাবর কাটা, অনলাইন-দূরশিক্ষা-অফলাইন-হাইব্রিড বা মিশ্র পদ্ধতি যে কোনওভাবেই বিদ্যার্জনের সুযোগ– এই হল নতুন ব্যবস্থার অভিনব আরও কিছু দিক। এত কিছুর সারমর্ম হল, এই স্নাতক কোর্স চার বছরের। তার মধ্যে যে কোনও বছরে ছেড়ে চলে যাওয়া যাবে এবং তদনুযায়ী সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। খেয়াল-খুশি মতো কলেজ ছেড়ে দিয়ে অন্য যে কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে। প্রতি বছর পাঠ্য-বিষয় পরিবর্তন করা যাবে। এমন আজগুবি ব্যবস্থাকে তাঁরা নজিরবিহীন বলে দাবি করছেন! আসলে এমন ‘স্বাধীনতা’র ধাক্কায় ‘শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা’র নামে শিক্ষার্থীদের কেরিয়ারে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হবে, সেটাই হবে নজিরবিহীন। কিছু না-শেখা, না-জানা, নম্বরসর্বস্ব এক শ্রেণির অনার্স ডিগ্রিধারীর জন্ম হবে, যাঁরা না পাবেন চাকরি, না পারবেন স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হতে, গবেষণা করার যোগ্যতাও কার্যত তাঁদের থাকবে না। অন্যদিকে স্নাতক স্তরের কলেজ ও অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র ভর্তির অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হবে। কারণ কোন ছাত্র কখন ভর্তি হবে এবং কখন ছেড়ে যাবে তার নিশ্চয়তা থাকবে না। তার উপর চার বছরের জন্য যে অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক ও অন্যান্য পরিকাঠামোর প্রয়োজন হবে তা কোথা থেকে আসবে, তার আর্থিক দায়িত্ব কে নেবে, সে ব্যাপারে কলেজগুলি খুবই শঙ্কিত। আমাদের মতো শিক্ষাক্ষেত্রে পুরোপুরি ‘নেই-রাজ্যে’ এই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি দ্রুত অস্তিত্ব-সংকটের সম্মুখীন হবে। সরকার পোষিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সামনে ঝুলবে বিলুপ্তির অশনিসংকেত। অভিভাবকরা দৌড়বেন তাঁদের সন্তান-সন্ততিকে নিয়ে মহার্ঘ বেসরকারি কলেজের আঙিনায়। শিক্ষার বেসরকারিকরণের জন্য প্রস্তুত থাকবে লাল-গালিচা অভিবাদনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। উচ্চশিক্ষা বিকাশের (!) এমন রঙিন বিজ্ঞাপন আগে কেউ কখনও দেখেছেন?
এই সর্বনাশা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ দেখে ২৫ মার্চ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, চার বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু করার আগে রাজ্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে কমিটি করবে। সেই কমিটি খতিয়ে দেখবে, এই নীতি চালু করার সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলি, কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেবে কিনা ইত্যাদি। কিন্তু তাঁর দপ্তর থেকে ১৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পাঠানো চিঠিতে ইউজিসি-র নির্দেশ অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এখন মুখে অন্য কথা বলার অর্থ কী? মন্ত্রীর মুখের কথায় সরকার চলে না, চলে সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী। জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থান কী, যে দুটি কমিটি সরকার গঠন করেছিল তার রিপোর্ট কী– তা জনসাধারণের জানার অধিকার আছে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার পরিকাঠামোর জন্য টাকা দিলেই মাল্টিপল এন্ট্রি ও এক্সিট বা মাল্টিডিসিপ্লিনারি কোর্সের মাধ্যমে সুসংহত জ্ঞান গড়ে ওঠার পথে যে বাধা সৃষ্টি হবে তা কি দূর হবে? আসলে ওই ঘোষণার পর থেকেই রাজ্য জুড়ে যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকরা যে ভাবে প্রতিবাদ করছেন, বিশেষ করে সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটি যেভাবে প্রতিবাদে সামিল হয়েছে, সাংবাদিক সম্মেলন করে, কলকাতা সমেত রাজ্যের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে ২৪ মার্চ নির্দেশিকার প্রতিলিপি পুড়িয়ে যেভাবে বিক্ষোভ হয়েছে, তার তীব্রতা সরকারকে চিন্তায় ফেলেছে। এই অবস্থায় মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই শিক্ষামন্ত্রী এই কথা বলেছেন।
এই প্রতিবেদনের উপসংহার হিসাবে যা লেখা যায় তা হল, অনেক লুকোচুরি করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একমাত্র চ্যাম্পিয়ন (!) দল তৃণমূল বিনা প্রতিবাদে এবং শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলির সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি হুবহু চালু করার কাজ শুরু করল। যে ব্যবস্থা তারা চালু করতে চাইছে তাতে স্নাতক স্তরের শিক্ষা প্রহসনে পরিণত হবে। শিক্ষা-বিবর্জিত স্নাতক তৈরির কারখানায় পর্যবসিত হবে বর্তমান কলেজগুলি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ভবিষ্যৎও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের রাস্তা আরও সুগম হবে। সরকার পোষিত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হবে। বোঝা গেল, মুখে বিজেপির বিরুদ্ধে যতই স্লোগান দিক, শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করার স্বার্থে বিজেপি-তৃণমূলের আসলে কোনও পার্থক্য নেই। ভোটের মঞ্চে বিজেপি-বিরোধী কংগ্রেস এমনকি বহু ক্ষেত্রে সিপিএম-ও শিক্ষার প্রশ্নে এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই চলছে।